অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিবিএসের প্রতিবেদন পেশ-জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৩২ শতাংশ by আরিফুর রহমান

চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছিল, তা অর্জিত হচ্ছে না। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩২ শতাংশে দাঁড়াতে পারে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যা .৬৮ শতাংশ কম। প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত হার অর্জন না হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, চলতি বছরে আউশ, আমন ও গমের উৎপাদন গত বছরের চেয়ে তেমন বেশি হয়নি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প খাতে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক খাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় কম। সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৫ শতাংশের নিচে। এসব কারণে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিবিএসের নথিতে এসব তথ্য রয়েছে।
চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানোর কথা জানালেও এ বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিবিএস মহাপরিচালক শাহজাহান আলী মোল্লা। গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের আরো অনেক সংস্থা করে থাকে। সরকার ইচ্ছা করলে বিবিএসের তথ্য গ্রহণ করতেও পারে, আবার না-ও করতে পারে।
বিবিএস মহাপরিচালক জানান, গত বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬.৬৬ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬.৭১ শতাংশে হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, কৃষিতে আউশ ও আমনের বাম্পার ফলন হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ ছাড়া অবকাঠামো, ম্যানুফ্যাকচারিং ও নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি। এসব কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না বলে অনেক আগেই পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঢাকা সফররত আইএমএফের মিশনপ্রধান এবং দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান ডেভিড কাউয়েন গত ২৫ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে এ পূর্বাভাস দেন। প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমে যাওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ডেভিড কাউয়েন বলেছিলেন, বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধিও আগের চেয়ে কমে এসেছে। বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতিতে চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে।
এদিকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে। ম্যানিলাভিত্তিক এ সংস্থাটি গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এডিবির স্থানীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, চলতি অর্থবছরে ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি চাপের মধ্যে রয়েছে। তেল আমদানির জন্য ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল আমদানি ও আশানুরূপ রপ্তানি না হওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। এসব কারণে প্রবৃদ্ধি খুবই মন্থর হচ্ছে। এসব কারণে সরকারের কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হবে না বলে পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে এডিবি। বিশ্বব্যাংক জানুয়ারিতে বলেছিল, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬.১ শতাংশ হারে বাড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে প্রবৃদ্ধি গত বছরের ৭ শতাংশ থেকে কমে এবার ৬-এ দাঁড়াবে। শ্রীলঙ্কায় প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৮, পাকিস্তানে ৪ ও নেপালে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জন নিয়ে গত কয়েক মাস অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অর্থমন্ত্রী বরাবরের মতোই বলে আসছেন, ৭ শতাংশ না হলেও এর কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির পূর্বাভাসকে তিনি অমূলক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
চলতি বাজার মূল্যে গত অর্থবছরে (২০১০-১১) বাংলাদেশের জিডিপি, অর্থাৎ দেশের ভেতরে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও সেবা দেওয়া হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ছিল সাত লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এই জিডিপিতে মোট ১৫টি খাতের উৎপাদন হিসাব করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, যেকোনো দেশের জিডিপি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ১৯৯৩ সালের সিস্টেম অফ ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট (এসএনএ) অনুযায়ী ১৫টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, যা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। জিডিপি নির্ধারণে এটাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। খাতগুলো হচ্ছে- কৃষি ও বনজ, মৎস্য সম্পদ, খনিজ ও খনন, শিল্পোৎপাদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সম্পদ, নির্মাণ, পাইকারি ও খুচরা বিপণন, হোটেল ও রেস্তরাঁ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানিক সেবা, রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবসা, লোক প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা।
খাতগুলোকে আবার বৃহত্তর তিনটি খাতে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো- সার্বিক কৃষি, সার্বিক শিল্প ও সার্বিক সেবা। জিডিপিতে এদের অবদান যথাক্রমে ১৯.৯৫ শতাংশ, ২৯.৯৩ ও ৪৯.৭২ শতাংশ।

No comments

Powered by Blogger.