ফের আলোচনায় 'আকসা' চুক্তি-যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো উপস্থিতির আশঙ্কা by মেহেদী হাসান

প্রস্তাবিত অ্যাকুইজেশন ও ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা) নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে ঢাকায়। সংশ্লিষ্ট অনেকে এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও অন্তত দুটি মন্ত্রণালয় এ চুক্তির ঘোর বিরোধী। মন্ত্রণালয় দুটির মতে, এ ধরনের চুক্তির আগে আরো বোঝাপড়ার দরকার আছে।


সে জন্য সময়ও প্রয়োজন। তা ছাড়া ওই চুক্তির আওতায় দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ ধরনের চুক্তি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ১৯৯৬ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে ওই চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে আলোচনা-যোগাযোগে ভাটা পড়লেও চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের পর তা নিয়ে আবার শুরু হয়েছে দৌড়ঝাঁপ।
সূত্র আরো জানায়, প্রস্তাবিত আকসা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে 'গাইডেড মিসাইল'সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। এসব অস্ত্র ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়ার কথাও রয়েছে। এ ছাড়া থাকবে যৌথ মহড়া ও সংলাপের ব্যবস্থা।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, প্রস্তাবিত আকসা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার জন্য বাংলাদেশে 'পোর্ট অব কল' সুবিধা পাবে।
জানা গেছে, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে গত সপ্তাহে প্রস্তাবিত আকসা চুক্তি বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। অন্যদিকে আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত ওই চুক্তির ব্যাপারে জোরালো আপত্তি তুলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে জানান, প্রশিক্ষণ ও বিদেশ সফরের সুযোগ বাড়বে- এমনটা আশা করে অনেকে এ চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
আকসা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আছে কি না জানতে চাইলে ওই কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড আগ্রহ রয়েছে। তবে একে বাংলাদেশের ওপর চাপ বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার অনেক মিত্র দেশের এ ধরনের চুক্তি আছে।
অন্য কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে আকসা চুক্তি নিয়ে সুস্পষ্ট মতভেদ রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আকসা চুক্তির সারমর্ম প্রায় একই। আগে এ চুক্তিটির নাম ছিল 'ন্যাটো মিউচ্যুয়াল সাপোর্ট অ্যাক্ট'। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও সরবরাহ বিনিময় সহজ করার জন্য এটি করা হয়েছিল। তবে ন্যাটো সদস্য নয় এমন দেশগুলোর সরকারের সঙ্গেও আকসা চুক্তি স্বাক্ষরের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৬, ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে তা সংশোধন করা হয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত মিত্র বা জোটের শরিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে আকসার ব্যাপারে আলোচনা করছে। আকসার আওতায় প্রধানত খাদ্য, জ্বালানি, পরিবহন, রসদ ও সরঞ্জামাদির মতো কিছু সহযোগিতা বিনিময়ের কথা থাকে।
এ পর্যন্ত মোট কয়টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আকসা চুক্তি করেছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০০৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ৭৬টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আকসা চুক্তি স্বাক্ষরের কথা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কমিটির শুনানিতে পেন্টাগনের শীর্ষ কমান্ডার অ্যাডমিরাল উইলার্ড সন্ত্রাস দমন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীর (স্পেশাল ফোর্স) উপস্থিতির কথা বলার পর তা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, উপস্থিতির অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি থাকা নয়। সহযোগিতা বা প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা আসেন আবার কয়েক দিন পর চলেও যান। বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি থাকার খবর নাকচ করে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো থেকেও অনুরূপ বক্তব্য আসে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় প্রথমবারের মতো দুই দেশের মধ্যে রুদ্ধদ্বার সামরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া দেশটির সামরিক ও রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী অ্যান্ড্রু শ্যাপিরো বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে অভিহিত করেছেন। গত ৫ মে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়টি উল্লেখ করে সাংবাদিকরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন- ওয়াশিংটন বঙ্গোপসাগরের সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের পথে বাংলাদেশকে আনতে চাচ্ছে কি না?
জবাবে হিলারি ক্লিনটন বলেন, 'নিরাপত্তা অংশীদারি আমাদের দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়ার নীতির প্রশংসা আমরা করি।' তিনি আরো বলেন, 'সন্ত্রাসীরা যাতে বাংলাদেশি বা অন্য কোনো স্থানের নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাস চালাতে না পারে এবং ট্রানজিট বা প্রশিক্ষণের জন্য এ দেশকে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) আপনাদের সরকার ও এ দেশের জনগণকে নিরাপত্তা খাতে অংশীদার হিসেবে থাকব।'
হিলারির ঢাকা সফরের বহুল আলোচিত টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি না হলেও একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে একযোগে নিবিড়ভাবে কাজ করার আদর্শকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় 'অংশীদারি সংলাপ'-এর ঘোষণা স্বাক্ষর করে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে 'কৌশলগত অংশীদারি সংলাপ'-এর ঘোষণা স্বাক্ষরের প্রস্তাব এলেও সামরিক প্রভাবমুক্ত রাখতে 'কৌশলগত' শব্দটির ব্যাপারে বাংলাদেশ অনীহা জানিয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.