আমরা কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছতে পারিনি এখনো by এমাজউদ্দীন আহমদ
তত্ত্বকথা বলতে চাই না। তার পরও বলব, গণতন্ত্র এক ধরনের ব্যবস্থা। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক সমাজব্যবস্থা। এক ধরনের সিস্টেম। সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র সবার জীবনকে স্পর্শ করে। সবার জন্য রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ। সমস্বার্থের মোহনায় সবাইকে করে সম্মিলিত। সমস্বার্থের সুষম বন্ধনে সবাইকে করে সংগ্রথিত।
সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের উপত্যকায় সবাইকে করে সংগঠিত। এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘুও। অন্যদিক থেকে গণতন্ত্র এক প্রক্রিয়াও বটে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি স্বীকৃত হয় স্বতন্ত্র অনন্য, এককরূপে। কারো ওপর নির্ভরশীল সে নয়। নয় কারো মুখাপেক্ষী। আপন মহিমায় সবাই ভাস্বর। তার সম্মতি ছাড়া তাকে শাসন করার কারো অধিকার নেই। তার সম্মতি ছাড়া তার ওপর কর ধার্য করার ক্ষমতা নেই কারো। তা ছাড়া, যেকোনো নীতিনির্ধারণে এই প্রক্রিয়ায় সর্বাধিকসংখ্যক ব্যক্তির ইচ্ছা হয় প্রতিফলিত। সবার সম্মতি নিয়েই সমাজব্যবস্থা হয় পরিচালিত। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু তাই একত্রে কাজ করে।
আর এক দিক থেকে বলা যায়, গণতন্ত্র এক ধরনের নৈতিকতা। পরিশীলিত এক কর্মপ্রবাহ। রুচিকর এক যৌথ উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন ও সচেতন এক পদক্ষেপ। গোপনীয়তার জমাটবাঁধা অন্ধকার ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের সূচনা হয় সর্বসাধারণের সমক্ষে, মুক্ত আলোয়। ষড়যন্ত্রের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে আসে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড। বেরিয়ে আসে প্রকাশ্য দিবালোকে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয় বলে সম-মানসিকতা প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে। অন্যের দিকে তাকিয়ে সবাই নির্ধারণ করে নিজেদের পদক্ষেপ। সংযত করে রসনা। নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের আচার-আচরণ। আমার জন্য যা পীড়াদায়ক অন্যের কাছে তা সুখকর হতে পারে না। আমি যা খুশি, অন্যেরও তা প্রাপ্য। যে কথা শুনে আমি কষ্ট পাই, অন্যের কাছেও তা কষ্টকর হবে। এই সত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির চর্চা ব্যতীত গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের কৌশল রুচিসম্মত। তার চর্চা হয় অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে। নীরবে নয়, তারস্বরে। নির্জনে নয়, জনারণ্যে। সুতরাং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র হলো উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি। সুরুচির প্রতীক। স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতিচ্ছবি। সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের নিশ্চিত নীড়। প্রক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র হলো সহযোগিতার সূত্র। আস্থা ও বিশ্বাসের অন্তরঙ্গ সুর। সমঝোতার ক্ষেত্র। মুক্তবুদ্ধির বিস্তীর্ণ অঙ্গন। এদিক থেকে গণতন্ত্র যেমন উপায়, তেমনি উপেয়। সমাজজীবনের যেমন লক্ষ্য, তেমনি মাধ্যমও। গন্তব্য ও পথ দুই-ই।
সফল গণতন্ত্রের কয়েকটি অঙ্গীকার রয়েছে। এক. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা জনগণের ক্ষমতা। সরকার আমানত হিসেবে সেই ক্ষমতা ধারণ করে। প্রয়োগ করে রাজনৈতিক সমাজের অনুমোদিত পন্থায়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে অথবা সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত পন্থা অনুসরণে ব্যর্থ হলে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। গণতান্ত্রিক এই সত্য স্বীকৃত হতে হবে। দুই. গণতন্ত্রে ব্যক্তি-প্রাধান্যের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের প্রাধান্য। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের রাজত্ব।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন সর্বজনীন। আইনের প্রতি আনুগত্য কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, তা তিনি যতই প্রভাবশালী হোন না কেন অথবা যত উঁচু পদে অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আরো একটি অঙ্গীকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন মেনে চলতে হবে, যদিও তা খারাপ আইন হয়ে থাকে। আইন প্রণয়ন করেন জনপ্রতিনিধিরা। আইন পরিবর্তনও করেন তারা। গণতন্ত্রে সবাই আইন মেনে চলে। মন্দ আইন হলে তা পরিবর্তিত হয় কিন্তু যত দিন তা পরিবর্তিত না হচ্ছে তত দিন তা মানতেই হবে। তিন. গণতন্ত্রের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে জোরের যুক্তির পরিবর্তে যুক্তির জোর কার্যকর হয়। সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় সমঝোতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে।
সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য যেমন প্রয়োজন গণতান্ত্রিক কাঠামো, তেমনি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মন। প্রয়োজন কাঠামোর সর্বস্তরের স্পন্দিত অন্তঃকরণ। কাঠামোকে সিক্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক চেতনার ঘন আস্তরণ। গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে দুই-ই অপরিহার্য। কাঠামো সৃষ্টি করে নৈতিক এক পরিমণ্ডল। রচনা করে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রাথমিক পর্যায়।
কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গণতান্ত্রিক মনের প্রসার ঘটানো, গণতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রাণোচ্ছল করার চূড়ান্ত পর্ব। চূড়ান্ত পর্বে গণতান্ত্রিক সমাজের সূচনা হয়। সমাজজীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর নেই।
গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হয় না এক বছরে। হয় না এক যুগেও। যুগ যুগ ধরে জলধারায় সঞ্চিত পলি যেমন গড়ে তোলে স্বর্ণদ্বীপ, গণতান্ত্রিক সমাজও গড়ে ওঠে যুগ যুগ ধরে অর্জিত সাফল্যে ও গণতন্ত্র চর্চার উজ্জ্বল ঐতিহ্যে সহযোগিতা ও মিলনের গৌরবময় কর্মকাণ্ডে। গণতান্ত্রিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের যে চারটি আজ রোপিত হলো তা ফুলে ফলে ভরে উঠবে বহু দিন পরে, যদি তা হৃদয়বান এক মালির সেবা লাভ করে। মালি তার মনের সবটুকু রঙ মিলিয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। আশপাশে থেকে আগাছা দূর করবে। গাছটির অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে দেবে এবং সুনির্দিষ্ট উচ্চতার জন্য অধীর আগ্রহে দিন গুনবে। ফুলে-ফলে গাছটি হেসে উঠলে মালি বিজয়ীর হাসি হাসবে। তবে মালির বিজয় কতটুকু হলো তা বড় কথা নয়, বড় কথা_এটি একটি সামাজিক অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠা। একটি গৌরবময় সামাজিক সৃষ্টি। তার ফুলে-ফলে সৌরভ। ফলে ফলে সেবার সামগ্রী। ডালপালার ছায়ায় সবার প্রশান্তি। সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এভাবেই নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা কেমন? অন্তহীন প্রশ্ন। তবে অবস্থা ভালো নয়।
এ জন্য দায়ী অসুস্থ রাজনীতি। গণতন্ত্রকে গতিশীল করতে হলে রাজনীতিকে কল্যাণমুখী করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। প্রয়োজন রাজনীতিকে ক্ষমতার-রাজনীতির পুঁতিগন্ধময় গহ্বর থেকে উদ্ধার করা। প্রয়োজন ব্যক্তি-প্রাধান্যের নিগড় থেকে মুক্ত করে আইনের রাজত্বে ফিরিয়ে আনা। রাজনীতি একবার তার সনাতন বিশুদ্ধ রূপ ফিরে পেলে আজকে সমাজজীবন যে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে অহর্নিশ ছটফট করছে, তা থেকে অব্যাহতি পাবে। সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্তি লাভ করবে। সংঘাতময় পরিবেশের অবসান ঘটবে। শুচিতা ফিরে আসবে। যুক্তিবুদ্ধির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। জনগণ আবারও হয়ে উঠবে শাসন-প্রশাসনের প্রধান নিয়ামক।
এ অবস্থা আপনাআপনি আসবে না। এ জন্য প্রয়োজন সচেতন উদ্যোগ। সমাজের বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী-জ্ঞানী-গুণী ও সচেতন উদ্যোগ। এ উদ্যোগ দুই খাতে প্রবাহিত হতে হবে। এক. রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন সাধনে উদ্যোগী হতে হবে। দুই. যাঁরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন তাঁদের ওরিয়েনটেশন বা মনমানসিকতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো রচিত হয়েছে বটে, কিন্তু সেই কাঠামোয় বিরোধী দলগুলোর সম্পৃক্ততার তেমন সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি। উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেই শূন্যস্থান পূরণ করে আমাদের দেশে বিধিবিধানের মাধ্যমে তা সম্পূর্ণ করতে হবে। জাতীয় সংসদ কার্যকর হচ্ছে না। বিরোধী দলের সদস্যরা কথা বলার তেমন সুযোগ পান না। অধিকাংশ সময় তারা উপেক্ষিত হন। এ অভিযোগ যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তা-ও নয়।
ক্ষমতার বিষক্রিয়া রয়েছে এবং চূড়ান্ত ক্ষমতার বিষক্রিয়া মারাত্মক। লর্ড অ্যাকটন বলেছেন, গণতন্ত্র কিন্তু সীমিত ক্ষমতার এক ব্যবস্থা। একদিকে জনগণের অধিকার, অন্যদিকে জনগণের কাছে সরকারের দায়িত্বশীলতা এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিরোধী দলগুলোর ওয়াচডগ ভূমিকা_সব মিলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসে। এ দেশে কিন্তু সরকার হলো সর্বক্ষেত্রে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। পরম পরাক্রমশালী শক্তিধর। এর কারণ বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো চেক। নেই কোনো ব্যালান্স।
এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। তা না হলে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দেওয়া যাবে না। এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য অনেক রক্ত ঝরিয়েছে, তবুও আমরা কাঙ্ক্ষিত স্তরে এখনো পেঁৗছতে পারিনি।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্র্রবিজ্ঞানী
আর এক দিক থেকে বলা যায়, গণতন্ত্র এক ধরনের নৈতিকতা। পরিশীলিত এক কর্মপ্রবাহ। রুচিকর এক যৌথ উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন ও সচেতন এক পদক্ষেপ। গোপনীয়তার জমাটবাঁধা অন্ধকার ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের সূচনা হয় সর্বসাধারণের সমক্ষে, মুক্ত আলোয়। ষড়যন্ত্রের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে আসে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড। বেরিয়ে আসে প্রকাশ্য দিবালোকে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয় বলে সম-মানসিকতা প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে। অন্যের দিকে তাকিয়ে সবাই নির্ধারণ করে নিজেদের পদক্ষেপ। সংযত করে রসনা। নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের আচার-আচরণ। আমার জন্য যা পীড়াদায়ক অন্যের কাছে তা সুখকর হতে পারে না। আমি যা খুশি, অন্যেরও তা প্রাপ্য। যে কথা শুনে আমি কষ্ট পাই, অন্যের কাছেও তা কষ্টকর হবে। এই সত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির চর্চা ব্যতীত গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের কৌশল রুচিসম্মত। তার চর্চা হয় অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে। নীরবে নয়, তারস্বরে। নির্জনে নয়, জনারণ্যে। সুতরাং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র হলো উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি। সুরুচির প্রতীক। স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতিচ্ছবি। সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের নিশ্চিত নীড়। প্রক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র হলো সহযোগিতার সূত্র। আস্থা ও বিশ্বাসের অন্তরঙ্গ সুর। সমঝোতার ক্ষেত্র। মুক্তবুদ্ধির বিস্তীর্ণ অঙ্গন। এদিক থেকে গণতন্ত্র যেমন উপায়, তেমনি উপেয়। সমাজজীবনের যেমন লক্ষ্য, তেমনি মাধ্যমও। গন্তব্য ও পথ দুই-ই।
সফল গণতন্ত্রের কয়েকটি অঙ্গীকার রয়েছে। এক. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা জনগণের ক্ষমতা। সরকার আমানত হিসেবে সেই ক্ষমতা ধারণ করে। প্রয়োগ করে রাজনৈতিক সমাজের অনুমোদিত পন্থায়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে অথবা সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত পন্থা অনুসরণে ব্যর্থ হলে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। গণতান্ত্রিক এই সত্য স্বীকৃত হতে হবে। দুই. গণতন্ত্রে ব্যক্তি-প্রাধান্যের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের প্রাধান্য। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের রাজত্ব।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন সর্বজনীন। আইনের প্রতি আনুগত্য কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, তা তিনি যতই প্রভাবশালী হোন না কেন অথবা যত উঁচু পদে অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আরো একটি অঙ্গীকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন মেনে চলতে হবে, যদিও তা খারাপ আইন হয়ে থাকে। আইন প্রণয়ন করেন জনপ্রতিনিধিরা। আইন পরিবর্তনও করেন তারা। গণতন্ত্রে সবাই আইন মেনে চলে। মন্দ আইন হলে তা পরিবর্তিত হয় কিন্তু যত দিন তা পরিবর্তিত না হচ্ছে তত দিন তা মানতেই হবে। তিন. গণতন্ত্রের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে জোরের যুক্তির পরিবর্তে যুক্তির জোর কার্যকর হয়। সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় সমঝোতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে।
সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য যেমন প্রয়োজন গণতান্ত্রিক কাঠামো, তেমনি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মন। প্রয়োজন কাঠামোর সর্বস্তরের স্পন্দিত অন্তঃকরণ। কাঠামোকে সিক্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক চেতনার ঘন আস্তরণ। গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে দুই-ই অপরিহার্য। কাঠামো সৃষ্টি করে নৈতিক এক পরিমণ্ডল। রচনা করে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রাথমিক পর্যায়।
কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গণতান্ত্রিক মনের প্রসার ঘটানো, গণতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রাণোচ্ছল করার চূড়ান্ত পর্ব। চূড়ান্ত পর্বে গণতান্ত্রিক সমাজের সূচনা হয়। সমাজজীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর নেই।
গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হয় না এক বছরে। হয় না এক যুগেও। যুগ যুগ ধরে জলধারায় সঞ্চিত পলি যেমন গড়ে তোলে স্বর্ণদ্বীপ, গণতান্ত্রিক সমাজও গড়ে ওঠে যুগ যুগ ধরে অর্জিত সাফল্যে ও গণতন্ত্র চর্চার উজ্জ্বল ঐতিহ্যে সহযোগিতা ও মিলনের গৌরবময় কর্মকাণ্ডে। গণতান্ত্রিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের যে চারটি আজ রোপিত হলো তা ফুলে ফলে ভরে উঠবে বহু দিন পরে, যদি তা হৃদয়বান এক মালির সেবা লাভ করে। মালি তার মনের সবটুকু রঙ মিলিয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। আশপাশে থেকে আগাছা দূর করবে। গাছটির অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে দেবে এবং সুনির্দিষ্ট উচ্চতার জন্য অধীর আগ্রহে দিন গুনবে। ফুলে-ফলে গাছটি হেসে উঠলে মালি বিজয়ীর হাসি হাসবে। তবে মালির বিজয় কতটুকু হলো তা বড় কথা নয়, বড় কথা_এটি একটি সামাজিক অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠা। একটি গৌরবময় সামাজিক সৃষ্টি। তার ফুলে-ফলে সৌরভ। ফলে ফলে সেবার সামগ্রী। ডালপালার ছায়ায় সবার প্রশান্তি। সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এভাবেই নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা কেমন? অন্তহীন প্রশ্ন। তবে অবস্থা ভালো নয়।
এ জন্য দায়ী অসুস্থ রাজনীতি। গণতন্ত্রকে গতিশীল করতে হলে রাজনীতিকে কল্যাণমুখী করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। প্রয়োজন রাজনীতিকে ক্ষমতার-রাজনীতির পুঁতিগন্ধময় গহ্বর থেকে উদ্ধার করা। প্রয়োজন ব্যক্তি-প্রাধান্যের নিগড় থেকে মুক্ত করে আইনের রাজত্বে ফিরিয়ে আনা। রাজনীতি একবার তার সনাতন বিশুদ্ধ রূপ ফিরে পেলে আজকে সমাজজীবন যে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে অহর্নিশ ছটফট করছে, তা থেকে অব্যাহতি পাবে। সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্তি লাভ করবে। সংঘাতময় পরিবেশের অবসান ঘটবে। শুচিতা ফিরে আসবে। যুক্তিবুদ্ধির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। জনগণ আবারও হয়ে উঠবে শাসন-প্রশাসনের প্রধান নিয়ামক।
এ অবস্থা আপনাআপনি আসবে না। এ জন্য প্রয়োজন সচেতন উদ্যোগ। সমাজের বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী-জ্ঞানী-গুণী ও সচেতন উদ্যোগ। এ উদ্যোগ দুই খাতে প্রবাহিত হতে হবে। এক. রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন সাধনে উদ্যোগী হতে হবে। দুই. যাঁরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন তাঁদের ওরিয়েনটেশন বা মনমানসিকতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো রচিত হয়েছে বটে, কিন্তু সেই কাঠামোয় বিরোধী দলগুলোর সম্পৃক্ততার তেমন সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি। উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেই শূন্যস্থান পূরণ করে আমাদের দেশে বিধিবিধানের মাধ্যমে তা সম্পূর্ণ করতে হবে। জাতীয় সংসদ কার্যকর হচ্ছে না। বিরোধী দলের সদস্যরা কথা বলার তেমন সুযোগ পান না। অধিকাংশ সময় তারা উপেক্ষিত হন। এ অভিযোগ যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তা-ও নয়।
ক্ষমতার বিষক্রিয়া রয়েছে এবং চূড়ান্ত ক্ষমতার বিষক্রিয়া মারাত্মক। লর্ড অ্যাকটন বলেছেন, গণতন্ত্র কিন্তু সীমিত ক্ষমতার এক ব্যবস্থা। একদিকে জনগণের অধিকার, অন্যদিকে জনগণের কাছে সরকারের দায়িত্বশীলতা এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিরোধী দলগুলোর ওয়াচডগ ভূমিকা_সব মিলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসে। এ দেশে কিন্তু সরকার হলো সর্বক্ষেত্রে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। পরম পরাক্রমশালী শক্তিধর। এর কারণ বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো চেক। নেই কোনো ব্যালান্স।
এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। তা না হলে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দেওয়া যাবে না। এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য অনেক রক্ত ঝরিয়েছে, তবুও আমরা কাঙ্ক্ষিত স্তরে এখনো পেঁৗছতে পারিনি।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্র্রবিজ্ঞানী
No comments