চার দশকে শিল্প খাতে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি by ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ প্রকৃতির মিশ্র সহযোগিতাপ্রাপ্ত একটি দেশ। এ দেশের জনগণ, তাদের মূল্যবোধ এবং জীবনযাত্রা এই মিশ্র স্বভাবসিদ্ধ। এ দেশের অর্থনীতিও প্রকৃতির এই মিশ্র স্বভাবে প্রভাবিত। কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর বাংলাদেশের অবস্থান হয়েও মাথার ওপর হিমালয় পর্বত এবং পায়ের নিচে বঙ্গোপসাগর থাকায়


বাংলাদেশ মরুভূমি নয়; বরং মৌসুমি বায়ুমণ্ডল ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়াবলয়ের কারণে সুজলা-সুফলা। আবার গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের বিচিত্র খেয়ালের শিকার_বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, গোর্কির কারণে এর জীবনায়ন অর্জনে ঘটে নানা দুর্বিপাক। জলবায়ুর পরিবর্তন আর পরিবেশদূষণের কবলে পড়ে হিমালয় এখন এ দেশটির জন্য আশীর্বাদের পরিবর্তে ক্রমশ হয়ে উঠছে অকালবন্যা আর খরার কারণ। এ দেশের জনগণ সরলমনা, ভাবুক, কিছুটা পরিশ্রমী এবং অল্পে তুষ্ট। শারীরিক গঠন খাদ্যাভ্যাসের কারণে কঠোর ও দীর্ঘস্থায়ী পরিশ্রমে অপারগ এ দেশের জনগণ প্রকৃতির খেয়ালখুশির ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। সঞ্চয়ের অভ্যাস তাই কম।
বাংলাদেশের অর্থনীতি রাজনৈতিক-ভৌগোলিক অবস্থানের দ্বারাও বিশেষভাবে প্রভাবিত। বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ সীমান্ত ভারতীয় উন্মুক্ত ভূমি, নদী ও পাহাড়ে পরিবেষ্টিত, ৫ শতাংশ সীমান্ত মিয়ানমারের সঙ্গে পাহাড়ি পথ এবং বাকি ২০ শতাংশ সীমান্ত বিশ্বের সেরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনসহ সমুদ্র উপকূল-বঙ্গোপসাগরবিধৌত। বৃহতের পাশে ক্ষুদ্র একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পক্ষে স্বাধীন স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা কিংবা মুক্তবাজার অর্থনীতির নির্দেশনা ও প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় এবং স্থানীয় শিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সংরক্ষণব্যবস্থা গ্রহণে যেসব প্রতিকূলতা সচরাচর ঘটে থাকে, বাংলাদেশ তার থেকে ব্যতিক্রম নয় কোনো দিক দিয়েই।
প্রত্যাশা এই, দেশীয় শিল্প সম্ভাবনাকে উপযুক্ত প্রযত্ন প্রদানের মাধ্যমে স্বয়ম্ভর শিল্প ভিত্তি গড়ে তোলা, যা দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার দ্বারা প্রয়োজনীয় ফিনিশড্ প্রডাক্ট তৈরি করতে সক্ষম হবে এবং এর ফলে বিদেশি পণ্যের ওপর আমদানিনির্ভরতা তথ্য মহার্ঘ বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। দেখা গেছে, রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ, কৃষিজাত পণ্যের উন্নয়ন ফান্ড জাতীয় মাল্টি সেক্টরাল প্রকল্পগুলোর টাকা অব্যয়িত রয়ে গেছে কিংবা কোথাও কোথাও অপব্যয়িত হয়েছে অপ্রয়োজনীয় খাতে ও ক্ষেত্রে। দেশীয় লাগসই প্রযুক্তি অনুসন্ধান ও গবেষণায় বিদেশি কনসালট্যান্টের পেছনে বিশেষজ্ঞ ব্যয়ে টাকা খরচ হয়েছে অথচ সমন্বয়ের অভাবে কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ সেক্টরের অধিকাংশ প্রকল্পে বিনিয়োগে অর্জিত অগ্রগতি বা প্রভাব (রসঢ়ধপঃ) অনেক সময় দৃশ্যগোচর হয় না।
শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগে আর বিদেশি সাহায্যের ব্যবহারে অর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশিত অগ্রগতির হিসাবসংক্রান্ত তুলনামূলক সারণিগুলোর সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান ও সম্পর্কের শুমার এবং বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশ অর্থনীতির অগ্রগতি ও গতিধারা শনাক্তকরণে অসুবিধা হয় না।
