মানুষের মুখ-আদর্শ ছাড়া সন্তানকে আর কী দেব? by শর্মিলা সিনড্রেলা

রাজশাহীর সোনাদীঘি মোড়ের পশ্চিমে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। সাহেববাজার-চিড়িয়াখানা রাস্তার সঙ্গে লাগানো মূল দরজাটি বন্ধ। কারণ তখন রাত সাড়ে আটটা। ল্যাম্পপোস্টের আলো ততটা উজ্জ্বল নয়। সেই আলো-আঁধারিতে স্কুলের গেটে কতগুলো মূর্তি নিয়ে বসে আছেন একটি লোক।


কাছে গিয়ে গ্রিক পুরাণের প্রেমের দেবী ভেনাসের মূর্তিটাতে হাত দিতেই বলে উঠলেন, ‘আমার কাছে শকুন্তলার মূর্তিও আছে। দেখবেন?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই দেখব।’
বলার সঙ্গে সঙ্গেই এক রিকশাওয়ালাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা, একটু চলো তো।’
অতগুলো মূর্তিসমেত দোকানটা ফেলে রেখেই চলে গেলেন বাড়িতে! বাড়িটা খুব দূরে নয়। কুমারপাড়ার শেষ প্রান্তে। প্রায় ২০ মিনিট পরে নিয়ে এলেন আরও কিছু সুন্দর সুন্দর মূর্তি। ৫০ বছর বয়সী লোকটি সব সময় এমন সদালাপী এবং উদ্ভাসিত। তাঁর নাম সাধন বসু। পরনে তাঁর সাদাসিধে পোশাক আর মুখে অমলিন হাসি।
শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিত করে। কিন্তু আত্মিক দিক থেকে উন্নত হতে পারে কজনা? সাধন বসুকে দেখে এবং তাঁর সঙ্গে মিশে নিজেকে ক্ষীণ মনে হয়। মাত্র পঞ্চম শ্র্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর জীবনবোধের কথা শুনে অবাক হই। ঠোঁটের আগায় আফসোসের সুর, ‘যখন যুবক ছিলাম, তখন জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। এখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন জীবন সম্পর্কে ধারণা জন্মেছে, তখন দেখি পেছন ফেরার আর উপায় নেই।’
মূর্তি তৈরির কাজ করেন সাধন বাবুরা, সপরিবারে। ১৯৮২ সালে সাধন বাবু বিয়ে করেন প্রতিমা রানী বসুকে। সাধন বাবুদের আগে ছিল কাপড়ের ব্যবসা। একবার ব্যবসায় বড় একটা ধস নেমে এল। স্ত্রী পরামর্শ দিলেন মৃৎশিল্পে জড়াতে। বউয়ের পরামর্শ বৃথা হয়নি। বেশ আনন্দ পান এই কাজটি করে।
শিল্পকর্ম দেখাতে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। প্রথমে আমরা উঠলাম তাঁর শ্যালকের ঘরে। সেখানেও সারে সারে রাখা বিভিন্ন মূর্তি। অপরূপ সুন্দর সবকিছু। ঘরে দীনতার ছায়া। কিন্তু এসব জিনিস যেন ঘরগুলোকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তুলেছে।
‘আমার স্ত্রীর বড় ভাই বিশ্বনাথ ধর। তাঁর কাছেই আমরা এই কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তিনি এখন ভারতে। এখন আমরাই এই কাজ করছি।’
শ্যালক গণেশ চন্দ্র ধর বের করে আনলেন দেবী দুর্গার এক অপরূপ সুন্দর মূর্তি। কত যে সুন্দর তার কারুকার্য! ‘প্রথমবার বলে মূর্তিটা তৈরি করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছে। এখন অবশ্য এটা আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টায় শেষ করে দিতে পারব। আসছে দুর্গা পুজোয় এটা বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাব।’ এত ভালোবাসা, ধৈর্য দিয়ে কাজ করার পর এই মূর্তি থেকে দাম পাওয়া যাবে হয়তো দেড় শ বা দুই শ টাকা।
