শেকড়ের ডাক-আমাদের পাটশিল্প ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র by ফরহাদ মাহমুদ
পাটকে একসময় বলা হতো বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। সেই সোনালি আঁশের গৌরব অনেক আগেই ম্লান হয়ে গেছে। অথবা বলা যায়, ম্লান করে দেওয়া হয়েছে। প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে খ্যাত নারায়ণগঞ্জের সেই জৌলুশ নেই। পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মুখে এ দেশের পাটশিল্প প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।
অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ৭৭টি পাটকলকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল, সেখানে এখন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। আদমজীসহ বড় পাটকলগুলোর প্রায় সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই পাকিস্তানপন্থী সামরিক শাসন। আর তখন থেকে পাটশিল্প তথা রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানার বিরুদ্ধে শুরু হয় পরিকল্পিত এই ষড়যন্ত্র। একদিকে চলে শ্রমিক ছাঁটাই, অন্যদিকে রাজনৈতিক বা দলীয় নিয়োগের মাধ্যমে তৈরি করা হয় মাথাভারী প্রশাসন। একই সঙ্গে চলতে থাকে মাথাভারী প্রশাসনের সীমাহীন দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে মিলগুলো ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকে। পরে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে মিলগুলো বন্ধ ও ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। এভাবে '৮২ সালের মধ্যে ৩১টি জুট মিল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের আমলে নতুন শিল্পনীতির আওতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬৫০টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, এর মধ্যে জুট মিল ছিল ২৭টি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিএনপি সরকারের আমলেও ছয়টি জুট মিল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, এর আগে বিক্রি করা ২৯টি পাটকলের মূল্য ছিল ২৪৫ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু সেগুলো বিক্রি করা হয়েছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি টাকায়। রাষ্ট্রীয় সম্পদের এমন অপব্যবহার, এমন লুটপাট পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই।
পাটশিল্প বা রাষ্ট্রায়ত্ত খাত নিয়ে প্রধান খেলাটি খেলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলো। তারা উন্নত দেশগুলো তথা প্রথম বিশ্বের করপোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতগুলো ধ্বংসের অপচেষ্টা চালাতে থাকে। তাদেরই পরামর্শে তথাকথিত বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় শুধু যে এ দেশের পাটশিল্প ধ্বংস হয়েছে তা নয়, অন্যান্য শিল্প খাত এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়েছে। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। সেসব দরিদ্র শ্রমিক পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। অথচ এ দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য দাতা সংস্থাগুলো এবং তাদের এ দেশীয় এজেন্টদের মায়াকান্না ও কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণের অন্ত নেই। করপোরেট পুঁজি এ দেশে যা ইচ্ছা করতে পারে। কারণ আমাদের সরকারগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। কোনো সরকার কথা না শুনলে তারা সরকারও পরিবর্তন করতে পারে। এটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারই হোক, আর সামরিক পোশাকের আড়ালে কোনো স্বৈরশাসকই হোক। আর তাদের এ কাজে বরাবর সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এ দেশেরই কিছু বুদ্ধিমান মানুষ, যারা নিজেদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। তাঁরা করপোরেট পুঁজি বা বেনিয়া পুঁজির অর্থে নানা ধরনের দোকান তথা এনজিও, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খুলে প্রচুর পয়সার মালিক হয়েছেন এবং সমাজে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই সত্য। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাঁরাই ছিলেন আসল ক্ষমতাধর। প্রভুদের চাহিদা অনুযায়ী তখনো চারটি পাটকল বন্ধ এবং ১৮টি পাটকল থেকে আট হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় খুলনায় বিভিন্ন সংগঠন লঙ্গরখানা খুলে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনকে কিছুদিন ভরণপোষণ করেছিল। কারণ, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে না দেওয়ায় তাঁরা মিল এলাকা ছেড়ে যেতেও পারছিলেন না।
সম্প্রতি আমাদের বিজ্ঞানীরা পাটের জেনোম আবিষ্কার করেছেন। উন্নত জাত উদ্ভাবনে তাঁরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববাজারে পড়ে যাওয়া পাটপণ্যের চাহিদা ৫০০ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবই আমাদের জন্য সুখবর। বর্তমান সরকার পাটশিল্পের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পাটসহ কৃষি গবেষণার প্রসার ঘটাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই আমরা আবার পাটকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ মার্চ খুলনায় খালিশপুর জুট মিলের কার্যক্রম নতুন করে উদ্বোধন করেছেন। মিলটির আগের নাম ছিল পিপলস জুট মিল। বিগত জোট সরকারের আমলে আদমজীসহ যে পাঁচটি জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এটি ছিল তার মধ্যে একটি। সে সময় এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আরো সাতটি পাটকল দ্রুত চালু করা হবে। তিনি জানান, এরই মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের জন্য এক হাজার ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া কারখানাগুলোর তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করা হয়েছে। এগুলো সবই আমাদের সোনালি আঁশকে নিয়ে যাঁরা স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের জন্য সুখবর। তাই পাটশিল্পের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে বর্তমান সরকারের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
