মানুষের মুখ-স্বপ্নজয়ের ফেরি by আনোয়ার পারভেজ
গ্রীষ্মের লম্বা ছুটিতে সহপাঠীদের কেউ মামাবাড়ি যায়। কেউ গ্রামের মাঠে ডাংগুলি, ফুটবল, ক্রিকেট খেলে বেড়ায়। কেউ বা ঘুড়ি উড়িয়েই কাটিয়ে দেয় সারা দিন। ছুটির অবসরে শিশুরা যখন দুরন্তপনায় মেতে ওঠে, তখন স্বপ্নজয়ের নেশায় রাত জাগে কিশোর লিটনচন্দ্র। ছোট হাতে বানায় হরেক রকম মিঠাই। পরদিন এ-গ্রাম ও-গ্রাম ঘুরে ফেরি করে।
লিটন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বালুয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। দরিদ্র পরিবারের এই কিশোর পড়ালেখা শেষে বড় চাকুরে হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নজয়ের জন্যই স্কুল ছুটির ফাঁকে ফেরিওয়ালার কাজ বেছে নিয়েছে সে। তার বাবা বামুনিয়া পালপাড়ার মনেন্দ্রচন্দ্র পালও গ্রামে গ্রামে মাটির হাঁড়ি-পাতিল বেচেন।
গত শুক্রবার দুপুরে সোনাতলার বামুনিয়া পালপাড়া গ্রামে লিটনদের বাড়িতে গেলাম। দেখলাম, লিটনের মা অঞ্জনা রানী হাঁড়ি-পাতিল বানানোয় ব্যস্ত। উঠানে লিটনের ছোট দুটি ভাইবোন লিপটন ও সঞ্জিতা খেলছে। অঞ্জনা রানী জানান, লিটন মিঠাই বেচতে গেছে। ১০ বছর বয়স থেকে সে ফেরিওয়ালার কাজ করে। আমন ও বোরো মৌসুমে বছরে দুই মাস সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে এ কাজ করে। রাত জেগে নিজেই মিঠাই বানায়। সকালে ভ্যানে মিঠাইয়ের ডালা সাজিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের মহিষাবাড়ি গ্রামের একটি রাস্তায় দেখা মিলল লিটনের। ভ্যানে জিলাপি, নিমকি, মিষ্টি, লাড্ডু, বুন্দিয়ার ডালা সাজিয়ে রেখেছে সে। পরনে তার ময়লা জামা-কাপড়। মিঠাই কিনতে ভিড় জমিয়েছে গ্রামের শিশু-কিশোর ও গৃহবধূরা।
লিটন জানায়, অভাবের সংসার। চার ভাইবোনই লেখাপড়া করে। বাবার রোজগার দিয়ে সংসারের খরচই চলে না, পড়ার খরচ জোগাবে কোত্থেকে! ‘বড় হয়ে সরকারি চাকরি করে সংসারের অভাব জয়ের স্বপ্ন দেখি সারাক্ষণ’ বলল লিটন। মিঠাই বানানো শিখলে কীভাবে— জানতে চাইলে সে বলে, বছর দুই আগে প্রতিবেশী নারায়ণচন্দ্রের কাছে মিঠাই বানানোর হাতেখড়ি। এরপর বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসায় নামে সে। ভার বহনে কষ্ট হয়, তাই অল্প কিছু টাকায় একটা ভ্যান কিনে নিয়েছে। ধানের বদলেও মিঠাই বেচে লিটন। প্রতিদিন চার-পাঁচ মণ ধান হয়। সেই ধান বেচে শ পাঁচেক টাকা লাভ থাকে। এভাবে স্কুল ছুটির ফাঁকে মিঠাই বেচে এক মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা হাতে জমে তার। লিটন বলে, ‘লাভের টাকায় মা-বাবার শাড়ি-লুঙ্গি আর ছোট ভাই-বোনদের জন্য নতুন জামা কিনব। বাকিটা পড়ার খরচের জন্য রেখে দেব।’
মিঠাই কিনতে আসা গৃহবধূ ফাতেমা বেগম বলেন, ‘এই বয়সে ছেলেটা ফেরিওয়ালার কাজ করছে। দেখে খুব মায়া হয়।’
মহিষাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রকি ও মুশফিল বলে, ‘আমরা সারা দিন কত হইচই করি, খেলাধুলা করি। আর লিটন ফেরিওয়ালার কাজ করে। ওর জন্য খুব খারাপ লাগে।’
বালুয়াহাট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘স্কুল ছুটির ফাঁকে অনেক শিক্ষার্থীই ঘুরে বেরিয়ে সময় কাটায়। ছুটির ফাঁকে ফেরিওয়ালার কাজ বেছে নিয়েছে আমার ছাত্র লিটন। বিষয়টি জেনে কষ্ট পেলাম। ওর স্বপ্ন পূরণে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যতটা সহযোগিতা করা যায় করব।’
আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া
No comments