সামরিক আদালতে বিচার-কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের সংরক্ষিত নথি by এ এম এম শওকত আলী
কয়েক দিন আগে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের নথি খোঁজাখুঁজির বিষয়ে পত্রিকায় কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। জানা যায়, এ সম্পর্কে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশ সরকারকে দেওয়া হয়। প্রায় ৩৫ বছর আগে এই আদেশ কার্যকর করা হয়। তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন।
তৎকালীন সেনাপ্রধান কর্তৃক গঠিত একটি সামরিক আদালত অতি সংক্ষিপ্তভাবে বিচারকাজ সম্পাদন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একে বিচারবহির্ভূত হত্যা বলা যায় কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা অমূলক। কারণ সংবিধানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত আদালতের বাইরে যদি কারও দণ্ড কার্যকর হয়, তবে এ ধরনের ঘটনা বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সামরিক শাসনের সময় সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত আদালতের এখতিয়ার ক্ষুণ্ন হয়। এর মূল কারণ, সামরিক শাসনের বলে সামরিক আদেশ ও সামরিক বিধি জারি করা হয়। এসব আদেশের বা বিধির অধিক্ষেত্রে সাধারণ বেসামরিক নাগরিকও অন্তর্ভুক্ত। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সামরিক শাসনের সময় দুই ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়—এক. বিশেষ সামরিক আদালত। দুই. সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত। এ দুই ধরনের আদালতের কোনোটিই কর্নেল তাহেরের বিচার সম্পাদন করেননি বলে জানা যায়। এ বিচারের জন্য গঠন করা হয়েছিল একটি সামরিক ট্রাইব্যুনাল। এ ট্রাইব্যুনাল অনুসরণীয় নিয়মাবলি সঠিকভাবে পালন করেছেন কি না, তা জানা দরকার।
পাকিস্তানে ১৯৫৮ সাল-পরবর্তী সময় সামরিক শাসনের বলে অনেক আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে লাহোর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি একটি মামলা নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছিলেন, এসব আদেশ বা নির্দেশ জারি করার সময় সংশ্লিষ্ট সামরিক আইন বা বিধি অনুসরণ করা হয়েছে কি না, সে বিষয়েও যে হাইকোর্টের এখতিয়ার রয়েছে, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে জানা নেই। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের আদেশের বিষয়েও একই যুক্তি প্রযোজ্য। প্রেক্ষাপট ভিন্নতর হলেও এর মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিষয়ে নথি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না?
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের কিছু বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বক্তব্য থেকে দেখা যায়, মন্ত্রণালয় জেল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এটা সঠিক হলেও বলা যায়, সামরিক ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট মামলার নথি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে থাকার কোনো নিয়ম নেই। এমনকি সংবিধানস্বীকৃত আদালতেরও এ ধরনের মামলার নথি জেলে কখনোই পাঠানো হয় না। সাধারণত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা আদালত থেকেই সংশ্লিষ্ট আদেশের বাস্তবায়ন করার জন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় জেল কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে প্রদত্ত রায়ের সত্যায়িত অনুলিপিও হয়তো বা পাঠানো হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনাল এসব নিয়ম পালন করতে বাধ্য কি না, তা সেনা আইন পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
জেল কোড অনুযায়ী জেল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দিন-তারিখ নির্ধারণ করে মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা (DeathÊWarrant) জারি করে। যত দূর জানা যায়, এর একটি যায় সংশ্লিষ্ট জেলায় দায়রা জজের দপ্তরে, অন্যটি যায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে। জেল কোড অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত থাকার জন্য মনোনীত করতে হয়। জেলের বাইরের যে কর্মকর্তার উপস্থিতির প্রয়োজন হয়, তিনি একজন সরকারি চিকিৎসক। সাধারণত সিভিল সার্জন বা তাঁর অধীন কোনো চিকিৎসক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা মহাপরিচালককে নথির বিষয়ে যে তথ্য দিতে বলা হয়েছে, সে তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা এখনো কেউ জানে না। হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাবে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য ছিল, প্রায় তিন দশক পর নথি পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষণ করা হয় সাধারণত অনধিক ১০ বছর। এ সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। সচিবালয় নির্দেশিকায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সচিবালয়ের নথির শ্রেণীবিন্যাসসহ সংরক্ষণের মেয়াদও নির্ধারিত রয়েছে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী চার ধরনের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়—এক. ‘ক’ শ্রেণীয় নথি। ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত নথির মধ্যে নীতি, আইন, বিধি ও প্রবিধানসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোচনা ও আদেশ সংরক্ষণ করার নিয়ম।