কিন্তু বন্ধ পাটকল নতুন করে চালু করলেই কেবল পাটশিল্পের শেষরক্ষা হবে কি? এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করার অনেক কারণ আছে। বেনিয়া পুঁজির স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে এ সরকার তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে কি না সে ক্ষেত্রেই সন্দেহ আছে। দ্বিতীয়ত, মুখে যা-ই বলা হোক না কেন, এখনো অনেক ক্ষেত্রেই নির্লজ্জ দলীয়করণের দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। সে ক্ষেত্রে পাটকলগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে কি? তৃতীয়ত, এ দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এখনো একটি বড় সমস্যা নীতিজ্ঞানবর্জিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন। দলীয় ব্যানারে শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের নামে রীতিমতো লুটপাট চলে। বর্তমান সরকার এগুলোকে শক্ত হাতে দমন করতে পারবে কি? তা না হলে ঘটা করে বন্ধ হওয়া মিল চালু করা অর্থহীন হবে।
মাথা কেটে ফেলা যেমন মাথাব্যথার সমাধান নয়, তেমনি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া বা শ্রমিক ছাঁটাই করা পাটশিল্পকে রক্ষা বা উন্নয়নের কোনো পথ হতে পারে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাটকলগুলো নিয়মিতভাবে লাভ করছে। আগে যেখানে আমাদের দেশের পাট না পেলে তাদের মিলগুলো বন্ধ হয়ে যেত, সেখানে এখন তারা আমাদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি পাট উৎপাদন করে। এর একটি কারণ বেনিয়াতন্ত্রের নির্দেশে নয়, দেশের স্বার্থে সে দেশের সরকার পাটশিল্পকে পরিচালনা করে। তাদের পাটশিল্প যদি উত্তরোত্তর এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের পাটশিল্প কেন লোকসান দেবে? আমাদের পাটশিল্পকে রক্ষা করতে হলে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমাদের জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। অতীতে আমরা দেখেছি, আমাদের পাটকলগুলো মৌসুমে চাষিদের কাছ থেকে পাট না কিনে পরে বেশি দামে ফড়িয়াদের কাছ থেকে পাট কেনে। এতে চাষিরা যেমন ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন, তেমনি পাটকলগুলো লোকসানের মুখোমুখি হয়। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের আমলাদেরও বিশেষ ভূমিকা আছে। অভিযোগ আছে, বিশেষ কারণেই তাঁরা ফড়িয়াদের স্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী হয়ে থাকেন। পাটকলগুলোর জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, কর্মসময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদন নির্বিঘ্ন না করা গেলে পাটকলগুলো লাভের মুখ দেখবে না। অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয় যথাসম্ভব কমাতে হবে।
আরেকটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতে এখনো পাটশিল্পে যথেষ্ট পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়া হয়। পাকিস্তানেও তাই। কাজেই আমাদের পাটশিল্পে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হবে না, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। পাট আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পরিচিতির অংশ। এখনো এ দেশের সিংহভাগ লোক পাট উৎপাদন, বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত। পরিবেশগত বিবেচনায়ও সারা দুনিয়ায় পাট নতুনভাবে সমাদৃত হচ্ছে। কাজেই এই পাটশিল্পের উন্নয়নে আমরা পিছিয়ে থাকব, তা হয় না।
লেখক : সাংবাদিক
পাটশিল্প বা রাষ্ট্রায়ত্ত খাত নিয়ে প্রধান খেলাটি খেলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলো। তারা উন্নত দেশগুলো তথা প্রথম বিশ্বের করপোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতগুলো ধ্বংসের অপচেষ্টা চালাতে থাকে। তাদেরই পরামর্শে তথাকথিত বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় শুধু যে এ দেশের পাটশিল্প ধ্বংস হয়েছে তা নয়, অন্যান্য শিল্প খাত এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়েছে। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। সেসব দরিদ্র শ্রমিক পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। অথচ এ দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য দাতা সংস্থাগুলো এবং তাদের এ দেশীয় এজেন্টদের মায়াকান্না ও কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণের অন্ত নেই। করপোরেট পুঁজি এ দেশে যা ইচ্ছা করতে পারে। কারণ আমাদের সরকারগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। কোনো সরকার কথা না শুনলে তারা সরকারও পরিবর্তন করতে পারে। এটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারই হোক, আর সামরিক পোশাকের আড়ালে কোনো স্বৈরশাসকই হোক। আর তাদের এ কাজে বরাবর সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এ দেশেরই কিছু বুদ্ধিমান মানুষ, যারা নিজেদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। তাঁরা করপোরেট পুঁজি বা বেনিয়া পুঁজির অর্থে নানা ধরনের দোকান তথা এনজিও, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খুলে প্রচুর পয়সার মালিক হয়েছেন এবং সমাজে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই সত্য। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাঁরাই ছিলেন আসল ক্ষমতাধর। প্রভুদের চাহিদা অনুযায়ী তখনো চারটি পাটকল বন্ধ এবং ১৮টি পাটকল থেকে আট হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় খুলনায় বিভিন্ন সংগঠন লঙ্গরখানা খুলে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনকে কিছুদিন ভরণপোষণ করেছিল। কারণ, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে না দেওয়ায় তাঁরা মিল এলাকা ছেড়ে যেতেও পারছিলেন না।
