ভারতীয় ছবি আমদানি-প্রতিযোগিতা নয়, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা by মোরশেদুল ইসলাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও অমিতাভ রেজা
ভেবেছিলাম, এই যাত্রায় ভারতীয় ছবি আমদানির প্রসঙ্গটা চুকে গেল। কিন্তু প্রথম আলোসহ বেশ কিছু পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে নতুন করে লেখা ছাপা হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হলো, আমাদের আসলে কিছু বলার আছে এবং সেটা বলা দরকার।
আমরা তিনজনের একজনও ভারতবিদ্বেষী নই। এমনকি আমরা সরকারবিরোধী কোনো এজেন্ডার ধারক ও বাহকও নই। আমরা তিনজনই ছবি বানাই, বানাতে চাই। বাংলাদেশে নতুন সিনেমার পাল তোলার যে লড়াই চলছে, আমরা তিনজনই তার ক্ষুদ্র শ্রমিক। আমাদের এই লেখায় আমরা প্রথমে বোঝার চেষ্টা করব, যাঁরা ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষে বলছেন, তাঁদের যুক্তিটা কী।
প্রথম যুক্তি, সিনেমা হল মরে যাচ্ছে। সিনেমা হলকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশের ছবি দিয়ে সিনেমা হলগুলো দর্শক টানতে পারছে না। অর্থাৎ সিনেমা হলগুলো ভালো চলছে না। সুতরাং ভারতীয় ছবি আনো এবং সিনেমা হল বাঁচাও। আমাদের বিনীত প্রশ্ন, ‘সিনেমা হল বাঁচাতে হবে কেন?’ উত্তর আসবে, ‘সিনেমার জন্য’। এরপর জিজ্ঞেস করব, ‘কোন সিনেমার জন্য?’ উত্তর কী আসবে? ভারতীয় সিনেমার জন্য? ভারতীয় সিনেমার প্রচার ও প্রসারের জন্য আমাদের সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখার দরকার কী? যদি ভারতীয় ছবির পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যই সিনেমা হলকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে তো সিনেমা হল ভেঙে ফেলে শপিং কমপ্লেক্স করাই ভালো।
দ্বিতীয় যুক্তি, প্রতিযোগিতা। ‘বাংলাদেশের সিনেমাকে ৩৮ বছর সুরক্ষা দিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে কী এমন ঘোড়ার ডিমের ছবি উপহার দিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র? বাংলা সিনেমাকে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে।’ পাঠকমাত্রই নিশ্চিত জানেন, ৩৮ বছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্র যে ধারায় চলেছে এবং যেসব অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে, আমরা কেউই তার ভক্ত না। আরও অনেক নবীন-প্রবীণ সহযোদ্ধার সমন্বয়ে আমরাও সেই ধারাকে বদলাতে চাইছি। কিন্তু সেই ধারা বদলানোর রাস্তা যদি হয় হিন্দি সিনেমাকে অবারিত করে দিয়ে বাংলা ছবি চালানোর জন্য হল খুঁজে না পাওয়া, তাহলে আমরা বলব, এটা টিউমার সারাতে গিয়ে মাথা কেটে ফেলার মতো প্রাণঘাতী সমাধান।
৩৮ বছর আমরা বাংলাদেশের সিনেমা থেকে কিছু পাইনি। তাহলে আশা করা যাচ্ছে, হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে এলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির পরিচালকেরা বদলে যাবেন এবং গিয়ে ভালো ছবি উপহার দেবেন? কিংবা আরও আগে যদি হিন্দি সিনেমাকে অবারিত করে দেওয়া হতো, তাহলে আমাদের পরিচালকেরা সেই কবেই বদলে গিয়ে ভালো ভালো ছবি উপহার দিতেন? প্রিয় ভাই ও বোনেরা, বাংলা সিনেমার মূল সমস্যাটা প্রতিযোগিতার অভাব নয়। বাংলা সিনেমার মূল সমস্যাটা ছিল ‘মেধার অভাব’। কয়েক দশকের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, ভিডিও মাধ্যমের বৈপ্লবিক বিস্তার, পাইরেসির কল্যাণে পৃথিবীর সব প্রান্তের ছবির সহজপ্রাপ্তি—এই তিনের প্রভাবে আজকে প্রথমবারের মতো একটা প্রজন্মকে দেখা যাচ্ছে যারা সিনেমাটা ঠিকঠাক বোঝে, আধুনিক সিনেমার করণকৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং যারা বাস্তবেই বাংলাদেশের সিনেমার মানচিত্র বদলানোর স্বপ্নে হাতে-কলমে কাজ করছে, তাদের অনেককেই সিনেমা হল আর টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা চিনি। তবে বৃহৎ অংশকেই চিনি না, যারা নিজেদের মতো করে প্রস্তুত হচ্ছে। আপাতত তারা ভিডিওতে ছোট ছবি করছে। কিন্তু স্বপ্ন, একদিন বড় পর্দা দখল করার। এরা সংখ্যায় শত-সহস্র। এই যে চারদিকে এত ছেলেমেয়ে ছবি নির্মাতা হতে চায়, এই যে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির উৎসবে এত ছবি জমা পড়া, এই যে এত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম ক্লাবগুলোর সক্রিয় উপস্থিতি, এই যে ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু আনাগোনা—এসব কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এ সবকিছু একটাই ইঙ্গিত বহন করে যে আমাদের সিনেমা বদলানোর জন্য একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে।
ঠিক এ মুহূর্তে আমরা যদি সিনেমা হলগুলো ভারতীয় ছবির হাতে ছেড়ে দিই, তাহলে এত দিনে তৈরি হওয়া সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা ‘অঙ্কুরেই বিনষ্ট’ হবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে নতুন ছবি নির্মাতারা যেন তাঁদের ছবি চালানোর মতো হল পান।
একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলা দরকার, আমরা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিযোগিতাকে ভয় পাই না। আমরা ভারতীয় টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে আছি। এবং আমরা এও বিশ্বাস করি, ভারতীয় ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার ক্ষমতাও আমাদের আছে। কারণ, বাংলাদেশের জীবনের গভীরে যে সুর আছে, তা একমাত্র আমাদের ছবিতেই বাজবে, কোনো ভারতীয় ছবিতে নয়। ফলে আমাদের ছবি দেখাতে আমরা হলও পাব, দর্শকও পাব। কিন্তু একজন নতুন পরিচালকের কী অবস্থা হবে? তাকে কি হল দেওয়া হবে?
ভারতের অডিও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রি টিকে আছে। আমাদের বইয়ের বাজারও প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে। কেউ কেউ বলছেন, সুতরাং সিনেমাও প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকুক। সিনেমার ব্যাপারটা একটু আলাদা। একটা বইয়ের দোকানে বা সিডির দোকানে আপনি একই সঙ্গে বাংলাদেশি বা ভারতীয় হাজারটা পণ্যই রাখতে পারেন, যার যেটা ভালো লাগবে বেছে নিয়ে যাবে।
কিন্তু একটা ‘বলাকা’ বা ‘রানীমহলে’ আপনি সপ্তাহে একটা ছবিই তুলতে পারবেন। ফলে সেই ‘একটা’ যদি হয় ‘হিন্দি’ একটা, তাহলে আমার দেশের বাংলা ছবিটার জন্য হল পাওয়া যাবে কোথায়? হল পাওয়া গেলেই না প্রতিযোগিতা!! আমাদের দেশের মানুষের দেশপ্রেমের যে অবস্থা, সমমানের স্বদেশি ও বিদেশি—দুটি পণ্য পাশাপাশি রাখলে বিদেশিটাই বেছে নেন, তাতে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, হলের মালিকেরা হিন্দি ছবিই তুলতে চাইবেন, বাংলাদেশের ছবি নয়। তা ছাড়া ১০০ কোটি টাকার ছবি আর ৫০ কোটি বিপণন বাজেটের ছবির সঙ্গে তো বাংলাদেশের ছবির প্রতিযোগিতা হতে পারে না। এটা অসম প্রতিযোগিতা।
সারা দুনিয়ার সিনেমার দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেই দেশগুলো থেকেই ভালো ভালো ছবি আসছে, যে দেশগুলোর বাজার সুরক্ষিত। ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে আমরা একের পর এক অসাধারণ সব ছবি পাচ্ছি। কারণ, তাদের ইন্ডাস্ট্রিটা হলিউড এখনো গিলে ফেলতে পারেনি। আর জাপানি বা ইউরোপের অন্যান্য দেশের দিকে তাকান। হলিউডের বিশাল পুঁজি আর বিপণনের তোড়জোড়ে তাদের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। আমাদের ক্ষেত্রে বলিউডই হলিউডস্বরূপ। তাই ভারতীয় ছবি আমদানির আগে এ সবকিছু মাথায় রাখতে হবে। হিন্দি ছবির আগ্রাসন কেবল বাংলাদেশি ছবির জন্যই বিপজ্জনক, তা নয়। এটা সামগ্রিকভাবেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
