সহজিয়া কড়চা-সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা—সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

মানুষের দ্বারাই যখন সরকার গঠিত হয়, সুতরাং সরকারেরও কণ্ঠস্বর আছে। একটি রাষ্ট্র যদি একটি সংগীতের আসর হয়ে থাকে, তাহলে সে আসরের শিল্পী সরকার। জনগণ শ্রোতা-দর্শক। বহুকাল ধরে বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্রীয় সংগীতের আসর, যেখানে একদল শাসক-শিল্পী যদি পাঁচ বছর ধরে বলে যান: সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা; আরেক


দল শিল্পী পরের পাঁচ বছর হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ভাঁজতে থাকেন: সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা। আমাদের সরকারগুলোর গলায় স্বর আছে—কোনো সুর নেই। তাদের কণ্ঠ সুরেলা নয়, কোমলও নয়—কর্কশ। হেঁড়ে গলায় হারমোনিয়ামে এমন কোনো সুর তাদের পক্ষে তোলা সম্ভব নয়, যা শ্রুতিমধুর। যা শুনে দুঃখকষ্টের মধ্যেও মনটা একটু প্রশান্ত হয়।
যাঁর সংগীত সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, গলায় কোনো সুর নেই, তাঁকে মঞ্চে নিয়ে বসিয়ে দিলে শ্রোতারা যেমন হতাশ হয়ে হাঁ করে বসে থাকবেন, তাঁদের গান শোনা হবে না; তেমনই যাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান নেই, তাঁরা সরকারের দায়িত্ব পেলে জনগণের কোনো লাভ নেই।
দেশের সাধারণ মানুষ ও কাগজের লেখকেরা সরকারের ভুলভ্রান্তি আর ব্যর্থতার জন্য মৌখিক ও লিখিতভাবে সমালোচনা করে থাকেন। আসলে ওভাবে সমালোচনা করা ঠিক নয়। রাষ্ট্র কীভাবে চালাতে হয়, তা সবাই জানেন না। যাঁরা তা জানেন না, তাঁদের অনর্থক দোষারোপ করা অনুচিত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের শোষণ ও নিপীড়ন করতেন। তাঁরা আমাদের দেশপ্রেমিকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন, কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসন চালাতে হয়। সরকারে যাঁরা থাকেন, ন্যূনতম নিরপেক্ষতা তাঁদের প্রদর্শন করতেই হবে। শত্রুকেও এমন কিছু সুযোগ দিতে হবে, যাতে সে বলতে না পারে, সে অবিচারের শিকার। নিম্নশ্রেণীর প্রতিপক্ষের সঙ্গেও এমন কিছু সৌজন্য প্রদর্শন করতে হবে, যাতে তৃতীয় পক্ষের কেউ বলতে না পারে, ভদ্রজনোচিত আচরণের অভাব রয়েছে।
ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলরা বিশাল দক্ষিণ এশিয়া শাসন করতেন। তাঁদের কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ছিল গুটিকয়। এ কালের মতো বিপুলসংখ্যক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী উপদেষ্টা ছিলেন না। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ছিল সীমিত। দামি জিপ ছিল না। সাইকেলে, ঘোড়ায় অথবা নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। থানার পুলিশকে প্রতিদিন অন্তত ১৫ মাইল অর্থাৎ ২২-২৩ কিলোমিটার হাঁটতে হতো। রাতের বেলা দারোগাবাবু বা দারোগার স্ত্রী স্বামীর পায়ে গরম রসুন ও তেল মালিশ করে দিতেন। কিন্তু তাঁরা আইনশৃঙ্খলা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। চোর-ডাকাত বঙ্গীয়সমাজে চিরকালই ছিল। তা ছাড়া ১৯০৫ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় যত সশস্ত্র চরমপন্থী বিপ্লবী ছিলেন, আজ বাংলাদেশে তত ইসলামি জঙ্গি নেই। সেকালে কত দারোগা খুন হয়েছেন, তার হিসাব নেই।
সেকালের মন্ত্রীরা অভিজাত, সম্ভ্রান্ত-সামন্ত পরিবার থেকে আসতেন। কথা বলতেন কম। যে কথা বলতেন, তা ছিল পাথরের মতো ভারী। একালের কথাবার্তার মতো শিমুল তুলার মতো হালকা নয়। তা ছাড়া প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী-উপদেষ্টার প্রয়োজনই হতো না বড়লাটের। সচিব, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (একালের বিডিআর), পুলিশের আইজি তাঁদের তিন বছরের মেয়াদে তিন দিনও মিডিয়ার সামনে সরকারপ্রধানের ভাষায় মতামত দিতে পারতেন না। গণমাধ্যমের কাছে কর্মকর্তাদের হড় হড় করে কথা বলার অধিকার ছিল না। আমরা এখন স্বাধীন—সবাই স্বাধীন, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