সম্প্রতি আমাদের বিজ্ঞানীরা পাটের জেনোম আবিষ্কার করেছেন। উন্নত জাত উদ্ভাবনে তাঁরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববাজারে পড়ে যাওয়া পাটপণ্যের চাহিদা ৫০০ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবই আমাদের জন্য সুখবর। বর্তমান সরকার পাটশিল্পের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পাটসহ কৃষি গবেষণার প্রসার ঘটাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই আমরা আবার পাটকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ মার্চ খুলনায় খালিশপুর জুট মিলের কার্যক্রম নতুন করে উদ্বোধন করেছেন। মিলটির আগের নাম ছিল পিপলস জুট মিল। বিগত জোট সরকারের আমলে আদমজীসহ যে পাঁচটি জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এটি ছিল তার মধ্যে একটি। সে সময় এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আরো সাতটি পাটকল দ্রুত চালু করা হবে। তিনি জানান, এরই মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের জন্য এক হাজার ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া কারখানাগুলোর তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করা হয়েছে। এগুলো সবই আমাদের সোনালি আঁশকে নিয়ে যাঁরা স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের জন্য সুখবর। তাই পাটশিল্পের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে বর্তমান সরকারের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
কিন্তু বন্ধ পাটকল নতুন করে চালু করলেই কেবল পাটশিল্পের শেষরক্ষা হবে কি? এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করার অনেক কারণ আছে। বেনিয়া পুঁজির স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে এ সরকার তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে কি না সে ক্ষেত্রেই সন্দেহ আছে। দ্বিতীয়ত, মুখে যা-ই বলা হোক না কেন, এখনো অনেক ক্ষেত্রেই নির্লজ্জ দলীয়করণের দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। সে ক্ষেত্রে পাটকলগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে কি? তৃতীয়ত, এ দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এখনো একটি বড় সমস্যা নীতিজ্ঞানবর্জিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন। দলীয় ব্যানারে শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের নামে রীতিমতো লুটপাট চলে। বর্তমান সরকার এগুলোকে শক্ত হাতে দমন করতে পারবে কি? তা না হলে ঘটা করে বন্ধ হওয়া মিল চালু করা অর্থহীন হবে।
মাথা কেটে ফেলা যেমন মাথাব্যথার সমাধান নয়, তেমনি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া বা শ্রমিক ছাঁটাই করা পাটশিল্পকে রক্ষা বা উন্নয়নের কোনো পথ হতে পারে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাটকলগুলো নিয়মিতভাবে লাভ করছে। আগে যেখানে আমাদের দেশের পাট না পেলে তাদের মিলগুলো বন্ধ হয়ে যেত, সেখানে এখন তারা আমাদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি পাট উৎপাদন করে। এর একটি কারণ বেনিয়াতন্ত্রের নির্দেশে নয়, দেশের স্বার্থে সে দেশের সরকার পাটশিল্পকে পরিচালনা করে। তাদের পাটশিল্প যদি উত্তরোত্তর এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের পাটশিল্প কেন লোকসান দেবে? আমাদের পাটশিল্পকে রক্ষা করতে হলে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমাদের জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। অতীতে আমরা দেখেছি, আমাদের পাটকলগুলো মৌসুমে চাষিদের কাছ থেকে পাট না কিনে পরে বেশি দামে ফড়িয়াদের কাছ থেকে পাট কেনে। এতে চাষিরা যেমন ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন, তেমনি পাটকলগুলো লোকসানের মুখোমুখি হয়। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের আমলাদেরও বিশেষ ভূমিকা আছে। অভিযোগ আছে, বিশেষ কারণেই তাঁরা ফড়িয়াদের স্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী হয়ে থাকেন। পাটকলগুলোর জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, কর্মসময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদন নির্বিঘ্ন না করা গেলে পাটকলগুলো লাভের মুখ দেখবে না। অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয় যথাসম্ভব কমাতে হবে।
আরেকটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতে এখনো পাটশিল্পে যথেষ্ট পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়া হয়। পাকিস্তানেও তাই। কাজেই আমাদের পাটশিল্পে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হবে না, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। পাট আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পরিচিতির অংশ। এখনো এ দেশের সিংহভাগ লোক পাট উৎপাদন, বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত। পরিবেশগত বিবেচনায়ও সারা দুনিয়ায় পাট নতুনভাবে সমাদৃত হচ্ছে। কাজেই এই পাটশিল্পের উন্নয়নে আমরা পিছিয়ে থাকব, তা হয় না।
লেখক : সাংবাদিক
No comments