ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুর নামটি কি হারিয়ে যাবে? by শাহজাহান মিয়া

অপরিচিত কারো সঙ্গে আলাপচারিতার কোনো এক পর্যায়ে কেউ যদি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারে সুসংগতিপূর্ণ প্রশ্নটি করে জানতে চান যে আমার বাড়ি কোন জেলায়- নিজের অজান্তেই মুখ থেকে প্রথমে বেরিয়ে আসে বিক্রমপুর, মানে মুন্সীগঞ্জ। অর্থাৎ কথাবার্তা, চলনে-বলনে বিক্রমপুর নামটি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে এমন একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে, যা প্রকাশ করা আসলেই দুরূহ।


কোনো ভণিতা বা বাহানা নয়। বৃষ্টির স্নিগ্ধ-শীতল ধারা যেমন মনেপ্রাণে প্রশান্তি বইয়ে দেয়, তেমনি বিক্রমপুর নামটি আমাদের হৃদয়ের গভীর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এসে আমাদের মনের মধ্যে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। এ সত্যটি শুধু আমার নিজের বেলায়ই নয়, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারি, মুন্সীগঞ্জ জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বেলায়ই এমনটি ঘটে বলে আমার বিশ্বাস। অবশ্যই মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরবাসীর একটি অংশের মানুষের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ নামটির প্রতিও বিশেষ টান থাকতে পারে। আর সেটাও কোনো দোষের নয়। বিক্রমপুর নামটি যেমন ইতিহাস প্রসিদ্ধ, তেমনি এ অঞ্চলের নাম মুন্সীগঞ্জ হওয়ার পেছনেও একটা ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। ১১ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিবেদিত 'জেলার নাম হোক মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর' শিরোনামে এই পত্রিকায় প্রকাশিত অত্যন্ত সুলিখিত ও হৃদয়গ্রাহী নিবন্ধটি আমাকেও বিষয়টি নিয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। মুক্তিযোদ্ধা ও কলম-পেষা এই অধম সাংবাদিকের নিবেদনটিও যদি আমাদের প্রাণপ্রিয় বিক্রমপুরবাসীর হৃদয়ের গভীরে কিছুটাও প্রেরণা সৃষ্টি করে, উৎসাহ জোগায়, তবে আমরা লাখো কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে দাবি করতে পারি, আবহমানকাল থেকে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের আবাসস্থল আমাদের প্রিয় বিক্রমপুরের নামটি মুন্সীগঞ্জ নামের সঙ্গে যুক্ত করে অবিলম্বে জেলার নাম মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর করে এলাকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাণের প্রত্যাশা পূরণ করা হোক।
বর্তমানে একমাত্র গজারিয়া উপজেলা ব্যতীত মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্য পাঁচটি উপজেলা ঐতিহাসিক বৃহত্তর বিক্রমপুরেরই অংশ। প্রাচীনকাল থেকেই অঞ্চলটি বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার জন্য এবং পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক প্রভাবের জন্য সুপরিচিত। এই এলাকায় বাংলার বহু কৃতী মানুষের জম্ম হয়েছে। সেই মহামতিদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর, জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন সেন, সি আর দাস, সরোজিনী নাইডু, বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসুসহ আরো অনেকে। আরো যাঁদের নাম করতে হয়, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কোরবান আলী, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিচারপতি কে এম হাসান, হুমায়ুন আজাদ, ইমদাদুল হক মিলন, ব্রজেন দাস, প্রফেসর বি করিম, শহীদ নিজামুদ্দিন আহমেদ, ফয়েজ আহমেদ, মাহবুবুল আলম, ড. মিজানুর রহমান শেলী, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী, ড. এম শাহ আলম ও মাহবুবে আলম। আরো রয়েছে অনেক নাম। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে যাবে বলে এখানেই থামতে হচ্ছে। অনেকের ধারণা, বিক্রমপুর নামটি বিক্রমাদিত্য থেকে এসেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, বিক্রমাদিত্য বলে কেউ ছিলেনই না। নামের উৎপত্তি যেভাবেই হয়ে থাকুক না কেন, বর্তমানে বিক্রমপুর অঞ্চলটির কোনো প্রশাসনিক স্বীকৃতি না পাওয়া খুবই দুঃখজনক। মুন্সীগঞ্জ জেলার বেশির ভাগ লোক নিজেদের বিক্রমপুরের অধিবাসী বলে মনে করে এবং তারা বিক্রমপুরের লোক বলেই নিজেদের পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করে। বিক্রমপুরের পশ্চিমে ছিল পদ্মা নদী, উত্তর ও পূর্বে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিণে আড়িয়াল খাঁ ও মেঘনা নদীর সংযোগস্থল। মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত এক বিস্তীর্ণ এলাকা বর্তমানে প্রাচীন বিক্রমপুরের অংশ হলেও বিক্রমপুরের আয়তন ছিল প্রায় ৯০০ বর্গমাইল। কিন্তু বর্তমানে পদ্মার ভাঙনে তছনছ হয়ে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩০০ বর্গমাইলের মতো। বিক্রমপুর পরগনা ছিল বাংলার সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিল্পের ক্ষেত্রে এক মহামূল্য সম্পদ। সেন বংশীয় পূর্বপুরুষ নিভুজ সেন, বীর সেন প্রমুখ রাজা দাক্ষিণাত্য থেকে বঙ্গে আগমন করেন এবং তাঁদের বংশধর বিক্রম সেনকেই বিক্রমপুর পরগনার প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়ে থাকে। মহারাজ বল্লাল সেন প্রাচীন বাংলাকে বরেন্দ্র, বাগরী, রাঢ়, বঙ্গ ও মিথিলা- এই পাঁচ ভাগে ভাগ করেন। বিক্রমপুর পরগনার বেশির ভাগ এলাকাই ঢাকা, ত্রিপুরা, ফরিদপুর ও নোয়াখালী জেলায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ৩০০ বছর আগ থেকেই কীর্তিনাশা পদ্মা ঐতিহাসিক বিক্রমপুরের বিরাট অংশ গ্রাস করতে করতে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক চেহারা ওলটপালট করে দেয়। পাল বংশের রাজত্ব নবম শতাব্দীতে শুরু হয়। রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল থেকে শুরু করে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাল বংশ বিক্রমপুর শাসন করে। পরবর্তী সময়ে সেন বংশোদ্ভূত বিক্রম সেনই বিক্রমপুর প্রতিষ্ঠা করেন। সেন রাজাদের শাসনামলেই বিক্রমপুরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। আর্থ-সামাজিক ও শিল্প-সংস্কৃতির ধারাবাহিক উন্নয়নও সে সময়ই হয়। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো প্রতিষ্ঠা সেন রাজাদেরই চিন্তার ফসল। সেন বংশীয় রাজাদের সময়ই বিক্রমপুরের রামপাল বাংলার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।
মুন্সীগঞ্জ জেলার নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি আছে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইদ্রাকপুর কেল্লার ফৌজদারের নামানুসারে ওই এলাকার নাম ছিল ইদ্রাকপুর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকালে রামপালের কাজী কসবা গ্রামের মুন্সী এনায়েত আলী সাহেবের জমিদারিভুক্ত হওয়ার পর ইদ্রাকপুর মুন্সীগঞ্জ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে। হিমাংশু মোহন চট্টোপাধ্যায়ের বই, ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৭৮১ সালের একটি মানচিত্রে দেখা যায় যে কালিগঙ্গা নদী এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এলাকাটিকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করেছিল। তখন বিক্রমপুর পূর্ব থেকে পশ্চিমে দৈর্ঘ্যে ছিল প্রায় ৪০ মাইল এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১০ মাইল। অব্যাহত নদীভাঙনে বিক্রমপুরের একটি বিরাট অংশ রাক্ষুসী পদ্মার পেটে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় বহু অমূল্য পুরাতাত্তি্বক নিদর্শন। মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাট অশোক দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় সমগ্র উপমহাদেশ শাসন করেছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্বে অবস্থিত ছিল আমাদের প্রিয় বিক্রমপুর। পরবর্তীকালে পাল রাজারা বিক্রমপুরে এসে এ অঞ্চল শাসন করেন। সেন রাজাদের অব্যাহত আক্রমণের মুখে পড়ে ১১৭৪ সালে পাল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেনের (শাসনকাল ১০৯৭-১১৬০) শাসনামলে উদ্ধার করা একটি তাম্রলিপিতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সেন রাজত্বের পুরোটা সময়ই বিক্রমপুর সেন রাজ্যের রাজধানী ছিল।