সেবাখাত-ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাসেবায় শৃঙ্খলা জরুরি by মোহাম্মদ আলী

শূন্যপদ ও প্রস্তাবিত নতুন পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি কাউন্সিল গঠন ও কলেজ অব ফিজিওথেরাপি বাস্তবায়ন করলেই বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় পূর্ণ শৃঙ্খলা ফিরে আসবে
টগবগে তরুণ ব্যবসায়ী মহির উদ্দিন আড়াই মাস আগে ট্রাক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ চার ঘণ্টা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে ছিলেন।


দীর্ঘ সময় চাপা পড়ে থাকায় তার ডান পায়ের পেছনের প্রধান স্নায়ুটি অকেজো হয়ে গেছে। ফলে তিনি আর হাঁটতে পারছেন না। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় পরিবারটিও আর্থিক সংকটে পড়েছে। অস্ত্রোপচারের পর পুনর্বাসনের জন্য মহিরের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ব্যয় বহন তার পক্ষে অসম্ভব। এ চিত্র শহর-গ্রাম-গঞ্জের। এ ধরনের রোগী যে পরিবারে আছে সে পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যেরই স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনা, মেরুদণ্ডে আঘাত, মেরুদণ্ডের কোনো রোগ বা অন্য যে কোনোভাবেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়া কোনো ব্যক্তির চিকিৎসা আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। দেশের বেশ কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগ থাকলেও সেখানে কোনো ফিজিওথেরাপিস্ট নেই। কোনো কোনো হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগটিই অবলুপ্ত হয়ে গেছে।
শুধু পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসাই নয়, আধুনিক ফিজিওথেরাপি অর্থোপেডিক, নিউরো, চেস্ট, কার্ডিও-পালমোনারি, শিশু ইত্যাদি বিভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ সব ধরনের শারীরিক ব্যথা, স্নায়ুতান্ত্রিক বৈকল্য, বুকের বা ফুসফুসের রোগ, এমনকি শিশু রোগের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এখন একজনও সরকারি ফিজিওথেরাপিস্ট নেই, বর্তমান চিত্র বোঝাতে এই একটি বাক্যই যথেষ্ট।
৫ জানুয়ারি ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত গেজেটে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদাসম্পন্ন ফিজিওথেরাপিস্ট পদে নিয়োগ পাওয়ার নূ্যনতম যোগ্যতা হলো, প্রার্থীকে যে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিওথেরাপি (বিপিটি) কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। ফিজিওথেরাপি অ্যাসিসট্যান্ট পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীকে মেডিকেল টেকনোলজি (ফিজিওথেরাপি) পাস হতে হবে অথবা এইচএসসি পাসের পর ফিজিওথেরাপি বিভাগে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের অধীনে ৫-৭ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অর্থাৎ ১৯৮৫ সালেই ফিজিওথেরাপিস্টের পদমর্যাদা ও এই পদে নিয়োগের বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এ পেশাজীবীদের মানমর্যাদা ক্ষুণ্নম্ন ও পঙ্গু প্রতিবন্ধীদের জিম্মি করে অর্থ আয়ের হীন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, এমনকি অশিক্ষিত ব্যক্তিদেরও 'ফিজিওথেরাপিস্ট' পদে নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে। তা ছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি (ফিজিওথেরাপি) কোর্স খুলে যে কোনো সালে এসএসসি পাস করা মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আইএইচটিসহ ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা তাদের মান মর্যাদা হারাচ্ছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি কাউন্সিল এখনও গঠিত হয়নি। তাই চিকিৎসার ধরন এবং নামের পূর্বের পদবি ব্যবহারে বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি সোসাইটি ভারতের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিওথেরাপিস্টের (ওঅচ) নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। পাঠক বিস্তারিত জানতে িি.িঢ়যুংরড়ঃযবৎধঢ়ুরহফরধ.ড়ৎম-এ লগ ইন করতে পারেন। তবে ফিজিওথেরাপিস্টরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সদস্য না হওয়ায় এর আইনের আওতামুক্ত থাকবেন। ফিজিওথেরাপি একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন পেশা। যেমন_ হোমিও চিকিৎসকরা হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের মাধ্যমে ও ওই বোর্ডের নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হন, তেমনি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকরা তাদের জন্য গঠিত কাউন্সিল দ্বারাই চালিত হবেন।
বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক সার্জন। উপরন্তু তিনি আমাদের সরাসরি শিক্ষক। ২০০৯ সালের জুন মাসে 'বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি'-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টাও আমাদের পেশাটির মানোন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। শূন্যপদ ও প্রস্তাবিত নতুন পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি কাউন্সিল গঠন ও কলেজ অব ফিজিওথেরাপি বাস্তবায়ন করলেই বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় পূর্ণ শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। দেশের লাখ লাখ পঙ্গু প্রতিবন্ধীর পুনর্বাসন ও কোটি কোটি ব্যথাকাতর রোগীর চিকিৎসাসেবা সারাদেশে সহজলভ্য করার জন্য ফিজিওথেরাপি শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় শৃঙ্খলা আনয়নে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করি।

ডা. মোহাম্মদ আলী : ভারপ্রাপ্ত সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি সোসাইটি
physiomali@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.