বাজেট ২০১১-১২ বাস্তবায়ন-সরকার আরও দক্ষ হয়ে উঠুক

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ রূপকল্প ২০১১' ও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের আলোকে প্রণীত বলে অভিহিত করেছেন। তার বিবেচনায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক এবং তার পরিধি বিস্তৃত।


পূর্ববর্তী কয়েকটি বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির অনেক প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন করতে সরকারের ব্যর্থতার পরও তাই এ খাতে ৪৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হয়। কিন্তু শুল্ককর-ভ্যাট ও অন্যান্য সূত্রে আয়ের সীমাবদ্ধতা এবং উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারি প্রশাসনের যথাযথ দক্ষতা না থাকার প্রেক্ষাপটে এ বাজেটের বাস্তবায়ন গুরুতর চ্যালেঞ্জ বলেই ধারণা করা হয়। বাজেট পেশের পরদিন শুক্রবার অর্থমন্ত্রী প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনে আগামী অর্থবছরটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে অভিহিত এবং তা মোকাবেলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির বিবেচনায় মূল ঝুঁকি হচ্ছে অর্থায়ন, বৈদেশিক ঋণ, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির পরিস্থিতিও আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ। অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যেও সাম্প্রতিক অস্থিরতা জনশক্তির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দেশের শ্রমবাজারেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার কথা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে জোর কদমে এগিয়ে যেতে হলে এসব ঝুঁকি মোকাবেলা করতেই হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরকারের আরও দক্ষ হয়ে ওঠার বিষয়টি। আগামী দেড় বছরের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন পাঁচ হাজার মেগাওয়াট করার মতো মাইলফলক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো যেন নিছক কথার কথা হয়ে না থাকে সে জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতেই হবে। অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, সরকার বেশকিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। আমাদের প্রত্যাশা যে, জাতীয় সংসদে এ বাজেট নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং সংসদের ভেতরে ও বাইরের সূত্রে যেসব সুপারিশ এবং পরামর্শ মিলবে তা আমলে নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। অর্থমন্ত্রী ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলেছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি_ উভয় খাতেই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই মনে করছে, ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও কীভাবে তা অর্জিত হবে সেটি স্পষ্ট করা নেই। বিপুল ঘাটতির কারণে সরকারকে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে এবং এ কারণে বেসরকারি খাতের শিল্প-বাণিজ্যের উদ্যোগে ঋণপ্রাপ্তি সমস্যায় পড়তে পারে। প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে বেসরকারি খাত। তাদের প্রণোদনার দিকটিও ভাবতে হবে। কৃষি এবং তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাত। আগামী বছরের বাজেটে এ দুটি খাত যথাযথ বিবেচনা পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় সংসদ সদস্যরা বাজেট আলোচনায় এসব ইস্যু নিষ্পত্তি করবেন বলে আমরা আশা করব। বিশেষভাবে বিবেচ্য হতে হবে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প খাত। একই সঙ্গে বিবেচনায় রাখা চাই আমজনতাকে সন্তুষ্ট রাখার বিষয়টি। মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দুরূহ চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে। বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্য ও জ্বালানি তেলসহ অনেক পণ্যের মূল্য অতিশয় চড়া এবং এক্ষেত্রে দাম কমতে পারে বলে কোনো পূর্বাভাস নেই। তবে সরকার যা পারে তা হচ্ছে দেশের মধ্যে যেসব পণ্য ও সেবা উৎপাদন হয় তার ব্যয় কমিয়ে রাখার চেষ্টা করা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সুবিধার অব্যাহত জোগানের কাজে সরকার অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানেও সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সুশাসনের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি যথাযথ বাস্তবায়ন করা গেলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। এক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা গুরুত্বপূর্ণ। হতদরিদ্রদের জন্য নির্ধারিত সুবিধায় ভাগ বসাতে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের অপতৎপরতা সুবিদিত। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নেও একই সমস্যা প্রকট। এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল তা মোকাবেলায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে তা থেকে রেহাই মিলবে বলেও মনে হয় না। এ ধরনের সমস্যার কারণে সরকারের প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তার সুযোগ গ্রহণ করে। তবুও তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বেশকিছু ইস্যুতে বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধী দল রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করার জন্য সচেষ্ট রয়েছে। তারা সংসদ বর্জন করে চলেছে এবং সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার পথে চলবে বলেও মনে হচ্ছে না। সংবিধান সংশোধন ও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যেতে থাকলে এ বিরোধিতা জোরদার হবে বলে ধারণা করা যায়। এ পরিস্থিতি মোকাবেলাও সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রধান বিরোধী দলকে সংসদে নিয়ে আসতে পারলে সরকারের জন্য পরিস্থিতি তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়। এ জন্য সহনশীলতার পাশাপাশি সমঝোতার মনোভাবও প্রদর্শন করতে হবে। বিরোধীদের সংসদে নিয়ে আসতে সরকার যে আন্তরিক তারও প্রমাণ থাকা চাই। এভাবে যৌথ উদ্যোগে মোকাবেলা হতে পারে দেশ-বিদেশের গুরুতর চ্যালেঞ্জ। জনগণের প্রত্যাশাও অভিন্ন। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার মূল্য আমাদের বারবার দিতে হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তি অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে সব কিছুর ওপরে থাকা চাই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা। সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনে এর কোনো বিকল্প নেই।
 

No comments

Powered by Blogger.