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের লীলাভূমি বিক্রমপুর ছিল তৎকালীন বঙ্গদেশ বা আজকের বাংলাদেশের একটি অংশের প্রাণস্পন্দন। নবম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানদের বাঙালি জাতির বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে জাতিগত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা দখলের প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে তারা ছিল উদার। বিক্রমপুরে গড়ে উঠেছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ঐক্যধারা এবং সেই ঐক্যই প্রাচীন বঙ্গের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। শিক্ষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিদেশিদের আগ্রাসন থেকে এ অঞ্চলকে রক্ষায় বিক্রমপুরবাসী ছিল আপসহীন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে দুই বাঙালি সহোদর বিপ্লবী চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা তারই স্বাক্ষর বহন করে। সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহ ক্ষিপ্ত হয়ে তৃতীয়বার বিক্রমপুরের রাজধানী কেদার রায়ের প্রিতম দুর্গ জয় করেন। বিক্রমপুরের শৌর্য-বীর্য আমাদের জাতিসত্তাকে শত শত বছর লালন করেছে। হাজার বছরের চেতনা বিক্রমপুরবাসীকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছ্। শক্তি জুগিয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত ফারায়েজী আন্দোলন যখন ফরিদপুর ও ২৪ পরগনায় বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে, তখন মুহম্মদ মহসীন উদ্দিন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে বিক্রমপুরের জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে মুসলিম ও হিন্দু কৃষকরা সংগঠিত হয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিক্রমপুরবাসীর ভূমিকা ছিল অনন্য। অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী গোটা বিক্রমপুর এক হয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গোয়ালনিমান্দ্রা, হলদিয়া, শেখরনগর, গালিমপুর, মুন্সীগঞ্জ, কাঠপট্টি, তালতলাসহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বহু পাকিস্তানি সেনার প্রাণ হরণ করেন। শুধু গোয়ালনিমান্দ্রা-হলদিয়া যুদ্ধেই মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের বীরত্বের স্বাক্ষর রেখে কমপক্ষে ৭২ জন পাকিস্তানি সেনা খতম করেছিলেন। এখানে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ না করলে আমার অপরাধ হয়ে যাবে। তাঁরা হচ্ছেন মহিউদ্দিন আহমদ, হেদায়েতুল ইসলাম কাজল, ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন, আনিসুজ্জামান ও আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।
কীর্তিনাশা পদ্মার করাল গ্রাসে বিক্রমপুর হারিয়ে যায়। যখন নবদ্বীপ, গৌড়, সোনারগাঁ, ঢাকা স্বর্ণগ্রাম মানুষের কাছে তখনো অতটা পরিচিতি লাভ করেনি, এরও আগে ৯৮০ সালে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে বৌদ্ধ-বাঙালি পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর জন্মগ্রহণ করেন। বিক্রমপুরে বহু বিশ্ববিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক ও মানুষের আগমন ঘটেছিল। ১৩৭৮ সালে দ্বিতীয় বল্লাল সেনের আমলে ইসলাম ধর্ম প্রচারক বাবা আদম ও ১৫০৬ সালে সুলতানি আমলে সৈয়দ হুসেন শাহের সময়ে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী চৈতন্য দেবও বিক্রমপুরে এসেছিলেন। একটি সূত্র মতে, ১৬২৪ সালের মে মাসে মোগল সম্রাট শাহজাহানও নাকি ঢাকা থেকে নৌপথে প্রথম লক্ষ্যার তীরে খিজিরপুরে যাত্রাবিরতি করার পর তিনি বিক্রমপুরে আসেন। সম্রাট শাহজাহান বিক্রমপুরে তিন দিন ছিলেন।
এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে লড়াই-যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ঝোঁকটা বেশি লক্ষণীয়। নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ভাবার সময় তাঁরা বেশি পান না। আমরা কী ছিলাম, কীই-বা ছিল আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস- এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য জানার বা উদ্ধার করার আগ্রহ কারো মধ্যেই তেমন একটা দেখা যায় না। শুধু কর্তৃত্ব বহাল রাখার লড়াইয়ে আমরা যেন সবাই বুঁদ হয়ে বসে আছি। নতুন প্রজন্মের সদস্যদের জ্ঞান আহরণের পিপাসা মেটাতে নতুন নতুন বিষয়ে তথ্য প্রদান করে তাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চালাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে আমাদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিচয়, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি জানার সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই তাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস সফল হবে। এ দেশে অনেকেই আবার পুরনো বিষয় নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করার বিরোধী। এখানে আবার অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পেতেও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। সে জন্য বলতে ইচ্ছা করছে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও বেশ পুরনোই হয়ে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক বছর পরই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সেটাও কি আমরা ভুলে যাব? ভুলে যাব কি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা? সর্বোপরি ২৫ মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতার মহানায়কের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদানের কথা। ভোলা যাবে কি স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা, তাঁর প্রত্যয়ী নেতৃত্ব, ত্যাগ-তিতিক্ষা, জীবনভর জেল-জুলুমসহ সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করার কথা? না, মোটেই না। ভোলা যাবে না, এ দেশের গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো দিকপাল জননেতাদের অমূল্য অবদানের কথা। অর্থনীতি যেমন রাজনীতির প্রাণশক্তি, তেমনি ইতিহাস রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জাতির প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন একজন নাগরিককে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলে। এই অঞ্চলের অতীত গৌরবের কথা ও কীর্তিগাথা যতই আলোচিত হবে, ততই আমাদের দেশাত্মবোধ শানিত হবে। কারণ অতীতের সোনালি অর্জনের আভায় বর্তমানকে সুদৃঢ়ভাবে বিনির্মাণ করে আমরা ভবিষ্যতের ভিত আরো মজবুত করার প্রয়াস চালাতে পারি।
জেলা হিসেবে মুন্সীগঞ্জ নামটির পাশে বিক্রমপুর নামটি জুড়ে দেওয়ার বাংলাদেশের গৌরব ও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের বিনীত দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে তাঁর মূল্যবান মন্তব্যের প্রতিধ্বনি করে আমিও বলতে চাই, ইতিহাসখ্যাত এই নামটি এখনো বিক্রমপুরবাসীর মুখে মুখেই ধ্বনিত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিক্রমপুর নাম এখন খুঁজে পাওয়া যায় মিষ্টির দোকান থেকে শুরু করে কাপড়ের দোকানসহ অন্যান্য দোকানের নামে। নামটি বিক্রমপুরবাসীর হৃদয়জুড়ে এখনো আছে বলে তাঁদের দোকানপাট বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তাঁরা বিক্রমপুর নামটি ব্যবহার করেন। সরকারের স্বীকৃতি না পেলেও নামটি একেবারে যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য নামটির প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ প্রকাশের জন্যই তা করা হয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলে অঞ্চলটির নাম বিক্রমপুর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুর জীবন কেড়ে নিলে সবই ভেস্তে যায়। অতীত ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদান একটি স্বীকৃত সত্য। এই ঐতিহ্য স্বীকৃতি পাবে- এটাই সবার কামনা। আমার তো মনে হয়, বিক্রমপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানালে সারা দেশের মানুষই খুশি হবে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিক্রমপুরের নাম মুন্সীগঞ্জ করায় বিক্রমপুর নামটি আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে। হারিয়ে যেতে থাকে সরকারি রেকর্ড থেকে। যায় মানচিত্র থেকেও। কিন্তু নামটি মানুষের মনের মানচিত্রে আজও ভাস্বর হয়ে আছে। তাই এ বিষয়ে আমিও বিক্রমপুর তথা বাংলাদেশের গৌরব দেশের একজন কীর্তিমান লেখক, সাহিত্যিক ও কথাশিল্পী এবং কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সনির্বন্ধ নিবেদন করতে চাই, লাখ লাখ মানুষের হৃদয় জয় করতে বিষয়টির প্রতি তিনি জরুরি ভিত্তিতে দৃষ্টি দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে বিক্রমপুরবাসীকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করবেন। সমগ্র বিক্রমপুরবাসীর মতো এটা আমারও একান্ত কামনা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.