সরকার যদি একান্তই মনে করে, বাংলাদেশের মানুষকে বড়পর্দায় বিদেশের ভালো ছবি দেখাবে, তাহলে বিভাগীয় শহরগুলোতে একটা করে হল নির্দিষ্ট করে দিতে পারে, যেখানে বিদেশি ভালো ছবি দেখানো হবে। তবে সেটা কোনোভাবেই কেবল হিন্দি নয়। লাতিন, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইরানি, কোরিয়ান—সব ছবিই আনুপাতিক হারে দেখাতে হবে।
মোরশেদুল ইসলাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা: চলচ্চিত্র নির্মাতা।
প্রথম যুক্তি, সিনেমা হল মরে যাচ্ছে। সিনেমা হলকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশের ছবি দিয়ে সিনেমা হলগুলো দর্শক টানতে পারছে না। অর্থাৎ সিনেমা হলগুলো ভালো চলছে না। সুতরাং ভারতীয় ছবি আনো এবং সিনেমা হল বাঁচাও। আমাদের বিনীত প্রশ্ন, ‘সিনেমা হল বাঁচাতে হবে কেন?’ উত্তর আসবে, ‘সিনেমার জন্য’। এরপর জিজ্ঞেস করব, ‘কোন সিনেমার জন্য?’ উত্তর কী আসবে? ভারতীয় সিনেমার জন্য? ভারতীয় সিনেমার প্রচার ও প্রসারের জন্য আমাদের সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখার দরকার কী? যদি ভারতীয় ছবির পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যই সিনেমা হলকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে তো সিনেমা হল ভেঙে ফেলে শপিং কমপ্লেক্স করাই ভালো।
দ্বিতীয় যুক্তি, প্রতিযোগিতা। ‘বাংলাদেশের সিনেমাকে ৩৮ বছর সুরক্ষা দিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে কী এমন ঘোড়ার ডিমের ছবি উপহার দিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র? বাংলা সিনেমাকে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে।’ পাঠকমাত্রই নিশ্চিত জানেন, ৩৮ বছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্র যে ধারায় চলেছে এবং যেসব অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে, আমরা কেউই তার ভক্ত না। আরও অনেক নবীন-প্রবীণ সহযোদ্ধার সমন্বয়ে আমরাও সেই ধারাকে বদলাতে চাইছি। কিন্তু সেই ধারা বদলানোর রাস্তা যদি হয় হিন্দি সিনেমাকে অবারিত করে দিয়ে বাংলা ছবি চালানোর জন্য হল খুঁজে না পাওয়া, তাহলে আমরা বলব, এটা টিউমার সারাতে গিয়ে মাথা কেটে ফেলার মতো প্রাণঘাতী সমাধান।
৩৮ বছর আমরা বাংলাদেশের সিনেমা থেকে কিছু পাইনি। তাহলে আশা করা যাচ্ছে, হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে এলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির পরিচালকেরা বদলে যাবেন এবং গিয়ে ভালো ছবি উপহার দেবেন? কিংবা আরও আগে যদি হিন্দি সিনেমাকে অবারিত করে দেওয়া হতো, তাহলে আমাদের পরিচালকেরা সেই কবেই বদলে গিয়ে ভালো ভালো ছবি উপহার দিতেন? প্রিয় ভাই ও বোনেরা, বাংলা সিনেমার মূল সমস্যাটা প্রতিযোগিতার অভাব নয়। বাংলা সিনেমার মূল সমস্যাটা ছিল ‘মেধার অভাব’। কয়েক দশকের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, ভিডিও মাধ্যমের বৈপ্লবিক বিস্তার, পাইরেসির কল্যাণে পৃথিবীর সব প্রান্তের ছবির সহজপ্রাপ্তি—এই তিনের প্রভাবে আজকে প্রথমবারের মতো একটা প্রজন্মকে দেখা যাচ্ছে যারা সিনেমাটা ঠিকঠাক বোঝে, আধুনিক সিনেমার করণকৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং যারা বাস্তবেই বাংলাদেশের সিনেমার মানচিত্র বদলানোর স্বপ্নে হাতে-কলমে কাজ করছে, তাদের অনেককেই সিনেমা হল আর টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা চিনি। তবে বৃহৎ অংশকেই চিনি না, যারা নিজেদের মতো করে প্রস্তুত হচ্ছে। আপাতত তারা ভিডিওতে ছোট ছবি করছে। কিন্তু স্বপ্ন, একদিন বড় পর্দা দখল করার। এরা সংখ্যায় শত-সহস্র। এই যে চারদিকে এত ছেলেমেয়ে ছবি নির্মাতা হতে চায়, এই যে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির উৎসবে এত ছবি জমা পড়া, এই যে এত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম ক্লাবগুলোর সক্রিয় উপস্থিতি, এই যে ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু আনাগোনা—এসব কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এ সবকিছু একটাই ইঙ্গিত বহন করে যে আমাদের সিনেমা বদলানোর জন্য একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে।
