ইউরোপের চিঠি-নেদারল্যান্ডের রাজনীতিতে ত্রিমুখী সংকট by পিটার কাস্টার্স

এমন সংকট আগে দেখা যায়নি। নেদারল্যান্ডের সীমানা ছাড়িয়েও এর প্রভাব পড়ছে। ইউরোপের ছোট্ট এ দেশে গত ৯ জুন নিয়মমাফিক পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বড় সাফল্য পায় কট্টর ডানপন্থী দল পিভিভি। এ দলের নেতা গিয়ার্ট উইল্ডার্স ইসলামবিদ্বেষী।


সাবেক প্রধানমন্ত্রী রুড লুবের্সের নেতৃত্বে কয়েক দফা নিষ্ফল আলোচনার পর নতুন সরকার গঠনের জন্য তিনটি রাজনৈতিক দল আলোচনা শুরু করার অনুমতি পায়। দল তিনটি হলো—ডানপন্থী লিবারেল পার্টি (ভিভিডি), ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি (সিডিএ) এবং উইল্ডার্সের নেতৃত্বাধীন পিভিভি। যদিও এ তিনটি দল মিলে ডাচ পার্লামেন্টে মাত্র এক আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় (১৫০ আসনের মধ্যে ৭৬টি), তবু তারা এই অনুমতি পেল। ঐতিহাসিকভাবে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি নেদারল্যান্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে আলোচনা করা নিয়ে দলটির ভেতর তুমুল মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরম আকার ধারণ করে ১ সেপ্টেম্বর। যখন দলটির পক্ষে আলোচনায় অংশ নেওয়া দুই নেতার একজন এব ক্লিংক তাঁর দল এবং উইল্ডার্সের দলের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একেবারেই আস্থা না থাকার ব্যাপারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। তখন থেকেই নেদারল্যান্ডের রাজনীতি রয়েছে ত্রিমুখী সংকটে। এগুলো হলো: নতুন সরকার গঠন নিয়ে সংকট, সিডিএর অভ্যন্তরীণ সংকট এবং ডাচ গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংকট।
এ পরিস্থিতির জটিলতা উপলব্ধি করতে হলে প্রথমেই ডাচ নির্বাচনী-ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। নেদারল্যান্ডে পার্লামেন্টের আসনগুলো জেলাভিত্তিক বরাদ্দ করা হয় না। ভোটের ফলাফল হিসাব করা হয় জাতীয় পর্যায়ে। এটিকে বলা হয় ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা। কারণ কোনো নির্বাচনে প্রতিটি দলের নির্বাচনী শক্তির যথাযথ প্রতিফলন এতে ঘটে। হয়তো এ ব্যবস্থার ফলেই ডাচ পার্লামেন্টে এমন অনেক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকে, যে দলগুলো ইতিহাসে কখনো পার্লামেন্টের এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসন লাভ করেনি। নতুন সরকার গঠনে আলোচনার পথ সাধারণত জটিল হয়। আর যে জোটগুলো তৈরি হয়, সেগুলো নিজেদের মধ্যে কোনো মতবিরোধের কারণে খুব সহজেই ভেঙে যেতে পারে। তবু নতুন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। যদিও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির আসনসংখ্যা আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে, তবু আলোচনার প্রক্রিয়ায় তারা যোগ দিয়েছিল। এক মাস আলোচনা চলার পর দলের ভেতর দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। কট্টর ডানপন্থীদের সমর্থিত কোনো মন্ত্রিসভা গঠন করা নৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কি না, সে প্রশ্নে দলটির প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
আগস্ট মাসে সিডিএর অভ্যন্তরে সংকট ঘনীভূত হওয়ার সময়ই প্রথমবারের মতো নেদারল্যান্ডে পিভিভি দলটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে জনপরিসরে সত্যিকারের বিতর্কের সূচনা হয়েছে। অনেক আগেই এই বিতর্ক হওয়া উচিত ছিল। গত আট বছরে পিভিভি তাদের ভিত মজবুত করেছে। এই সময়ে ডাচ রাজনীতিক ও গণমাধ্যমের বড় অংশ উইল্ডার্সের বক্তব্যের কট্টরপন্থী বৈশিষ্ট্যকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নেদারল্যান্ডে ক্রমবর্ধমান ‘বিদেশি-বিদ্বেষ’কে ধরতে চেয়েছে—কিন্তু পিভিভি ও গিয়ার্ট উইল্ডার্সের প্রতি তাদের সহানুভূতির ঘাটতি ছিল না। ইসলামের বিকৃত বিবরণের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে দলটির প্রচারণা। ইসলামের প্রভাব মোকাবিলায় সেই মধ্যযুগ থেকে ইউরোপের খ্রিষ্টবাদ যেসব কথা বলে আসছে, সেগুলোকেই সামনে নিয়ে আসছে দলটি। নেদারল্যান্ডের পত্রিকাগুলোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতে যদিও উইল্ডার্স ধর্ম হিসেবে ইসলামের বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু আজ তিনি মুসলিম মৌলবাদকে ইসলামের সঙ্গে পুরোপুরি এক করে দেখেন। দৈনিক এনআরসি-হ্যান্ডেলসব্লাড পত্রিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ এক সার্কুলারের উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, উইল্ডার্সের কর্মসূচি অন্তত তিন দিক থেকে ডাচ সংবিধান লঙ্ঘন করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হলো, ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন নিষিদ্ধ করতে উইল্ডার্সের দাবি। মন্ত্রণালয়টি বলছে, এটা বাকস্বাধীনতার নীতিবিরুদ্ধ।