‘আমরা এখন আমাদের তৈরি করা এসব শিল্পকর্ম ঢাকার আড়ংয়েও নিয়ে যাই। এসব নিয়ে নিশ্চয়ই অনেকে তাদের ঘরের শোভা বাড়ায়, কিন্তু আমাদের অবস্থার আর পরিবর্তন হয় না। শিল্পকর্মের মূল্যায়ন হয় কিন্তু শিল্পীর মূল্যায়ন আর হয় না। আমরা থাকি সেই অন্ধকারেই।’ হতাশ কণ্ঠে সাধন বসু বলছিলেন। এসব তৈরি করতে তাঁরা ব্যবহার করেন মাটি, প্লাস্টার অব প্যারিস, সিমেন্ট, এঁটেল মাটি, রং ইত্যাদি।
এ দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ, তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি সাধন বাবুর। কেবল তখন ক্লাস ফাইভে পড়েন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা না হলেও পানিপিয়া ক্যাম্পে কাজ করেছেন তিনি। ১৩ দিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ ছিলেন। পরে যখন ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলল, তখন তো যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ ছাড়ার চিন্তা। ‘ভেবেছি, বাংলাদেশে আর থাকতেই পারব না। অবশেষে যাওয়া হয়নি। কিন্তু বাড়িঘর তো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। এখন থাকি বাড়ি ভাড়া করে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে আমার। কিন্তু তাদের দেওয়ার মতো তো কেবল আদর্শ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবু আমি খুশি, কেননা আমার অর্থবিত্ত দিয়ে তারা যত না বড় হবে, তার চেয়ে বেশি বড় হবে যদি আমার আদর্শটাকে ধারণ করতে পারে।’
স্ত্রীর কাছ থেকেই এই কাজ করার পরামর্শ পেয়েছিলেন তিনি। এখনো স্ত্রীর সহযোগিতা পান। প্রতিটি কাজের শেষটা প্রতিমা বসুই করে দেন। আলোচনা-সমালোচনা করেন সবাই মিলে। ফলে কাজগুলো হয়ে ওঠে আরও আকর্ষণীয়। প্রতিমা বসু স্বামী সম্পর্কে বলেন, ‘ও তো কাজের জন্য পাগল। কাজ নিয়েই থাকে সারা দিন। আমাদের ছেলেমেয়ে বর্ষা, সাগর ও সৈকত। বর্ষার একটা মেয়ে আছে। নাম সৃষ্টি।’ এমন নাম রেখেছেন সাধন বসু। তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘ও বলে, আমি তো মরে যাব। কিন্তু বেঁচে থাকবে আমার কাজ, আমার সৃষ্টি, আমার শিল্পকর্ম।’
সাধন বসু সময় পেলেই গান শোনেন। তাঁর প্রিয় গান ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’। সাধন বসু বলেন, ‘হ্যাঁ, এর মধ্যেই আমি জীবনের মানে খুঁজে পাই। এই গানের প্রতিটি বাক্যেই যেন জীবনবোধ লুকিয়ে আছে।’ তাঁর প্রিয় ছবি ব্ল্যাক অ্যাঞ্জেল ও কানামাছি ভোঁ ভোঁ।
লোকটিকে যতই দেখছিলাম, ততই অভিভূত হচ্ছিলাম। ঘরের পরে পদ্মা নদী। রাত তখন ১১টা। আঁধারে ছেয়ে আছে পদ্মার গা। কিন্তু তার পাশে সাধন বসুকে আলোকিত একটা নক্ষত্র মনে হলো। যখন ফিরে আসছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, অনেক অনেক ডিগ্রিধারী কোটি টাকার মালিক কিন্তু জীবনবোধহীন একজন মানুষের চেয়ে এই ক্লাস ফাইভ পড়া অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল কিন্তু জীবনবোধে দীপ্ত সাধন বসু অনেক উঁচুমানের মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.