অর্থনীতি-আইএমএফের ঋণ প্রস্তাব গ্রহণকরা না-করা by রিজওয়ানুল ইসলাম
বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকটের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ঋণ-সাহায্য প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান হলো, সংকটের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে;
সুতরাং বাংলাদেশকে সাফল্যের উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করে ‘পুরস্কার’ হিসেবে বাজেটে সহায়তা দেওয়া উচিত। আমার মতে, আইএমএফের ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। তবে বাংলাদেশকে সাফল্যের উদাহরণ কি না তা অন্য প্রশ্ন। এর জবাব নির্ভর করবে সফলতার মানদণ্ড কী, তার ওপর। সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে দেখা যাক আইএমএফের প্রস্তাবটি কী ছিল এবং কেন আমি মনে করছি যে তাদের ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক।
২০০৭ সালে যে আর্থিক সংকট শুরু হয়, তার কারণে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতি গভীর মন্দায় পড়ে। অবশ্য উন্নত দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নিম্নগতি দেখা দেয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উদ্দীপিত করে মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়। উন্নয়নশীল দেশেও এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বেশ কিছু দেশে মন্দা মোকাবিলার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে কোন দেশ কতটা জোরের সঙ্গে এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, তা সেই দেশের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যের ওপর নির্ভরশীল। যদি স্বাভাবিক অবস্থায়ও কোনো দেশের বাজেটে ঘাটতি থাকে, তবে মন্দাবস্থায় তার পক্ষে ব্যয় বাড়ানো দুষ্কর। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উদ্দীপিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হলে সরকারের ব্যয়ও বাড়াতে হয়। এ ধরনের অবস্থায় সহায়তা প্রদানের জন্য আইএমএফকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ভিত্তিকে দৃঢ়তর করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ওপরে বর্ণিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর জন্য আইএমএফ তিনটি নতুন ঋণব্যবস্থার প্রবর্তন করে: (১) স্বল্প মেয়াদের জন্য চলতি ঋণ, (২) সীমিত শর্ত সাপেক্ষে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ঋণ এবং (৩) মধ্য মেয়াদে নমনীয় ভিত্তিতে সম্প্রসারিত ঋণ। কোনো দেশ যদি অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে অবশ্যই আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু সবার জন্য যেমন একই মাপের কাপড় সঠিক নয়, তেমনি সব নিম্ন-আয়ের দেশের জন্য একই কাঠামোতে ঋণ প্রযোজ্য হবে, তাও ঠিক নয়। এখানেই আইএমএফের ভুল। তা ছাড়া আইএমএফের সব ঋণের সঙ্গেই কিছু শর্ত জড়িত থাকে, সেসব শর্ত পালন করা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য নজরদারির ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যা পরিস্থিতি, তাতে এ ধরনের শর্ত সাপেক্ষে এবং নজরদারিসমেত ঋণ নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই যুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক।
তবে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সফল কি না, তার জবাব দিতে হলে আরও কিছু বিষয় দেখতে হবে। প্রথমে অর্থনীতির শক্তির দিকগুলোই দেখা যাক। দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাকের ওপর তেমন নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। অবশ্য কোনো কোনো মাসে পোশাক রপ্তানি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তা নয়, যদিও সে জন্য চাহিদার ঘাটতিই মূল কারণ ছিল কি না, তা বলা মুশকিল। বৈদেশিক মুদ্রার দ্বিতীয় প্রধান উৎসও প্রেষিতক (রেমিট্যান্স) বা বিদেশে কর্মরত নাগরিকদের পাঠানো অর্থ তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ২০০৯ সালে বিদেশে গমনকারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেলেও প্রেষিতকের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেশ ভালো পর্যায়ে উঠেছে। বাজেটের দিকে তাকালেও দেখা যায় যে ঘাটতি তেমন বাড়েনি। এসব থেকে মনে হয় যে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা বেশ সন্তোষজনক। তবে অবস্থাটি কি সত্যিই পরিতৃপ্ত হওয়ার মতো? আমার কিন্তু মনে হয় না। তবে কারণগুলোও বোঝা দরকার।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সাফল্যকে আমি খাটো করে দেখছি না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট এবং মন্দায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়নি। আবার সংকট দেখা দিলে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি সত্যিকারভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে? এটাও স্বীকার করতে হবে যে এখনো বাংলাদেশ সরকারের সামাজিক লক্ষ্যগুলো মোটামুটি সীমিত প্রকৃতির এবং সেসব লক্ষ্য অর্জনে বাজেটের ওপর চাপও সীমিত। সামাজিক লক্ষ্য ও অঙ্গীকারগুলোর দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচি জোরদার করা প্রয়োজন। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলেও তা জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে অর্থনীতির প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে এবং সে ব্যাপারে যে পরিমাণকে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয় তা হলো তিন মাসের আমদানির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থাকা। মাত্র কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জন করেছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল পাঁচ মাসের আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের কিছু বেশি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভারতেরও রিজার্ভ সেই তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া মাত্র কয়েক মাসের অবস্থা দেখে পরিতৃপ্ত না থেকে মধ্য মেয়াদের গড় চিত্রটির দিকে তাকানো উচিত।