পিভিভির উত্থান এবং এ উত্থান যে সংকটের প্রতিফলন ঘটায়, তা ডাচ ইতিহাসের পটভূমিতে বিশ্লেষিত হওয়া উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান নাৎসিবাদের শিকার নেদারল্যান্ড যুদ্ধ-পরবর্তীকালে স্পষ্ট ফ্যাসিবাদবিরোধী ও বর্ণবাদবিরোধী ডিসকোর্স তৈরি করেছিল। তাতে ছিল বাকস্বাধীনতা ও ধর্মের স্বাধীনতার মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর পক্ষে জোরালো সমর্থন। কট্টর ডানপন্থী কাজে এ স্বাধীনতার অপব্যবহারের বিরোধিতা করা হতো। অন্যদিকে স্পিনোজা ও বেইলির মতো ধর্মীয়-সহিষ্ণুতার দার্শনিক সপ্তদশ শতাব্দীতে নেদারল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন—এই ঐতিহাসিক সত্যের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রটি দশকের পর দশক ধরে ধর্মীয়-সহিষ্ণুতার আদর্শ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল। কট্টর ডানপন্থী দলগুলোর জনসমর্থন বৃদ্ধির কোনো লক্ষণ বড় ধরনের প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছে। গত শতকের আশির দশকের প্রথম ভাগ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তখন উটরেখট নগরের পৌরসভায় এক ডানপন্থী রাজনীতিকের প্রবেশের বিরুদ্ধে হাজারখানেক কর্মী সরাসরি সক্রিয়তা দেখান। কিন্তু ১৯৯০-এর দশক থেকে এ প্রবণতা পুরোপুরি পাল্টে যায়। ডানপন্থী লিবারেল পার্টির রাজনীতিকেরা বেশ বড়সড় অভিবাসী সংখ্যালঘুদের উপস্থিতির (যাদের বেশির ভাগই মুসলমান) ব্যাপারে স্থানীয় লোকজনের বর্ণবাদী আবেগকে উসকে দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের ভোটব্যাংকের বিস্তার ঘটাতে থাকে। উইল্ডার্সের ইসলামবিদ্বেষ এই প্রবণতারই ধারাবাহিকতা।
নেদারল্যান্ডে কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রশ্নে যে সংকট, তা রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সংকটের চেয়েও অধিক কিছু। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান সব নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও করপোরেট কর্তাব্যক্তিরা সবাই ভালোমতোই জানেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডাচ বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতি উইল্ডার্সের ইসলামবিদ্বেষ হুমকি তৈরি করে। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডের ওই ত্রিমুখী রাজনৈতিক সংকটের অর্থনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ার পর ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী রাজনীতিকেরা জাতিগত ও ধর্মীয় বিভক্তি উসকে দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ বোধ করছেন। উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্স থেকে সম্প্রতি রোমা অভিবাসীদের বিতাড়নের কথা বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ইহুদিদের মতোই রোমা অধিবাসীদের ধ্বংসের নীতি গ্রহণ করেছিল। উইল্ডার্স ও অন্যান্য কট্টর রাজনীতিকের এই ইসলামবিদ্বেষের তাৎপর্য একই। নব্য-উদারবাদী নীতিনির্ধারণ যে ব্যর্থ হয়েছে এবং ২০০৮ সালের পর ইউরোপের মাথাভারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য যে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, তার ফলে মাশুল দিতে হবে ইউরোপের শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষদেরই—এ সত্য থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াই মূলত তাদের এই ইসলামবিদ্বেষের লক্ষ্য। পিভিভি যে উদাহরণ সামনে নিয়ে আসে, সেই অভিন্ন প্রক্রিয়ায় ইউরোপের রাজনীতিকেরা মুসলিম বিশ্বে তাঁদের বাণিজ্যকে শুধু হুমকিতেই ফেলছেন না, তাঁরা আনুষ্ঠানিক সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিগুলোকেই দুর্বল করে ফেলার হুমকি তৈরি করছেন।
লেইডেন, নেদারল্যান্ড
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি; গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.