অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? by রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ

আমরা কি আবার অসহিষ্ণু, অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ফিরে যাচ্ছি? প্রশ্নটা জেগেছে চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচার বন্ধ নিয়ে। একটা সময় ছিল, যখন নানা কালাকানুনের ব্যবহার করে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হতো। আমরা অনেক সংগ্রাম করে এসব ড্রাকুনিয়ান আইনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।


এখন সংবাদপত্র বন্ধ করার কোনো আইন নেই। এদিক থেকে আমরা স্বস্তিতেই আছি বলতে হবে।
কিন্তু নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে চ্যানেল বন্ধ নিয়ে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ইটিভি ও সিএসবি বন্ধ করা হয়। যমুনা টিভির পরীক্ষামূলক সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব চ্যানেলের সম্প্র্রচার বন্ধ করার জন্য নানা অজুহাত তৈরি করা হয়। কখনো আদালতের আশ্রয় নেওয়া হয়, আবার কখনো নিয়ম ভঙ্গের শাস্তি হিসেবে সম্প্রচার বন্ধ করা হয়।
যেভাবেই বন্ধ করা হোক, উদ্দেশ্য কিন্তু এক। সরকার ভিন্ন, লক্ষ্য অভিন্ন–তা হলো সমালোচনা সহ্য করা হবে না। সরকার যখন কোনো গণমাধ্যম–তা সংবাদপত্র হোক আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া হোক, বন্ধ করে দেয়, তখন দেশে-বিদেশে সে সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কিন্তু সরকারি আমলা আর রাজনৈতিক তোষামোদকারীরা নেতৃত্বকে তা বুঝতে দেন না। তাঁরা যুক্তি দেখান, সরকার মিডিয়াবান্ধব। কিন্তু আইন ভঙ্গকারীর শাস্তি পেতে হবে। তাই বিটিআরসি, মানি লন্ডারিং, অনিয়মিত অনুমতিপত্র—এসব অজুহাতে সম্প্রচার বন্ধ করা হয়। এসব যুক্তি কিন্তু ধোপে টেকে না। তাই তো চ্যানেল বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে-বিদেশে হইচই পড়ে যায়। মূল্য দিতে হয় ক্ষমতাসীন দল আর নেতৃত্বকে। এ কথাটা আশা করি সরকারপ্রধান একবার ভেবে দেখবেন। একটি চ্যানেল বন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হবে? ইটিভি বন্ধে যাঁরা আনন্দিত হয়েছিলেন, তাঁদের কি শেষরক্ষা হয়েছে? হয়নি। এ কথাটা আশা করি সবাই ভেবে দেখবেন।
একটা চ্যানেল যখন বন্ধ হয়, অন্য চ্যানেলের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়। এটা পরোক্ষ সেন্সরশিপ। বর্তমানে আমাদের চ্যানেলগুলোতে তা-ই হচ্ছে।
চ্যানেল ওয়ান বন্ধ হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ৪০০ সাংবাদিক-কর্মচারী বেকার। এর আগে ইটিভিতেও একই ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিকেরা দিনের পর দিন বেকার জীবন যাপন করেন এবং রাস্তায় মিছিল আর মানববন্ধন করে তাঁদের কথা জানান। তাঁদের এ অবস্থা স্বাধীন সাংবাদিকতার সহায়ক নয়।
তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও গণতন্ত্র দুর্বল করার লোকের অভাব নেই। এর অবসান দরকার। প্রশাসনের বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্ত থেকে বাঁচতে হলে আইন আর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। ফলে কে চ্যানেলের অনুমতি পাবেন, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর। সব সরকারের আমলে তাদের পছন্দের লোকদের চ্যানেল আর রেডিও খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। তারা মনে করেন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকলেই সুবিধা। কিন্তু এ কথা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। অনেক সুবিধাবাদী অনুমতিপত্র ভিন্নমতের লোকের কাছে বিক্রিও করে দিয়েছেন। যা ছিল আদর্শ আর নীতি, নীতিমালার অভাবে তা হয়েছে ব্যবসা।
সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল। আমরা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিজয়ের পর এ অবস্থার পরিবর্তন করতে পেরেছি। এখন একটা নিয়মের মধ্যে আইনের আওতায় সংবাদপত্র প্রকাশ করতে রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই অনুমতি পাওয়া সম্ভব। প্রশাসন যদি অনুমতি না দেয়, তবে প্রেস কাউন্সিলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে কি এ ধরনের নিয়ম চালু করা যায় না?
প্রশাসনের একক সিদ্ধান্ত থেকে রক্ষা পেতে বেতার টিভি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে একটা নীতিমালা বা আইন দরকার। সংবাদপত্র প্রকাশের নিয়ম অনুসরণ করে চ্যানেলের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সংবাদপত্র যেহেতু বন্ধ করার আইন নেই এবং সংবাদপত্র প্রকাশের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্নও নেই। ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই, রাজনৈতিক বিবেচনায় চ্যানেলের অনুমতি দেওয়া হয়। এটা স্বৈরাচারী নিয়ম। এ নিয়ম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অচল। তাই গণতন্ত্রসম্মতভাবে সবার অধিকার নিশ্চিত হয়, এমন বিধান থাকা বাঞ্ছনীয়। তাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
তবে এখানে একটা কথা না বললেই নয়। আমাদের অনেক আইন আছে, নীতিমালারও অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয় না। কার্যকর না হওয়ার আসল কারণ মনস্তাত্ত্বিক। আমরা যত দিন চিন্তায়, ভাবনায়, মননে, আচরণে গণতান্ত্রিক না হতে পারব, কোনো আইনই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারবে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য। মিডিয়ার স্বাধীনতা মানে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা। সমালোচনা সহ্য করার শক্তিই হলো পরমতসহিষ্ণুতা, যা গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।
কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এ কথা সত্য, যাঁরাই ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা সমালোচনা সহ্য করতে চান না। কিন্তু সমালোচকই প্রকৃত বন্ধু, তা সর্বজনবিদিত। সমালোচকেরাই সরকারের প্রশাসনের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন। ধৈর্যের সঙ্গে যাঁরা তা অনুধাবন করতে পারেন, তাঁরাই সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেন। ইতিহাসে তাঁরা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। আর যাঁরা অধৈর্য হন, সমালোচনার জন্য অসহিষ্ণু আচরণ করেন, তাঁদের স্থান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তাঁরা স্বৈরাচারী। আমরা আশা করি, যাঁরা সরকারকে ভুল বুঝিয়ে ভিন্নমতের চ্যানেল বন্ধ করতে বলেন, তাঁরাই ঠিক করবেন ইতিহাসের কোন জায়গায় অবস্থান করতে চান।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: সম্পাদক, দ্য নিউজ টুডে।

No comments

Powered by Blogger.