৬৩ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রতিটি সরকারের বিপর্যয় তারা নিজেরাই ডেকে এনেছে—বিরোধী দল তাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি। মুসলিম লীগ রাষ্ট্রভাষা, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি প্রশ্নে জনপ্রিয়তা হারিয়ে গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট তাদের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির জন্য জনগণ থেকে দূরে সরে যায়। আইয়ুব খান তাঁর একনায়কী শাসন চিরস্থায়ী করতে গিয়ে গণরোষে পড়ে অপমানজনকভাবে বিদায় নেন। ইয়াহিয়া সরকার তার নিজের ও দেশের বিপদ নিজেই ডেকে আনে। প্রথম বাংলাদেশ সরকার তার সব সুযোগ হাতছাড়া করে বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র তৈরি করে ক্ষমতা হারায়। ফলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক স্বৈরতন্ত্রের জন্ম নেয়। জিয়ার সামরিক সরকার সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে গিয়ে নিজের ও দেশের বিপদ ডেকে আনে। এরশাদ সরকারের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। ভালো ভালোয় নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিলে অপমানিত হয়ে যেতে হতো না। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার তিনটি গণতান্ত্রিক সরকার নিজেদের কীর্তিকলাপের কারণেই নির্বাচনের পরের বার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বিরোধী দলের কারণে কোনো সরকারের বিপদ হয়নি, যা করার জনগণই করেছে। সুবিধাটা গেছে বিরোধী দলের কাছে।
গত ১৬ মাসে বাংলাদেশে বিরোধী দলের যে সুফিবাদী ভূমিকা, তা উপমহাদেশের কোনো বিরোধী দল কোনো দিন পালন করেনি। এ ধরনের বিরোধী দল থাকলে অনন্তকাল দেশ শাসন করা যায়। শনিবার বিএনপির সমর্থক আইনজীবীদের সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বেগম জিয়া অবশ্য বলেছেন, সরকারকে আর সময় দেওয়া যায় না। তবে আগামী সাড়ে তিন বছর যে তাঁর মহাসচিব ড্রয়িংরুমের বাইরে বেরোবেন, সে ভরসা আমাদের নেই। তা ছাড়া সামনে আছে বৃষ্টি-বাদলা, বন্যা, তারপর শীত। সুতরাং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা করে বড় কোনো আন্দোলন করা যে সম্ভব হবে, তা মনে হয় না।
কিন্তু তাতেই কি সরকার বিপদমুক্ত? সরকারের বিপদ তো সরকার নিজেই। গত ১৬ মাসে সরকার যতবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে, তা তার নিজেদের লোকের কারণেই। প্রথমত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উপাখ্যানে বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা ছিল না। দ্বিতীয়ত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তা বিএনপির নেতারা শিখিয়ে দেননি। বেলা ১১টার সময় দুপুর ১২টা বাজাতে সরকারকে অন্য কেউ বুদ্ধি দেয়নি। কী প্রয়োজন ছিল, দিনের ঘণ্টাখানেক রাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া এবং রাতের অন্ধকার অনেকখানি দিনের ভেতর টেনে আনা।
গত সোয়া বছরে সরকার এত সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর দুই মেয়াদে অথবা মাহাথির তাঁর গোটা শাসনামলেও নেননি। শুরু থেকেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমন সব বক্তব্য দিতে লাগলেন, যার ফলে বিব্রত হয়েছে সরকারই। প্রথমেই জ্যেষ্ঠ এক মন্ত্রী বললেন, সবকিছু সিন্ডিকেটেড হয়ে গেছে, এটা ভেঙে দিতে হবে। এখন পর্যন্ত সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব সরকার প্রমাণ করতে পারেনি, যদিও সিন্ডিকেট ঠিকই আছে এবং তার সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠরাই জড়িত।
উঁচু আসনে যাঁরা বসেন, তাঁদের কথা অত্যন্ত মূল্যবান। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৬ এপ্রিল এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি শুধু সহযোগিতাই করেননি, তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ীই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। তিনি পাকিস্তানের অনুগত চর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’ তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসংক্রান্ত ফাইলপত্রসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে জেনেছি, জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের একটা মিশন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।’ [ডেসটিনি, ১৭.৪.১০]
