কোথায় চলেছে সমাজ, দেশ! by রীআ মাহমুদ

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- 'আমি কবি হতে আসিনি। প্রেম দিতে ও পেতে এসেছিলাম। প্রেম পেলাম না বলে এই প্রেমহীন পৃথিবী থেকে বিদায় নিলাম।' কথাটা সবার জীবনে কি সর্বৈব সত্য! কোন প্রেম তিনি খুঁজেছিলেন? মানুষ কোন প্রেম খোঁজে? পৃথিবী কি সত্যই প্রেমহীন? আজ বহুদিন পর বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনা শুনছিলাম শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে। সৃষ্টিকর্তা বাসনার কারাগারে বন্দি করে জীবের জন্ম দিয়ে চলেছেন নিরন্তর।


বুদ্ধদেব বসু কী নিদারুণ দার্ঢ্যের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন মানুষের কৃতিত্বের ও মহত্ত্বের কথা। মানুষের জৈব সত্তা প্রেমজ সত্তায় উত্তীর্ণ হয়েছে তার কর্মে, তার নিষ্ঠায়, তার প্রেমে, তার প্রতীতিতে। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে! এটাই কবির কাব্যসত্তার অহংকার।
যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তা দূত প্রেরণ করেছেন মানুষের কল্যাণে। বলেছেন- ভালোবাসো, অন্তর থেকে বিদ্বেষ বিষ নাশো। অথচ আজও হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী কেন? মানুষের সঙ্গে মানুষের বিকল সম্পর্ক, মনোভূমিতে অমারাত্রির আঁধার। হারিয়ে ফেলছে পথের ঠিকানা। রাজনীতি, সমাজনীতি- সব ক্ষেত্রেই ঘুণপোকার অস্তিত্ব সর্বজনবিদিত। সাধারণের প্রচলিত আপ্তবাক্যে বলা হয়- যে দেশে মুড়ি-মুড়কির একদর, সে দেশ যে রসাতলে যাবে তা তো বলাই বাহুল্য। ছাত্র আজ ছাত্র নয়, শিক্ষকের ভূমিকাও তথৈবচ। দার্শনিক শিক্ষক আজ লাঞ্ছিত। নারী আজ শ্বাপদের তীক্ষ্ন নখরে রক্তাক্ত।
শিশুরা মাতৃক্রোড়ে নিরাশ্রিত। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। চারদিকে যখন এহেন বঞ্চনা গ্রাস করছে, মানব অস্তিত্ব বিপন্ন- তখন ক্ষতের মুখে মলমের মতো কাজ দেয় রবিঠাকুরের গান। উচ্চারণ করি- 'আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।'
বারবার সকরুণ উচ্চারণ ও প্রার্থনার পরও ফিরিয়ে দিচ্ছ! খুব কি বেশি চেয়েছিলাম? চেয়েছিলাম একটি দেশ, সেই দেশের সব মানুষের স্বাধীনতা, প্রাণের আরাম। সব মানুষের মধ্যে একটি নিকট হার্দিক সম্পর্ক। যে দেশের মানুষ দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য রক্ত ঝরিয়েছিল, সেই দেশের মানুষ প্রয়োজনে রক্ত বাঁচাতেও শিখবে। এই ছিল কাম্য।
অথচ চারদিকে এ কী রক্তগঙ্গা বইছে, এ কী দৈন্য দশা। মানুষের নিভৃত আস্তানা হলো ফেসবুক। আহা- ফেসবুকও আজ অশ্রুসিক্ত হয়, ফেসবুকের বুকের মধ্যে ভালোবাসার রক্ত গোলাপ ফোটে, কী সাজানো বাগান। ভালোবাসার নৈবেদ্য! অথচ মানুষের হৃদয় শূন্য! হৃদয় বলে যে কোনো পদার্থ মানুষের কখনো ছিল, তা বিস্মৃতিপরায়ণ মানব সন্তান তা অন্বেষণের কোনো তাগিদই অনুভব করে না।
কিছু মানুষ অবশ্য এখনো তা আগলে ধরে আঁকড়ে বসে আছে। যা হারিয়ে গেছে, তা আগলে আর কতকাল বসে থাকবে অর্বাচীন বান্ধবরা।
বলো, আছে তোমার সেই শিষ্টাচার? সম্ভ্রমবোধ? ও রে আমার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (আমিও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত)- তোমাদের নামকরণ এভাবেই করছি। আত্মপ্রচার কী চেয়েছ, করতালিতে মুখরিত হতে কি চেয়েছ! কি না চেয়েছ প্রেম।
গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে আত্মসম্মান বিক্রির বেসাতি করনি তো, তাই অনেকের কাছেই তোমরা অর্বাচীন। সারল্য দেখলেই বলবে নিরেট মূর্খ। বিনয় দুর্বলতার প্রতীক।
ভালো কথা, ভালো লোক চিনব কী করে! এটা তো এক জটিল প্রশ্ন।
সঠিক মানুষকে চেনার যে আলোকবর্তিকা আজ প্রয়োজন, তা কোথায়? কোথায় সেই বাতিওয়ালা- যে পথ বাতলে দেবে!
গোয়েবলসের তত্ত্বের মতো অজস্র মিথ্যা জালে 'সত্য কথন' আজ ধর্ষিতা। যাকে ভাবা হচ্ছে প্রকৃত বোদ্ধা সে তা নয়, নামে যোদ্ধা, কিন্তু নিধিরাম সর্দার। ঢাল-তলোয়ার না থাকুক, মনের সাহসটুকুও নেই। অকুতোভয় সাহসী মানুষ বলে বিশ্বখ্যাত অথচ এক ক্লীব সত্তা! বৃহন্নলা বেশে শৌর্যবীর্যের আস্ফালন!
বিপদের গন্ধ পেলেই সুড়ুৎ করে আঁচলের নিচে ঢুকে আত্মরক্ষার যত আয়ুধ, তা করায়ত্তকরণ। পলায়নপ্রবণ জাতি পালাতে পালাতে কোথায় ঠেকবে পিঠ। কে দেবে ঠাঁই! নিজের দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে যদি শেকড়িত না হও, তাহলে কী হয় পরিণতি তা কি ইতিহাসের কোনো শিক্ষা থেকেই পায়নি জাতি? কাকের মতো চক্ষু মুদে ভাবছ, কেউ তোমাকে দেখেনি। তবে আজকাল দেশীয় কাকেরা চক্ষুলজ্জা নিয়ে আর বিব্রত নয়।

লেখক : শিক্ষক ও আবৃত্তিশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.