গন্তব্য ঢাকা-পরবাসীর কান্না কি ঘুচবে না? by সিদরাতুল সিনড্রেলা
‘জমি-জায়গা হারানোর যে কষ্ট, তা সে-ই বুঝতে পারে যার জমি-জায়গা বা কোনো অবলম্বন হারিয়েছে। আগে নিজেদের কত কী ছিল। জমি, বাড়ি, গাছপালা, পুকুর। আজ তো আর কিছুই নেই। নিজেদের গাছে যে পরিমাণ নারকেল, বরই, আম ধরত, তা নিজেরা খেয়ে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতাম। তখন দিতেও ভালো লাগত।
কিন্তু এখন নিজেরাই পাই না, অন্যদের দিব কী? সেসব সুখের দিনের কথা যখন মনে পড়ে, তখন বুক ফেটে কান্না আসে।’ নিজের অতীত দিনের সুখস্মৃতি কল্পনা করে সত্যি সত্যি দুচোখের কোণে জল জমে গিয়েছিল সেন্টু চাকলাদারের।
নিজের জমিতে সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বছর শেষে যে ফসল আসে, তাতে যে আনন্দ, তা কি আর কোনো কিছুতে মেলে? নিজেদের গরুর দুধ, গাছের ফল যতটুকু সুমিষ্ট, তা কি আর অন্য কিছুতে হয়? কিন্তু সর্বনাশা নদী কি অন্য কিছু বোঝে? সে যখন উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখন তো জীব, জড়, গাছপালা কিছুই বোঝে না। ভাসিয়ে নিয়ে যায় একটু একটু করে সবকিছু। সেন্টু চাকলাদারদেরও সব ছিল। একটু একটু করে সবই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সর্বনাশা পদ্মা। গ্রাম ছিল তাঁর দোহারে। গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার ইচ্ছে তাঁর ছিল না, কিন্তু একটু একটু করে যখন জমি, গাছ, বাড়ি, গরু-ছাগল সবকিছু নদীতে তলিয়ে গেল, তখন কিছু করার আশায় পথে পা বাড়াতেই হলো।
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের সামনে ফুটপাত ধরে হাঁটতে গেলে বিশেষত মেয়েরা থমকে দাঁড়াবেই। তাদের শখের সাজসজ্জার অনেক উপকরণ নিয়ে সার বেঁধে বসে রয়েছেন অনেক বিক্রেতা। সেন্টু চাকলাদার তাঁদেরই একজন। তিনিও মেয়েদের রূপসজ্জার উপকরণ নিয়ে এই ফুটপাতেই বসেন সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।
নদীতে যখন একটু একটু করে ভেসে গেছে সবকিছু, তখন একটি প্রেসে কাজ নিয়ে সেন্টু চাকলাদার চলে আসেন ঢাকায়। তখন কাজ করেছেন পুরান ঢাকায়। কিন্তু প্রেসের কাজ কি আর সুখের হয়। কাজের সময় ঠিকই কাজ হয়, বেতনের সময় হলেই শুরু হয় নানা বাহানা। কাজ ছেড়ে চলে এলেন মিরপুরের একটি প্রেসে কাজ নিয়ে। তখন এই মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন প্রিন্টিংয়ের কাজ করতেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের লিখন, কী আর করা যাবে। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল সেই প্রেস। সেন্টু চাকলাদারের তখন মাথায় বাজ। শুরু করলেন রূপসজ্জার উপকরণ বিক্রির কাজ। এখনো করে চলেছেন তিনি তা।
মা মারা গেছেন কয়েক বছর হলো। বাবা মারা গেছেন তারও আগে। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে ছোট সেন্টু চাকলাদার। এখন তো স্ত্রী রীতা আর পাঁচ বছরের ছোট ছেলে মেহেদী হাসানকে নিয়েই তাঁর সংসার। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি সেন্টু চাকলাদার। তাঁর খুব ইচ্ছে, তাঁর ছেলেটি পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে, চাকরি করবে।
‘নাহ্, এভাবে আর ভালো লাগে না। এ জীবন ফুটপাতের জীবন। প্রতিনিয়ত ভয়ের জীবন। না জানি কখন পুলিশ আসবে। উঠিয়ে দেবে ফুটপাত থেকে। দৌড়ে পালাতে হবে।’ এভাবেই নিজের অনিশ্চিত জীবনের কথা বর্ণনা করছিলেন সেন্টু চাকলাদার।