বরাতসূত্র (Reference) নির্দেশের ব্যাপারে দীর্ঘকালের জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয়, হতে পারে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ আদেশের পূর্ব দৃষ্টান্তবিষয়ক (Precedent) নথি। এসব নথিও স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া রয়েছে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ-সম্পর্কিত নথি। সব শেষে স্থায়ী নথিতে রয়েছে রাষ্ট্রীয় দলিলপত্র যেমন—সন্ধি, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি।
দুই. ‘খ’ শ্রেণীর নথিকে ১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার নিয়ম। একে অর্ধস্থায়ী নথি বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে সচিবালয় নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের সার্ভিস রেকর্ড, উন্নয়ন প্রকল্প, বাজেট, সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময় গঠিত কমিশন, কমিটির গুরুত্বপর্ণ প্রতিবেদন এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী আদেশসংক্রান্ত নথি। সচিবালয় নির্দেশিকায় এ সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে যে এসব নথি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগের রেকর্ডকৃত সূচিপত্রসহ তিন বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। সময় উত্তীর্ণ হলে সচিবালয়ের নথিপত্র সংরক্ষণাগারে (Record Room) পাঠাতে হবে।
তিন. ‘গ’ শ্রেণীর নথি, যা তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করার নির্দেশ রয়েছে। উদাহরণ হলো, ক্রয়-বিক্রয়, অস্থায়ী পদ সৃজন, কর্মকর্তার বদলি ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত নথি। নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে এসব নথি সংরক্ষণের সময় এক বছর। এগুলোকে নির্দেশিকায় মামুলি নথি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওপরে বর্ণিত সব নিয়মই সচিবালয়ের জন্য প্রযোজ্য। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে এ নিয়ম মেনে চলা হয় কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জনস্বার্থে সরকারের প্রকাশ করা ভালো হবে। স্থায়ী নথি সংরক্ষণের বিষয়ে নির্দেশিকায় কিছু ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব স্থায়ী শ্রেণীভুক্ত নথি সংরক্ষণের জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে অথবা অন্য উপায়ে অনুলিপি করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সচিবালয় সংরক্ষণাগারে অথবা আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরে মূল লিপির সঙ্গে কমপক্ষে তিনটি প্রতিলিপি ও সিডি জমা দিতে হবে। এগুলো আদৌ করা হয় কি না, তা অনুসন্ধান করলেই জানা সম্ভব।
কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বাস্তবায়নের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সময় কর্মরত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। সরকারের নির্দেশে বলা হয়েছিল, ফাঁসির সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলে নির্ধারিত দিন ও সময় উপস্থিত থাকতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ নির্দেশ মৌখিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে অবহিত করা হলে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন, এ নির্দেশ আইনসম্মত নয়। জেল কোডের বিধান অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত থাকার জন্য মনোনীত করবেন। টেলিফোনে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বাদানুবাদ হওয়ার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে দুটি প্রস্তাব করেন—এক, সামরিক ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ ক্যান্টনমেন্টে করতে হবে। কারণ, জেল কোড অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক আদালতের আদেশই পালন করার কথা। দুই, যদি জেল কোডের সংশ্লিষ্ট বিধান সংশোধন করা হয়, তাহলেও এ জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিই যথেষ্ট হবে।
সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং কৃত অপরাধের বিচারের জন্য বাহিনীভিত্তিক আইন রয়েছে। এসব আইনের অধীনে বিধিও বিদ্যমান। এসব আইন ও বিধিতে স্থায়ী রেকর্ড বা নথি সংরক্ষণের বিষয়ও হয়তো বা রয়েছে, যা অনেকেই জানে না। সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিতে সংশোধন বা সংযোজনের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোগটা কে নেবে? সংসদ, সরকার না সামরিক বাহিনী। জনশ্রুতি রয়েছে, সামরিক শাসনের অবসানের পরপরই অনেক নথিপত্র বিনষ্ট করা হয়। এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আদালত নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট বিচার-কার্যাবলির নথি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
পাকিস্তানে ১৯৫৮ সাল-পরবর্তী সময় সামরিক শাসনের বলে অনেক আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে লাহোর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি একটি মামলা নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছিলেন, এসব আদেশ বা নির্দেশ জারি করার সময় সংশ্লিষ্ট সামরিক আইন বা বিধি অনুসরণ করা হয়েছে কি না, সে বিষয়েও যে হাইকোর্টের এখতিয়ার রয়েছে, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে জানা নেই। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের আদেশের বিষয়েও একই যুক্তি প্রযোজ্য। প্রেক্ষাপট ভিন্নতর হলেও এর মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিষয়ে নথি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না?