কয়েক দিন ধরে অব্যাহতভাবে কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এই তত্ত্ব জাতির সামনে হাজির করছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিএনপি এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেছে—তাদেরও বিচার করা হবে। আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদরদের এ দেশে পুনর্বাসিত করেছেন। তাঁর প্রত্যক্ষ মদদে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একাত্তরের ঘাতকদের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করার চেষ্টা হয়েছিল।’ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক জিয়াকে ‘অনুপ্রবেশকারী মুক্তিযোদ্ধা’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানিদের চর হিসেবে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’ [কালের কণ্ঠ, ২৫.৪.১০]
এই বক্তব্য দিয়ে তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের কোনো ক্ষতি করতে পারছেন কি না, তা তাঁরাই জানেন, কিন্তু মুজিবনগর সরকার ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার একটি নতুন দরজা খুলে দিলেন। তার ফলে এমন সব বিষয় এখন উঠে আসবে, তাতে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের শ্রদ্ধার ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়ে যাবে।
একজন সামরিক শাসককে সমালোচনা করার হাজারও পথ আছে। এসব সঠিক পথ নয়। ইয়াহিয়া-টিক্কা খাঁরা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যদি জিয়াকে চট্টগ্রাম বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাতে আমি বিশেষ দোষের কিছু দেখি না। পাকিস্তানের চর হিসেবে হলেও যোগটা তো দিয়েছিলেন। তাতে বাঙালির উপকার হয়েছিল। জিয়া ছাড়া অন্য কোনো আওয়ামীপন্থী মেজরকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়োগ দেননি কেন? সেটা না দেওয়া বিরাট ব্যর্থতা।
আইন প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় বলেছেন এবং তা টিভি সংবাদে প্রচারিত হয়েছে। সরকারের যেসব ‘ফাইলপত্র’ ও ‘ডকুমেন্টে’ দেখা গেছে, জিয়া ‘মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘পাকিস্তানি চর’ সেগুলো আশা করি, গণমাধ্যম ও গবেষকদের কাছে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে, তা যদি না হয়, তা হবে জাতির সঙ্গে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।
যুদ্ধাপরাধ তদন্ত সংস্থার প্রধানের নিয়োগ ও তাঁর সরে যাওয়ার ঘটনাটি খুব ছোট ব্যাপার নয়। তাঁর পক্ষে আইন প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনড় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আলাউদ্দিনের উচিত ছিল বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো। প্রধানমন্ত্রী ওই কর্মকর্তাকে সরে যেতে বললেই তিনি সরে যেতেন। বিষয়টি নিয়ে ধূলি ওড়ানোর দরকার ছিল না। দুনিয়ার মানুষকে অপমান না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো দাবি-দাওয়ার ব্যাপার নয়। কে চাইল, না চাইল তার ওপর সে বিচার নির্ভর করে না। যেকোনো জাতীয়তাবাদী সরকারের কর্তব্য তাদের বিচার করা। আমাদের সব সরকারই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো সরকার বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে বড় অপরাধ করেছে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, বর্তমান সরকার তদন্তকাজ শুরু করেছে। স্বাভাবিক আইনি-প্রক্রিয়ায় তা হওয়া উচিত। সেটা নিয়ে বেশি কথা বলা মানে বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বর্তমান সরকারের মেয়াদেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে এবং তাদের শাস্তি কার্যকর হবে। এ কথাটি খুব আপত্তিকর কথা। বর্তমান সরকারই বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়। বিচারের সময়সীমার কোনো প্রশ্ন যদি আসে, তা হলে মোবাইল কোর্ট বসানোই ভালো।
যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচারের ভার প্রধানমন্ত্রী যাঁদের দিয়েছেন, তাঁদের যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, তা তাঁদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। এ পৃথিবীতে সবই হয়। নাৎসি বাহিনীর সদস্য কুট ওয়ার্ল্ডহাইম জাতিসংঘের মহাসচিব ও পরে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানির সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় লেখক গুন্টার গ্রাসও হিটলারের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। আমাদের কোনো প্রতিমন্ত্রীই সম্ভবত জানেন না, যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েক বছর জেলখাটা মানুষটিও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সরকারের লোকদের কথাবার্তার কারণেই এখন আমাদের ইউরোপ-আমেরিকার বন্ধুরা বলছেন বিষয়টিকে যেন ‘পলিটিক্যালি’ বিবেচনা করা না হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং তাকে ক্ষমতাহীন করার ঘোষণা সাবলীলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখ থেকে আসার পর দাতা দেশগুলো সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ওই বক্তব্যের পরপরই ইউরোপীয় ডেলিগেশন প্রধান স্টেফান ফ্রোইন তাঁদের ‘ক্লিয়ার পজিশন’ জানিয়ে দিয়েছেন এবং সংসদে একতরফাভাবে যা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘উই আর নট হ্যাপি’—অর্থাৎ তাঁরা সন্তুষ্ট নন। ঝানু কূটনীতিকের মতো তিনি কথা বলেছেন। আসলে তিনি বলতে চান, আপনাদের কাজে আমরা ক্ষুব্ধ। খালেদা সরকারের প্রতি তাঁরা হ্যাপি ছিলেন না। তার পরিণতি কী, তা বেগম জিয়া জানেন। মহাজোটকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের ভূমিকা লিখে শেষ করা যাবে না। অনন্তকাল তারা একটি জিনিসকে সমর্থন দেয় না।
শুধু সরকারি ছাত্রসংগঠনের রামদাবাদীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিছু কিছু সরকারি ব্যক্তির কথাবার্তায় সর্বনাশ যা হওয়ার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। দক্ষতা না থাকুক, সরকারের ভেতরের মানুষের মধ্যে যদি কাজে আন্তরিকতা না থাকে, নিষ্ঠা না থাকে এবং পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় না থাকে, তাহলে বারবার বিপদ হবে।
প্রধানমন্ত্রী যাঁদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অন্যদিকে বিরাট যোগ্যতা থাকতে পারে, কিন্তু ওই পদের যোগ্য তাঁরা নন। সদ্য পাস করা এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে হার্টের বাইপাস অপারেশন করাতে গেলে রোগী অপারেশন না করে যত দিন বাঁচত, তার আগেই মরবে। সরকারের একজন পশ্চিমা বন্ধু আমাকে বললেন, ‘দিস টাইম থিংকস উইল নট বি সো ইজি।’ অর্থাৎ এই যাত্রায় সরকারের কাজ করা খুব সহজ হবে না। অথচ সরকার ভাবছে উল্টো। তারা খাতিরজমায় আছেন, কারণ বিরোধী দলের ডানা ভাঙা, সুতরাং পরোয়া কী? কিন্তু বিদেশিরা তো আছেন।
সরকার তার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেই ভাবছে না। প্রতিপক্ষের লোকদের নিয়ে অকারণে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছে। কার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকবে, কাকে বিদেশে যেতে বাধা দেবে, কোন সম্প্রচারকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে—এসব ভুল কাজ। একটি সংহত জাতি গঠন করাই একটি ভালো সরকারের প্রধান কর্তব্য। একাত্তরের আওয়ামী লীগের স্থান যেমন ইতিহাসে স্থায়ী অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে, তেমনি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের স্থানও ইতিহাসে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। আত্মবিধ্বংসী কোনো পথে না গিয়ে সরকারের উচিত গঠনমূলক কাজ করা। সারা দিন বেসুরো কণ্ঠে সা-রে-গা-মা আর সা-নি-ধা-পা করলে মানুষ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়। ভালো কাজ করলেই ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায়, বাজে কাজ নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকে, ইতিহাস তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখ ক।

No comments

Powered by Blogger.