‘যদি পড়াশোনা করতাম, তাহলে হয়তো এখানে এভাবে বসে কাজ করতে হতো না। কোনো একটা ভালো স্থানে কাজ করতাম। পুলিশের ভয় থাকত না।’ বললেন সেন্টু চাকলাদার।
যখন যে ক্রেতা আসে, তখনই তার সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল আচরণ করেন সেন্টু চাকলাদার। কেননা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সুসম্পর্ক না গড়ে উঠলে জিনিস কেনা-বেচা হবে না। ভালো ব্যবহার না করলে কেউ আমার কাছে আসবে না।’
১০ বছর হলো ঢাকায় আছেন সেন্টু চাকলাদার। বিয়ে করেছেন তারও পরে। দোহারেই নদীর পাড়ে বাড়ি স্ত্রী রীতার। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। এখন তো আছেন মিরপুর ১ নম্বরে। যে ব্যবসা করেন, তাতে দিনে গড়ে ২০০-২৫০ টাকা লাভ হয়। এতে কোনোভাবে দিন চলে যায়। কিন্তু ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বলে তো আর স্বপ্ন দেখতে বাধা নেই। ‘না, আমি যদি বলি চাঁদে যাব, তাহলে তো আর হবে না। তাই ছোট স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি, যদি কোনো একটা মার্কেটে ছোট একটা দোকান দিতে পারি, তাহলে হয়তো ভদ্রভাবে জীবন যাপন করতে পারব।’ বললেন সেন্টু চাকলাদার।
মা-বাবা তো মারা গেছেন। স্ত্রী নিজের কাছে। বোন দুজন থাকে সাভারে। গ্রামে থাকা বলতে থাকে একটিমাত্র ভাই ও তাঁর পরিবার। গ্রামে কখনো খুব ঘন ঘন যাওয়া হয়, আবার কখনো অনেক দিন পর। সেন্টু চাকলাদার বলেন, ‘গ্রামে তো অল্প একটু এখনো জায়গা আছে, সেটাই চাষ করে ভাই খায়। আমি আর ওর মধ্যে গিয়ে ভাগ বসাতে চাই না, তবে যদি আবার কখনো নদীর জল সরে যায়, যদি আমাদের হারানো জমি-জায়গা আবার জেগে ওঠে, তবে আর এক মুহূর্তও থাকব না ঢাকায়।’ সেন্টু চাকলাদারেরা জানেন না, কেন সর্বনাশা নদী তাঁদের ঘর ছেড়ে পরবাসী করে? কেনই বা সুখের জীবন ছেড়ে যেতে বাধ্য করে? আবার কবে ফিরিয়ে দেবে নিজেদের ঘরবাড়ি, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য।
নিজের জমিতে সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বছর শেষে যে ফসল আসে, তাতে যে আনন্দ, তা কি আর কোনো কিছুতে মেলে? নিজেদের গরুর দুধ, গাছের ফল যতটুকু সুমিষ্ট, তা কি আর অন্য কিছুতে হয়? কিন্তু সর্বনাশা নদী কি অন্য কিছু বোঝে? সে যখন উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখন তো জীব, জড়, গাছপালা কিছুই বোঝে না। ভাসিয়ে নিয়ে যায় একটু একটু করে সবকিছু। সেন্টু চাকলাদারদেরও সব ছিল। একটু একটু করে সবই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সর্বনাশা পদ্মা। গ্রাম ছিল তাঁর দোহারে। গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার ইচ্ছে তাঁর ছিল না, কিন্তু একটু একটু করে যখন জমি, গাছ, বাড়ি, গরু-ছাগল সবকিছু নদীতে তলিয়ে গেল, তখন কিছু করার আশায় পথে পা বাড়াতেই হলো।
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের সামনে ফুটপাত ধরে হাঁটতে গেলে বিশেষত মেয়েরা থমকে দাঁড়াবেই। তাদের শখের সাজসজ্জার অনেক উপকরণ নিয়ে সার বেঁধে বসে রয়েছেন অনেক বিক্রেতা। সেন্টু চাকলাদার তাঁদেরই একজন। তিনিও মেয়েদের রূপসজ্জার উপকরণ নিয়ে এই ফুটপাতেই বসেন সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।
