ঢাকায় আসতে বিপত্তি
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশের দিন গতকাল সোমবার সকাল থেকে ঢাকার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানের বাস চলাচল বন্ধ ছিল বলে জানা গেছে। তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। আগের দিন রবিবার রাত থেকে বরিশাল ও বগুড়া থেকে ঢাকামুখী বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে পুলিশ যান চলাচলে বাধা এবং যাত্রীদের নামিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ঢাকাগামী মানুষ চরম দুর্ভোগ ও হয়রানিতে পড়ে।
বাসমালিক সূত্রে জানা যায়, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ভাঙচুর ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটতে পারে- এ রকম আশঙ্কায় মালিকপক্ষ বাস চলাচল বন্ধ রাখে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী পরিস্থিতি সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পথে পথে যানজটের কারণে বিভিন্ন রুটের শত শত গাড়ি সোমবার সকাল থেকেই আটকে থাকে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে একটি ট্রাক হঠাৎ বিকল হয়ে পড়েছিল। এই সড়কে তীব্র যানজট কেন হঠাৎ করে সৃষ্টি হলো নাকি এটি করানো হয়েছে- এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।'
গতকাল নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, চাঁদপুর, শেরপুর থেকে ঢাকার কোনো বাস ছাড়েনি। নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে ঢাকায় সরাসরি লঞ্চ না চললেও ওই জেলা থেকে বিভিন্ন রুটের লঞ্চ বন্ধ ছিল। মাওয়ায় যাত্রীবাহী কোনো নৌযান ভিড়তে দেওয়া হয়নি। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় সব লঞ্চ। চাঁদপুরে রবিবার রাতে লঞ্চ চলাচলে বাধা দিলেও পরে যাত্রীদের চাপে ছাড়তে বাধ্য হয়। গতকাল দিনভর লঞ্চ চলেছে।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, সমাবেশে আসার পথে নেতা-কর্মীদের বাধা দিয়ে এবং পরিবহন সংকট সৃষ্টি করে সরকার অঘোষিত হরতাল করছে।
এদিকে, সারা দেশে আরো ধরপাকড়ের খবর পাওয়া গেছে। রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর ও চাঁদপুরে বিএনপি-জামায়াতের অন্তত ৬৯ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সাতক্ষীরা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে দেড় শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকার বাইরে আমাদের অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
বাস-লঞ্চ বন্ধ, পুলিশের বাধা
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোডে চলাচলকারী সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ ছিল। নারায়ণগঞ্জ থেকে পাঁচটি রুটে চলাচলকারী সব ধরনের লঞ্চ বন্ধ রাখা হয়। তবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে র্যাব ও পুলিশের একটি যৌথ দলকে অস্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে ট্রেন যাত্রীদের তল্লাশি করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল কালের কণ্ঠকে জানান, ওপরের মহলের নিষেধ আছে বলেই লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ বাস, মিনিবাস, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মুক্তার হোসেন জানান, বাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত পরিবহন মালিকদের নয়। হামলা ও বাস ভাঙচুরের আশঙ্কায় পরিবহন শ্রমিকরাই বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে।
গাজীপুর হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও টঙ্গী-ঘোড়াশাল-সিলেট মহাসড়কে চলাচলকারী দূরপাল্লার বাস রবিবার রাত থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। রাতে গাজীপুরের বিভিন্ন রুটের কিছু লোকাল বাস চললেও টঙ্গী ব্রিজ পেরিয়ে রাজধানীতে ঢুকতে পারেনি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাকিল জানান, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু বাসের অভাবে যেতে পারেননি। দুপুরের পর গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মহাসড়কে র্যাকার দাঁড় করিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা, ভোগড়া বাইপাস ও টঙ্গী বাজারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে পুলিশ যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ সড়ক খুলে দিলে আবার যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধামরাই এলাকার ইসলামপুরে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে সকাল থেকেই কাগজপত্র তল্লাশির নামে যানবাহন থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। অভিযোগ অস্বীকার করে চেকপোস্টে দায়িত্বপ্রাপ্ত ধামরাই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বদরুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ গাড়িতে জ্বালানি নেই বিধায় চালকরা যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছেন।
মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী কোনো বাস চলাচল করেনি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দু-একটি দূরপাল্লার বাস চলাচল করলেও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া, আরিচা, ঘিওর, দৌলতপুর ও হরিরামপুর উপজেলা থেকে বাস চলাচল করেনি। সরকার সমর্থক বাসমালিক সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ও পুলিশের চাপে সোমবার সকাল থেকে সোনারগাঁ থেকে ঢাকা রুটে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। ঢাকার যাত্রী ফাতেহা নূর জানান, তাঁর মা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। দুপুর ২টায় অস্ত্রোপচার হবে। দীর্ঘক্ষণ ধরে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, কোনো যানবাহন পাচ্ছেন না।
ঢাকার সঙ্গে চাঁদপুরের বাস চলাচল বন্ধ ছিল। বাস মালিকরা জানিয়েছেন, হাইওয়ে পুলিশের নিষেধের কারণে তাঁরা বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। তবে পুলিশ বলেছে, যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ এড়াতে সড়কে বাস চলাচল সীমিত করা হয়েছে।
ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে বাস চলাচল করেনি। মাওয়ার নতুন পার্কিং ইয়ার্ড থেকে ঢাকার যাত্রী নিয়ে দু-একটি বাস রওনা হলেও চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশ নামিয়ে দেয়। পদ্মার ওপার থেকে কোনো যাত্রীবাহী লঞ্চ, ট্রলার বা সি-বোট মাওয়ায় এলে পুলিশ ঘাটে ভিড়তে দেয়নি। তবে ফেরি চলেছে যথানিয়মে। মাওয়া চৌরাস্তা, খানবাড়ীসহ মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে নছিমন, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে হয়রানি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গোয়ালন্দ ঘাট থানার পুলিশ দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটে থাকা সব লঞ্চ সরিয়ে সেগুলো নৌ-চ্যানেলের ওপারে বিভিন্ন চর এলাকায় সরিয়ে রাখে। এ ব্যাপারে পুলিশ ও ঘাট কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শেরপুরে রবিবার রাত থেকে আকস্মিকভাবে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শেরপুর-ঢাকা রুটে চলাচলকারী ১০টি নৈশকোচের কোনোটিই ছেড়ে যায়নি।
আরো ধরপাকড়
চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ গতকাল বিএনপির আরো ১৬ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এই নিয়ে দুই দিনে বিএনপি ও জামায়াতের মোট ৩৬ জনকে আটক করা হলো। পুলিশ বলেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজবাড়ী সদর, পাংশা ও বালিয়াকান্দি থেকে বিএনপির ১৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে বিভিন্ন মামলায় তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়। সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির ১৮ নেতা-কর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। সিরাজগঞ্জ সদর থানার ওসি সৈয়দ সহিদ আলম জানান, নাশকতার আশঙ্কায় সিরাজগঞ্জ শহর ও মহাসড়কে ঢাকামুখী বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে তাঁদের আটক করা হয়।
রবিবার রাত ও গতকাল সোমবার গাজীপুরের চার উপজেলায় পুলিশ ১০ শিবিরকর্মীসহ বিরোধী দলের ৪৫ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের মধ্যে টঙ্গী থেকে সাতজন শিবিরকর্মীসহ ১৩, জয়দেবপুর থেকে ১৮, কালীগঞ্জ থেকে আট, কালিয়াকৈর থেকে তিন ও কাপাসিয়া থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল ভোরে শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ১৪ জন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে। শ্রীপুর থানার ওসি আক্তারুজ্জামান জানান, আটককৃতদের বিরুদ্ধে হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলাসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জের ছয়টি উপজেলা থেকে সাতজন বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
No comments