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের কিছু বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বক্তব্য থেকে দেখা যায়, মন্ত্রণালয় জেল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এটা সঠিক হলেও বলা যায়, সামরিক ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট মামলার নথি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে থাকার কোনো নিয়ম নেই। এমনকি সংবিধানস্বীকৃত আদালতেরও এ ধরনের মামলার নথি জেলে কখনোই পাঠানো হয় না। সাধারণত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা আদালত থেকেই সংশ্লিষ্ট আদেশের বাস্তবায়ন করার জন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় জেল কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে প্রদত্ত রায়ের সত্যায়িত অনুলিপিও হয়তো বা পাঠানো হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনাল এসব নিয়ম পালন করতে বাধ্য কি না, তা সেনা আইন পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
জেল কোড অনুযায়ী জেল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দিন-তারিখ নির্ধারণ করে মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা (DeathÊWarrant) জারি করে। যত দূর জানা যায়, এর একটি যায় সংশ্লিষ্ট জেলায় দায়রা জজের দপ্তরে, অন্যটি যায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে। জেল কোড অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত থাকার জন্য মনোনীত করতে হয়। জেলের বাইরের যে কর্মকর্তার উপস্থিতির প্রয়োজন হয়, তিনি একজন সরকারি চিকিৎসক। সাধারণত সিভিল সার্জন বা তাঁর অধীন কোনো চিকিৎসক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা মহাপরিচালককে নথির বিষয়ে যে তথ্য দিতে বলা হয়েছে, সে তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা এখনো কেউ জানে না। হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাবে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য ছিল, প্রায় তিন দশক পর নথি পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষণ করা হয় সাধারণত অনধিক ১০ বছর। এ সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। সচিবালয় নির্দেশিকায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সচিবালয়ের নথির শ্রেণীবিন্যাসসহ সংরক্ষণের মেয়াদও নির্ধারিত রয়েছে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী চার ধরনের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়—এক. ‘ক’ শ্রেণীয় নথি। ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত নথির মধ্যে নীতি, আইন, বিধি ও প্রবিধানসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোচনা ও আদেশ সংরক্ষণ করার নিয়ম।
বরাতসূত্র (Reference) নির্দেশের ব্যাপারে দীর্ঘকালের জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয়, হতে পারে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ আদেশের পূর্ব দৃষ্টান্তবিষয়ক (Precedent) নথি। এসব নথিও স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া রয়েছে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ-সম্পর্কিত নথি। সব শেষে স্থায়ী নথিতে রয়েছে রাষ্ট্রীয় দলিলপত্র যেমন—সন্ধি, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি।
দুই. ‘খ’ শ্রেণীর নথিকে ১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার নিয়ম। একে অর্ধস্থায়ী নথি বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে সচিবালয় নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের সার্ভিস রেকর্ড, উন্নয়ন প্রকল্প, বাজেট, সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময় গঠিত কমিশন, কমিটির গুরুত্বপর্ণ প্রতিবেদন এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী আদেশসংক্রান্ত নথি। সচিবালয় নির্দেশিকায় এ সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে যে এসব নথি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগের রেকর্ডকৃত সূচিপত্রসহ তিন বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। সময় উত্তীর্ণ হলে সচিবালয়ের নথিপত্র সংরক্ষণাগারে (Record Room) পাঠাতে হবে।
তিন. ‘গ’ শ্রেণীর নথি, যা তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করার নির্দেশ রয়েছে। উদাহরণ হলো, ক্রয়-বিক্রয়, অস্থায়ী পদ সৃজন, কর্মকর্তার বদলি ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত নথি। নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে এসব নথি সংরক্ষণের সময় এক বছর। এগুলোকে নির্দেশিকায় মামুলি নথি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওপরে বর্ণিত সব নিয়মই সচিবালয়ের জন্য প্রযোজ্য। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে এ নিয়ম মেনে চলা হয় কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জনস্বার্থে সরকারের প্রকাশ করা ভালো হবে। স্থায়ী নথি সংরক্ষণের বিষয়ে নির্দেশিকায় কিছু ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব স্থায়ী শ্রেণীভুক্ত নথি সংরক্ষণের জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে অথবা অন্য উপায়ে অনুলিপি করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সচিবালয় সংরক্ষণাগারে অথবা আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরে মূল লিপির সঙ্গে কমপক্ষে তিনটি প্রতিলিপি ও সিডি জমা দিতে হবে। এগুলো আদৌ করা হয় কি না, তা অনুসন্ধান করলেই জানা সম্ভব।
কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বাস্তবায়নের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সময় কর্মরত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। সরকারের নির্দেশে বলা হয়েছিল, ফাঁসির সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলে নির্ধারিত দিন ও সময় উপস্থিত থাকতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ নির্দেশ মৌখিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে অবহিত করা হলে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন, এ নির্দেশ আইনসম্মত নয়। জেল কোডের বিধান অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত থাকার জন্য মনোনীত করবেন। টেলিফোনে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বাদানুবাদ হওয়ার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে দুটি প্রস্তাব করেন—এক, সামরিক ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ ক্যান্টনমেন্টে করতে হবে। কারণ, জেল কোড অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক আদালতের আদেশই পালন করার কথা। দুই, যদি জেল কোডের সংশ্লিষ্ট বিধান সংশোধন করা হয়, তাহলেও এ জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিই যথেষ্ট হবে।
সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং কৃত অপরাধের বিচারের জন্য বাহিনীভিত্তিক আইন রয়েছে। এসব আইনের অধীনে বিধিও বিদ্যমান। এসব আইন ও বিধিতে স্থায়ী রেকর্ড বা নথি সংরক্ষণের বিষয়ও হয়তো বা রয়েছে, যা অনেকেই জানে না। সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিতে সংশোধন বা সংযোজনের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোগটা কে নেবে? সংসদ, সরকার না সামরিক বাহিনী। জনশ্রুতি রয়েছে, সামরিক শাসনের অবসানের পরপরই অনেক নথিপত্র বিনষ্ট করা হয়। এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আদালত নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট বিচার-কার্যাবলির নথি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
No comments