নদীতে যখন একটু একটু করে ভেসে গেছে সবকিছু, তখন একটি প্রেসে কাজ নিয়ে সেন্টু চাকলাদার চলে আসেন ঢাকায়। তখন কাজ করেছেন পুরান ঢাকায়। কিন্তু প্রেসের কাজ কি আর সুখের হয়। কাজের সময় ঠিকই কাজ হয়, বেতনের সময় হলেই শুরু হয় নানা বাহানা। কাজ ছেড়ে চলে এলেন মিরপুরের একটি প্রেসে কাজ নিয়ে। তখন এই মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন প্রিন্টিংয়ের কাজ করতেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের লিখন, কী আর করা যাবে। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল সেই প্রেস। সেন্টু চাকলাদারের তখন মাথায় বাজ। শুরু করলেন রূপসজ্জার উপকরণ বিক্রির কাজ। এখনো করে চলেছেন তিনি তা।
মা মারা গেছেন কয়েক বছর হলো। বাবা মারা গেছেন তারও আগে। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে ছোট সেন্টু চাকলাদার। এখন তো স্ত্রী রীতা আর পাঁচ বছরের ছোট ছেলে মেহেদী হাসানকে নিয়েই তাঁর সংসার। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি সেন্টু চাকলাদার। তাঁর খুব ইচ্ছে, তাঁর ছেলেটি পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে, চাকরি করবে।
‘নাহ্, এভাবে আর ভালো লাগে না। এ জীবন ফুটপাতের জীবন। প্রতিনিয়ত ভয়ের জীবন। না জানি কখন পুলিশ আসবে। উঠিয়ে দেবে ফুটপাত থেকে। দৌড়ে পালাতে হবে।’ এভাবেই নিজের অনিশ্চিত জীবনের কথা বর্ণনা করছিলেন সেন্টু চাকলাদার।
‘যদি পড়াশোনা করতাম, তাহলে হয়তো এখানে এভাবে বসে কাজ করতে হতো না। কোনো একটা ভালো স্থানে কাজ করতাম। পুলিশের ভয় থাকত না।’ বললেন সেন্টু চাকলাদার।
যখন যে ক্রেতা আসে, তখনই তার সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল আচরণ করেন সেন্টু চাকলাদার। কেননা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সুসম্পর্ক না গড়ে উঠলে জিনিস কেনা-বেচা হবে না। ভালো ব্যবহার না করলে কেউ আমার কাছে আসবে না।’
১০ বছর হলো ঢাকায় আছেন সেন্টু চাকলাদার। বিয়ে করেছেন তারও পরে। দোহারেই নদীর পাড়ে বাড়ি স্ত্রী রীতার। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। এখন তো আছেন মিরপুর ১ নম্বরে। যে ব্যবসা করেন, তাতে দিনে গড়ে ২০০-২৫০ টাকা লাভ হয়। এতে কোনোভাবে দিন চলে যায়। কিন্তু ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বলে তো আর স্বপ্ন দেখতে বাধা নেই। ‘না, আমি যদি বলি চাঁদে যাব, তাহলে তো আর হবে না। তাই ছোট স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি, যদি কোনো একটা মার্কেটে ছোট একটা দোকান দিতে পারি, তাহলে হয়তো ভদ্রভাবে জীবন যাপন করতে পারব।’ বললেন সেন্টু চাকলাদার।
মা-বাবা তো মারা গেছেন। স্ত্রী নিজের কাছে। বোন দুজন থাকে সাভারে। গ্রামে থাকা বলতে থাকে একটিমাত্র ভাই ও তাঁর পরিবার। গ্রামে কখনো খুব ঘন ঘন যাওয়া হয়, আবার কখনো অনেক দিন পর। সেন্টু চাকলাদার বলেন, ‘গ্রামে তো অল্প একটু এখনো জায়গা আছে, সেটাই চাষ করে ভাই খায়। আমি আর ওর মধ্যে গিয়ে ভাগ বসাতে চাই না, তবে যদি আবার কখনো নদীর জল সরে যায়, যদি আমাদের হারানো জমি-জায়গা আবার জেগে ওঠে, তবে আর এক মুহূর্তও থাকব না ঢাকায়।’ সেন্টু চাকলাদারেরা জানেন না, কেন সর্বনাশা নদী তাঁদের ঘর ছেড়ে পরবাসী করে? কেনই বা সুখের জীবন ছেড়ে যেতে বাধ্য করে? আবার কবে ফিরিয়ে দেবে নিজেদের ঘরবাড়ি, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য।
No comments