রাজনীতি-তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি আদৌ প্রয়োজন? by এমএ করীম
গণতন্ত্রকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে লাঠিটির ওপর ভর না করে তার নিজের শক্তির ওপর ছেড়ে দিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া আমাদের গণতন্ত্রমনা প্রত্যেক মানুষের উচিত হবে। যত তাড়াতাড়ি তা করা যাবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক রাজনৈতিক মাঠ এখন সরব।
সর্বত্রই বিতর্ক চলছে। বিষয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ইস্যু নিয়ে বিরোধী দল হরতাল পালন করল গত ৫ জুন। পত্রপত্রিকার এ নিয়ে চলছে প্রচুর লেখালেখি। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয়, তিন দশকেও আমাদের দেশের রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের সবার জানা আছে, আশির দশকের মাঝামাঝি জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় হিসেবে এ ধারণার উৎপত্তি। তখন স্পষ্টত সে সরকারের তত্ত্বাবধানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব ছিল না বলেই এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে সামরিক শাসনের (প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ) কারণে এবং দেশে গণতান্ত্রিকভাবে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি না হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চিন্তা রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। তার পরবর্তী ঘটনা সবার জানা। মাগুরার উপনির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিতাকে আরও দৃঢ় করে।
১৯৯৬ সালে আন্দোলনের ফলে মার্চে সংবিধানে ত্রয়োদেশ সংশোধনী আনে (তড়িঘড়ি করে) তদানীন্তন ক্ষমতাসীন সরকার। তার আগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন।' ১৯৯৮ সালে তিন আইনজীবী এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। 'কনসেপ্ট' ভালো হলেও ব্যবস্থাটি আদৌ সংবিধানসম্মত ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না সে ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছিল, নির্বাচিত সরকারকে অবিশ্বাস করে যে ১১ জনকে কোটি কোটি মানুষের মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বাছাই করা হবে তারাই যে 'বিশ্বাসযোগ্য' ও মনে-প্রাণে 'নিরপেক্ষ' হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? যে কোনো আইন, ধারণা বা প্রতিষ্ঠানের ভালো-মন্দ নির্ভর করে তার প্রয়োগ কীভাবে করা হবে এর ওপর। প্রয়োগ সংক্রান্ত বিচ্যুতির কারণেই এ ব্যবস্থা বিতর্কিত হয়ে পড়ে। তাই দেখতে পাই বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যখন প্রধান উপদেষ্টা তখন জেনারেল নাসিম ক্যু করার চেষ্টা করেন। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন প্রধান উপদেষ্টা (ক্ষমতা গ্রহণের রাতেই) ১৩ সচিবকে বদলি করে বসেন। ২০০৬ সালে এসে বাধে গোল।
এ আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি বিষয়ে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। তা হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি 'আপদকালীন' ব্যবস্থাকে 'স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত' করায় নির্বাচন করা সম্ভব হলেও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও সংহত করার জন্য প্রয়োজনীয় ইনস্টিটিউশন তৈরি করার তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, এমনকি চেষ্টাও করা হয়নি। ফলে যে আস্থার অভাব আগে ছিল তা এখনও সক্রিয় ।
দু'একটা নির্বাচন বিতর্কের ঊধর্ে্ব থাকলেও অন্যসব নির্বাচনকে ষড়যন্ত্র, নীলনকশার নির্বাচন বলে দাবি করে আসছে সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দল। আগেই বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বিতর্কের ঊধর্ে্ব ছিল না। যারা ক্ষমতাসীন তারা পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়কে নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন, বিচার বিভাগ নিজেদের অনুকূলে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করে। তার সবই যে একেবারে মিথ্যা তাও অবশ্য নয়। ২০০৬ সালে যে গোল বাধে তার ক্ষেত্র অবশ্য তৈরি করেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিএনপির পছন্দের লোক বিচারপতি কেএম হাসান যাতে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধাযক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব লাভ করতে পারেন সে সুযোগ সৃষ্টির জন্য আইন সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ থেকে বৃদ্ধি করে ৬৭ বছর করেন। সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হতে দেওয়া বা না থাকার কারণে দাবি-পাল্টা দাবিসহ পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন দল তাদের দলীয় প্রেসিডেন্টকে কোনো রকম ঐকমত্য ছাড়াই সংবিধানের সব বিধি যাচাই না করে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করে। তখন আপসের সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। পরে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশে বহুল আলোচিত 'ওয়ান-ইলেভেন'-এর সূচনা হয়। ফখরুদ্দীন আহমদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বাধীন (সেনাসমর্থিত) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের পরিবর্তে ইমার্জেন্সি দিয়ে দু'বছর দেশ শাসন করে। ফলে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। দু'বছর ১৫ কোটি মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। শুরু