দেখা যায়, আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ জিডিপির অংশ হিসেবে ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও রপ্তানির মিশ্র প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। অস্থিতিশীল ও ভিন্ন মাত্রিক ট্যারিফ স্ট্রাকচারের প্রভাব পড়েছে বহির্বাণিজ্যে ভিন্ন অনুপাতে। এতে বোঝা যায়, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য সাধারণ সূত্র অনুসরণ করতে দ্বিধান্বিত হয়েছে। উৎপাদন না বাড়লেও সরবরাহ বাড়ার প্রবণতায় মূল্যস্থিতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। আবার ইনফরমাল বর্ডার ট্রেডের ফলে দেশজ উৎপাদনের বিপত্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের আমদানি করা সামগ্রী অন্য দেশে পাচার হয়েছে, আবার কোনো কোনো বিদেশি পণ্যের অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে আরোপিত ট্যারিফে দেশি সামগ্রী উৎপাদনব্যবস্থার স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে।
রপ্তানি বাণিজ্যে প্রাথমিক পণ্যের অবদান প্রচণ্ডভাবে হ্রাস পেয়েছে। কৃষিজাত পণ্য এবং হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা (যেমন নগদ সহায়তা, অবকাঠামোগত সুবিধাদি যেমন যোগাযোগ পরিবহন তথা পোর্টের সমস্যা নিরসন, বাজার খোঁজার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদার ইত্যাদি) বৃদ্ধি পেলে রপ্তানি বাণিজ্যে প্রাথমিক পণ্যের হিস্যা বাড়তে পারে। কৃষিপ্রধান অর্থনীতির জন্য প্রাথমিক পণ্যের টেকসই রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি বহুমুখীকরণের কার্যক্রমে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি এবং হিমায়িত খাদ্য হিসেবে মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রসেসিং পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা আবশ্যক। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিচয় এ রকম, 'আমার যা আছে তা এই, আপনি নিলে নিতে পারেন।' অথচ এটা হওয়া উচিত ছিল, 'আপনি যেভাবে চাইছেন, আমি সেভাবে তা সরবরাহ করতে সক্ষম।' এ জন্য প্রয়োজন বাজার অনুসন্ধান, বিভিন্ন বাজারের চাহিদার প্রকৃতি অনুধাবন এবং চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহে সক্ষমতা অর্জনের নিমিত্তে উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনয়নে গবেষণা জোরদার করা। এর জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দৃঢ়চিত্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। ভাবনা অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, অগ্রগতির নিয়মিত মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনবোধে কাঙ্ক্ষিত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া পরিবর্তনে দ্রুত সমন্বয়সাধনে তৎপর হওয়া আবশ্যক।
রপ্তানি বাণিজ্যে ম্যানুফ্যাকচার সামগ্রীর হিস্যা বেড়েছে। কিন্তু পাট ও চামড়াজাত সামগ্রীর পরিমাণ হ্রাস এবং তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ম্যানুফ্যাকচার পণ্যের রপ্তানি আয়ের ভ্যালু এডিশনের প্রশ্নে অবস্থা সন্তোষজনক নয়। পাটজাত সামগ্রীর বিশ্ববাজার পড়তি পর্যায়ে কিন্তু চামড়াজাত সামগ্রীর বাজারজাতকরণে বাংলাদেশের সাফল্য সুদূরপরাহত হবে না, যদি এ খাতটির প্রতি ন্যায্য দৃষ্টি দেওয়া যায়। যদি জাপানের চামড়া শিল্পের সানসেট ইন্ডাস্ট্রি এবং ইতালির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আরো যৌথ বিনিয়োগে যাওয়া যায় এবং বাজার সৃষ্টিতে বাণিজ্যিক কূটনীতিকে আরো সক্রিয় করা সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশ এ খাতে একটা টেকসই অগ্রগতি অর্জন প্রত্যাশা করতে পারে। পশ্চাৎসংযোগ শিল্প প্রতিষ্ঠা গার্মেন্ট খাতে রপ্তানিতে ভ্যালু এডিশন বাড়ার অন্যতম উপায়।