ঠিক এ মুহূর্তে আমরা যদি সিনেমা হলগুলো ভারতীয় ছবির হাতে ছেড়ে দিই, তাহলে এত দিনে তৈরি হওয়া সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা ‘অঙ্কুরেই বিনষ্ট’ হবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে নতুন ছবি নির্মাতারা যেন তাঁদের ছবি চালানোর মতো হল পান।
একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলা দরকার, আমরা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিযোগিতাকে ভয় পাই না। আমরা ভারতীয় টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে আছি। এবং আমরা এও বিশ্বাস করি, ভারতীয় ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার ক্ষমতাও আমাদের আছে। কারণ, বাংলাদেশের জীবনের গভীরে যে সুর আছে, তা একমাত্র আমাদের ছবিতেই বাজবে, কোনো ভারতীয় ছবিতে নয়। ফলে আমাদের ছবি দেখাতে আমরা হলও পাব, দর্শকও পাব। কিন্তু একজন নতুন পরিচালকের কী অবস্থা হবে? তাকে কি হল দেওয়া হবে?
ভারতের অডিও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রি টিকে আছে। আমাদের বইয়ের বাজারও প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে। কেউ কেউ বলছেন, সুতরাং সিনেমাও প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকুক। সিনেমার ব্যাপারটা একটু আলাদা। একটা বইয়ের দোকানে বা সিডির দোকানে আপনি একই সঙ্গে বাংলাদেশি বা ভারতীয় হাজারটা পণ্যই রাখতে পারেন, যার যেটা ভালো লাগবে বেছে নিয়ে যাবে।
কিন্তু একটা ‘বলাকা’ বা ‘রানীমহলে’ আপনি সপ্তাহে একটা ছবিই তুলতে পারবেন। ফলে সেই ‘একটা’ যদি হয় ‘হিন্দি’ একটা, তাহলে আমার দেশের বাংলা ছবিটার জন্য হল পাওয়া যাবে কোথায়? হল পাওয়া গেলেই না প্রতিযোগিতা!! আমাদের দেশের মানুষের দেশপ্রেমের যে অবস্থা, সমমানের স্বদেশি ও বিদেশি—দুটি পণ্য পাশাপাশি রাখলে বিদেশিটাই বেছে নেন, তাতে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, হলের মালিকেরা হিন্দি ছবিই তুলতে চাইবেন, বাংলাদেশের ছবি নয়। তা ছাড়া ১০০ কোটি টাকার ছবি আর ৫০ কোটি বিপণন বাজেটের ছবির সঙ্গে তো বাংলাদেশের ছবির প্রতিযোগিতা হতে পারে না। এটা অসম প্রতিযোগিতা।
সারা দুনিয়ার সিনেমার দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেই দেশগুলো থেকেই ভালো ভালো ছবি আসছে, যে দেশগুলোর বাজার সুরক্ষিত। ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে আমরা একের পর এক অসাধারণ সব ছবি পাচ্ছি। কারণ, তাদের ইন্ডাস্ট্রিটা হলিউড এখনো গিলে ফেলতে পারেনি। আর জাপানি বা ইউরোপের অন্যান্য দেশের দিকে তাকান। হলিউডের বিশাল পুঁজি আর বিপণনের তোড়জোড়ে তাদের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। আমাদের ক্ষেত্রে বলিউডই হলিউডস্বরূপ। তাই ভারতীয় ছবি আমদানির আগে এ সবকিছু মাথায় রাখতে হবে। হিন্দি ছবির আগ্রাসন কেবল বাংলাদেশি ছবির জন্যই বিপজ্জনক, তা নয়। এটা সামগ্রিকভাবেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
সরকার যদি একান্তই মনে করে, বাংলাদেশের মানুষকে বড়পর্দায় বিদেশের ভালো ছবি দেখাবে, তাহলে বিভাগীয় শহরগুলোতে একটা করে হল নির্দিষ্ট করে দিতে পারে, যেখানে বিদেশি ভালো ছবি দেখানো হবে। তবে সেটা কোনোভাবেই কেবল হিন্দি নয়। লাতিন, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইরানি, কোরিয়ান—সব ছবিই আনুপাতিক হারে দেখাতে হবে।
মোরশেদুল ইসলাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা: চলচ্চিত্র নির্মাতা।
No comments