হয় ধরপাকড়। সব রাজনীতিককে বলা হয় দুর্নীতিবাজ, সব ব্যবসায়ী অসৎ এবং তাদের (পছন্দমতো) ধরপাকড়, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের কথাও শোনা গেছে। ইচ্ছামতো তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া হয়েছে। সেগুলো সব সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়েছিল কি? ব্যবসায়ীদের হয়রানি করার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধের উপক্রম হয়েছিল এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। বলতে গেলে দেশ মহাসংকটে পতিত হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে বন্দি করে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছিল আর পতিত রাজনীতিকদের সামনের সারিতে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সম্ভবত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শাসন আমলের কথা। তখনকার মন্ত্রিসভার সদস্যদের একজনের কাছ থেকে শোনা। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তারা ক'জন মিলে ভারতের এ মান্যবর প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাদের সাফল্যের কথা (তার ভাষায়) বর্ণনা করছিলেন। বাজপেয়ি কবি ও স্বল্পভাষী। তাদের কথা তিনি মনোযোগের সঙ্গে চোখ বুজে শুনছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি চোখ খুলে অত্যন্ত দৃঢ় ও শান্তভাবে একটি মাত্র প্রশ্ন করলেন, 'তোমাদের দেশে কি নির্বাচন কমিশন নেই?' মন্ত্রিসভার সেই সদস্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'তখন এ খুবই জ্ঞানী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝিনি। এমনকি পরবর্তীকালে এ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আমাদের দেশে যে মহাসংকট সৃষ্টি করতে পারে তাও অনুধাবন করিনি। ক্ষমতায় থাকলে বোধহয় এটিই স্বাভাবিক।' নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর মানুষের আস্থ্থা ও সমর্থন আরও নড়বড়ে হয়ে যায় যখন শোনা যায় কোনো কোনো সাবেক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কোনো সম্মানজনক ব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্রকে সংহত করার জন্য এ ব্যবস্থা সহায়কও নয়। ফলে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ ব্যবস্থা চলতে পারে না।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল। ইউরোপ, অমেরিকার কথা ছেড়েই দিলাম। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথাই বলি। ভারতের সমস্যাদি এবং আমাদের দেশের সমস্যাদি প্রায় অভিন্ন। ওখানেও দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে মতবাদের রাজনীতি আছে। তা সত্ত্বেও ৬৪ বছর ধরে সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়ে আসছে। এত বিশাল একটি দেশ, এত মত, এত পথ, সন্ত্রাস, এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী মহল ও অনেক রাজনৈতিক দল থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সেখানে গণতন্ত্র টিকে আছে তা ভাবার বিষয়। ২০১১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী ১২১ কোটি মানুষের দেশ ভারতের ২৮টি রাজ্যে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন হয়ে আসছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কি বিজয়ী, কি বিজেতা_ সবাইকে সে ফল মেনে নিতে দেখা গেছে। নির্বাচনের ফল নিয়ে কখনও ভারতবর্ষে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। এ নিয়ে কখনও কোনো রাজনৈতিক সংকটও সৃষ্টি হয়নি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। সে সময় এ নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদের ধ্বনিও তাদের কণ্ঠে শোনা যায়নি। অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের পরাজয় ঘটেছে। কোনো উচ্চবাচ্য না করেই তারা ক্ষমতা ছেড়ে চলে গেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়। মোট কথা, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী ক্ষমতার রদবদল হবে। এটিই গণতন্ত্রের শিক্ষা। এটি হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এখানেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে দেখা দেয়। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার পড়ে কি? তাই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এ জন্য আমি মনে করি, এক. নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণর্ স্বায়ত্তশাসিত হবে এবং সব নির্বাহী হস্তক্ষেপমুক্ত থাকবে। দুই. নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় থাকবে। তিন. নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব লোকবল নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে। চার. নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া ও ফল ঘোষণা পর্যন্ত আইন-শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। পাঁচ. অর্থায়ন নিশ্চিত করে এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং তার জন্য সংসদে আইন প্রণয়ন করতে হবে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব নির্বাচন কমিশনারকেই সার্চ কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের পর নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার লক্ষ্যই হবে প্রধান, দলীয় বিবেচনা নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে দলীয় তথা নির্বাচন কমিশনের অধীন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। আমাদের সে পথেই চলতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় একটি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। এটি অনেকের চোখে পড়লেও এড়িয়ে যান। এ প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার করে যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস পান, তার ইতি টানা আমাদের সবার স্বার্থেই প্রয়োজন। গণতন্ত্রকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে লাঠিটির ওপর ভর না করে তার নিজের শক্তির ওপর ছেড়ে দিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া আমাদের গণতন্ত্রমনা প্রত্যেক মানুষের উচিত হবে। যত তাড়াতাড়ি তা করা যাবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