আমদানি বাণিজ্যে প্রাথমিক পণ্যের ব্যয় ক্রমশ হ্রাসপ্রাপ্তি বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে ক্রম অগ্রগতির সাক্ষ্য বহন করে, তবে পরিমাণগত দিক দিয়ে ম্যানুফ্যাকচার পণ্যের আমদানি বাড়াতেই প্রাথমিক পণ্যের হিস্যা কমেছে_এটাও লক্ষণীয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় পুঁজিবাদের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত হওয়ায় নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির প্রভাববলয়ে চলে যায় নতুন অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সাবেক পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির রেখে যাওয়া শিল্প-কারখানা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এনে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে তাদের নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় বেসরকারি খাত তখন এমন স্বয়ম্ভর ও সক্ষম ছিল না যে পরিত্যক্ত শিল্প অবকাঠামো দেখাশোনার ভার নিতে পারে। তখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ছাড়া গত্যন্তরও ছিল না। যে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় সামনে রেখে জাতীয়করণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়, তা পূরণ ও বাস্তবায়নে পাবলিক সেক্টরে দক্ষ ব্যবস্থাপনা যে প্রকট তা যথাসময়ে উপলব্ধি করা যায়নি। ফলে লাভজনক শিল্প-কারখানাগুলো অধিক লোকসান এবং এমনকি যন্ত্রপাতি যন্ত্রাংশ পাচার হওয়ার মতো দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার হয়। পরবর্তীকালে এগুলো বিএমআরই কিংবা বেসরকারি খাতে বিক্রি করায়ও বিপত্তি দেখা দিয়েছে। ফলে এগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে জগদ্দল পাথরে পরিণত হয়েছে। পাবলিক সেক্টর দিয়ে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব না হলেও পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরে উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব ও উদ্যোগের অভাব আগের মতোই থাকে। সত্তরের দশকের শেষ এবং আশির দশকের শুরুতে নতুন শিল্পনীতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের কার্যকর অংশীদারী নিশ্চিত করতে নীতিমালা ও কৌশল ঘোষিত হয়। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কর্মসূচিতে অমনোযোগিতার অবসরে কার্যকর বিনিয়োগ প্রবাহের পরিবর্তে পুঁজিবাদী বিশ্বের স্বার্থ ও সমর্থনে কম ভ্যালু এডিশনসম্পন্ন শিল্প এ দেশের বাজার দখলের পাঁয়তারায় প্রবেশ করে। দেশের বেসরকারি খাতের স্বয়ম্ভর হওয়ার সুযোগ সেখানে সংকুচিত হয়ে দাঁড়ায় এবং অর্থনীতির পরনির্ভরশীলতা থেকেই যায়। উন্নত বিশ্বের পরিত্যক্ত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও পরিবেশদূষণকারী শিল্প অবকাঠামো বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারে প্রবেশ করে।
কোন পদক্ষেপ অর্থনীতির জন্য সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনবে তা চটজলদি বলা মুশকিল, তবে যেকোনো পদ্ধতির ভালো-মন্দ উভয় দিক যেহেতু আছে_ভালো দিকটা যাতে প্রতিভাত হয় সে জন্য সময় ও মেধা প্রয়োগ সমীচীন। বাংলাদেশের ৩৯ বছরের অর্থনৈতিক অভিযাত্রায় টেকসই উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাময়িক, সীমিত ও খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির অবয়বে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়েই রয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে রাজস্ব বিভাগের কাছে আমদানি শুল্ক আদায় অন্যতম অবলম্বন হয়ে ওঠে, আয়কর গৌণ হয়ে দাঁড়ায়, মূল্যসংযোজন কর কিংবা বিক্রয় করের প্রশ্ন অবান্তর না হলেও কার্যকর ব্যবস্থার অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.