অধ্যাপক ডা. এমএ করীম : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কলাম লেখক
১৯৯৬ সালে আন্দোলনের ফলে মার্চে সংবিধানে ত্রয়োদেশ সংশোধনী আনে (তড়িঘড়ি করে) তদানীন্তন ক্ষমতাসীন সরকার। তার আগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন।' ১৯৯৮ সালে তিন আইনজীবী এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। 'কনসেপ্ট' ভালো হলেও ব্যবস্থাটি আদৌ সংবিধানসম্মত ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না সে ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছিল, নির্বাচিত সরকারকে অবিশ্বাস করে যে ১১ জনকে কোটি কোটি মানুষের মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বাছাই করা হবে তারাই যে 'বিশ্বাসযোগ্য' ও মনে-প্রাণে 'নিরপেক্ষ' হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? যে কোনো আইন, ধারণা বা প্রতিষ্ঠানের ভালো-মন্দ নির্ভর করে তার প্রয়োগ কীভাবে করা হবে এর ওপর। প্রয়োগ সংক্রান্ত বিচ্যুতির কারণেই এ ব্যবস্থা বিতর্কিত হয়ে পড়ে। তাই দেখতে পাই বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যখন প্রধান উপদেষ্টা তখন জেনারেল নাসিম ক্যু করার চেষ্টা করেন। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন প্রধান উপদেষ্টা (ক্ষমতা গ্রহণের রাতেই) ১৩ সচিবকে বদলি করে বসেন। ২০০৬ সালে এসে বাধে গোল।
এ আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি বিষয়ে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। তা হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি 'আপদকালীন' ব্যবস্থাকে 'স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত' করায় নির্বাচন করা সম্ভব হলেও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও সংহত করার জন্য প্রয়োজনীয় ইনস্টিটিউশন তৈরি করার তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, এমনকি চেষ্টাও করা হয়নি। ফলে যে আস্থার অভাব আগে ছিল তা এখনও সক্রিয় ।
দু'একটা নির্বাচন বিতর্কের ঊধর্ে্ব থাকলেও অন্যসব নির্বাচনকে ষড়যন্ত্র, নীলনকশার নির্বাচন বলে দাবি করে আসছে সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দল। আগেই বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বিতর্কের ঊধর্ে্ব ছিল না। যারা ক্ষমতাসীন তারা পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়কে নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন, বিচার বিভাগ নিজেদের অনুকূলে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করে। তার সবই যে একেবারে মিথ্যা তাও অবশ্য নয়। ২০০৬ সালে যে গোল বাধে তার ক্ষেত্র অবশ্য তৈরি করেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিএনপির পছন্দের লোক বিচারপতি কেএম হাসান যাতে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধাযক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব লাভ করতে পারেন সে সুযোগ সৃষ্টির জন্য আইন সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ থেকে বৃদ্ধি করে ৬৭ বছর করেন। সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হতে দেওয়া বা না থাকার কারণে দাবি-পাল্টা দাবিসহ পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন দল তাদের দলীয় প্রেসিডেন্টকে কোনো রকম ঐকমত্য ছাড়াই সংবিধানের সব বিধি যাচাই না করে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করে। তখন আপসের সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। পরে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশে বহুল আলোচিত 'ওয়ান-ইলেভেন'-এর সূচনা হয়। ফখরুদ্দীন আহমদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বাধীন (সেনাসমর্থিত) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের পরিবর্তে ইমার্জেন্সি দিয়ে দু'বছর দেশ শাসন করে। ফলে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। দু'বছর ১৫ কোটি মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। শুরু হয় ধরপাকড়। সব রাজনীতিককে বলা হয় দুর্নীতিবাজ, সব ব্যবসায়ী অসৎ এবং তাদের (পছন্দমতো) ধরপাকড়, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের কথাও শোনা গেছে। ইচ্ছামতো তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া হয়েছে। সেগুলো সব সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়েছিল কি? ব্যবসায়ীদের হয়রানি করার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধের উপক্রম হয়েছিল এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। বলতে গেলে দেশ মহাসংকটে পতিত হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে বন্দি করে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছিল আর পতিত রাজনীতিকদের সামনের সারিতে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সম্ভবত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শাসন আমলের কথা। তখনকার মন্ত্রিসভার সদস্যদের একজনের কাছ থেকে শোনা। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তারা ক'জন মিলে ভারতের এ মান্যবর প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাদের সাফল্যের কথা (তার ভাষায়) বর্ণনা করছিলেন। বাজপেয়ি কবি ও স্বল্পভাষী। তাদের কথা তিনি মনোযোগের সঙ্গে চোখ বুজে শুনছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি চোখ খুলে অত্যন্ত দৃঢ় ও শান্তভাবে একটি মাত্র প্রশ্ন করলেন, 'তোমাদের দেশে কি নির্বাচন কমিশন নেই?' মন্ত্রিসভার সেই সদস্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'তখন এ খুবই জ্ঞানী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝিনি। এমনকি পরবর্তীকালে এ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আমাদের দেশে যে মহাসংকট সৃষ্টি করতে পারে তাও অনুধাবন করিনি। ক্ষমতায় থাকলে বোধহয় এটিই স্বাভাবিক।' নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর মানুষের আস্থ্থা ও সমর্থন আরও নড়বড়ে হয়ে যায় যখন শোনা যায় কোনো কোনো সাবেক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কোনো সম্মানজনক ব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্রকে সংহত করার জন্য এ ব্যবস্থা সহায়কও নয়। ফলে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ ব্যবস্থা চলতে পারে না।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল। ইউরোপ, অমেরিকার কথা ছেড়েই দিলাম। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথাই বলি। ভারতের সমস্যাদি এবং আমাদের দেশের সমস্যাদি প্রায় অভিন্ন। ওখানেও দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে মতবাদের রাজনীতি আছে। তা সত্ত্বেও ৬৪ বছর ধরে সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়ে আসছে। এত বিশাল একটি দেশ, এত মত, এত পথ, সন্ত্রাস, এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী মহল ও অনেক রাজনৈতিক দল থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সেখানে গণতন্ত্র টিকে আছে তা ভাবার বিষয়। ২০১১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী ১২১ কোটি মানুষের দেশ ভারতের ২৮টি রাজ্যে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন হয়ে আসছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কি বিজয়ী, কি বিজেতা_ সবাইকে সে ফল মেনে নিতে দেখা গেছে। নির্বাচনের ফল নিয়ে কখনও ভারতবর্ষে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। এ নিয়ে কখনও কোনো রাজনৈতিক সংকটও সৃষ্টি হয়নি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। সে সময় এ নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদের ধ্বনিও তাদের কণ্ঠে শোনা যায়নি। অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের পরাজয় ঘটেছে। কোনো উচ্চবাচ্য না করেই তারা ক্ষমতা ছেড়ে চলে গেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়। মোট কথা, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী ক্ষমতার রদবদল হবে। এটিই গণতন্ত্রের শিক্ষা। এটি হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এখানেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে দেখা দেয়। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার পড়ে কি? তাই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এ জন্য আমি মনে করি, এক. নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণর্ স্বায়ত্তশাসিত হবে এবং সব নির্বাহী হস্তক্ষেপমুক্ত থাকবে। দুই. নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় থাকবে। তিন. নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব লোকবল নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে। চার. নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া ও ফল ঘোষণা পর্যন্ত আইন-শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। পাঁচ. অর্থায়ন নিশ্চিত করে এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং তার জন্য সংসদে আইন প্রণয়ন করতে হবে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব নির্বাচন কমিশনারকেই সার্চ কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের পর নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার লক্ষ্যই হবে প্রধান, দলীয় বিবেচনা নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে দলীয় তথা নির্বাচন কমিশনের অধীন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। আমাদের সে পথেই চলতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় একটি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। এটি অনেকের চোখে পড়লেও এড়িয়ে যান। এ প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার করে যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস পান, তার ইতি টানা আমাদের সবার স্বার্থেই প্রয়োজন। গণতন্ত্রকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে লাঠিটির ওপর ভর না করে তার নিজের শক্তির ওপর ছেড়ে দিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া আমাদের গণতন্ত্রমনা প্রত্যেক মানুষের উচিত হবে। যত তাড়াতাড়ি তা করা যাবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
অধ্যাপক ডা. এমএ করীম : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কলাম লেখক
No comments