দ্বিতীয়ত, ব্যয় বাড়িয়ে বড় আকারের উদ্দীপনা প্রদানের ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করতে হলে সরকার তা কি পারত? সরকারের বাজেটে প্রয়োজনীয় স্থান ছিল কি? বিভিন্ন খাতকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে যে উদ্দীপনা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তা দেশের অর্থনীতির আয়তনের (এবং বাজেটের) তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। অন্যান্য অনুন্নত দেশে এর চেয়ে বড় আকারের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বস্তুত, বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে বাংলাদেশ ‘অতি অসংরক্ষিত’ (high exposure) দেশ, আর সংকটের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এর সক্ষমতাকে মাঝারি মাত্রার বলে ধরা হয়।
তৃতীয়ত, বাজেট ঘাটতি সীমিত থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রশাসনের দুর্বলতা। এ বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানো অতি প্রয়োজন এবং দক্ষতা বাড়লে (অর্থাৎ ব্যয় বাড়লে) বাজেট ঘাটতিও বাড়বে, যদি না রাজস্ব আয়ও আনুপাতিকভাবে বাড়ানো যায়।
চতুর্থত, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় স্থিতি আনয়নকারী হাতিয়ার বা অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজার। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বেকারত্ব বিমা বা ভাতা। বেকার বা দরিদ্রদের জন্য কার্যক্রম, যেমন ফুড স্ট্যাম্প বা কর্মসংস্থান কর্মসূচিও অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে কাজ করতে পারে। অর্থনীতির নিম্নগতির সময় বেকারত্ব বাড়লে বেকারত্ব ভাতা হিসেবে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ বাড়ে। এর ফলে অর্থনীতিতে চাহিদার ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কমে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ ধরনের অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজার নেই বললেই চলে। কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতা সীমিত এবং সংকটের সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থাও নেই। বাজারভিত্তিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজারের ব্যবস্থা করার সময় এসেছে। পরের সংকটের জন্য প্রস্তুতি রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
পঞ্চমত, বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা খুবই সীমিত, যদিও বয়স্ক-ভাতা, বিধবা-ভাতা ও কিছু সামাজিক সুরক্ষা জালের কার্যক্রম রয়েছে। এসব কার্যক্রমের আওতা, সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যা ও কার্যকারিতা বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য বাজেটে যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বয়স্ক-ভাতার কথা ধরা যাক। ২০০৯ সালের বাজেটে এর পরিমাণ বাড়ানোর পরও মাথাপিছু ভাতার পরিমাণ দারিদ্র্যরেখার সমপরিমাণ আয়ের এক-চতুর্থাংশের মতো। এই কার্যক্রমের আওতায় সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যাও সীমিত। দারিদ্র্য হ্রাসে কোনো ভূমিকা রাখতে হলে এই কার্যক্রমগুলোর আওতা এবং মাথাপিছু ভাতার পরিমাণও বাড়াতে হবে।
ষষ্ঠত, বিদ্যমান কর্মসংস্থান কর্মসূচিগুলো সামাজিক সুরক্ষার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর কোনো আইনগত নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া তাদের আওতায় অন্তর্ভুক্ত জনসংখ্যা সীমিত এবং বেকারত্ব ভাতার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি একটি সর্বজনীন কর্মসংস্থান কার্যক্রম চালু করা হয় এবং এর আওতায় বেকারত্ব ভাতার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে ব্যয় কত হবে তা হিসাব করা উচিত এবং বাজেটে তা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে কি না দেখা দরকার।
সপ্তমত, প্রেষিতকের পরিমাণ না কমলেও প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ২০০৮ সালের আট লাখ ৭৫ হাজার থেকে ২০০৯ সালে চার লাখ ৭৫ হাজারে নেমে গেছে। দেশের অভ্যন্তরে চার লাখ অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, নাকি তারা প্রচ্ছন্ন বেকারত্বে ভুগছে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আরও একটি প্রশ্ন হলো, যদি কোনো সময় বিশালসংখ্যক শ্রমিক দেশে ফিরতে শুরু করে, তবে সে অবস্থা কীভাবে সামাল দেওয়া হবে? দেশের অর্থনীতিতে তাদের আত্মীভূত করা এবং প্রেষিতকের উৎপাদনমূলক খাতে ব্যবহারের বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখা দরকার।
অর্থনীতির স্বাস্থ্য নিয়ে পরিতৃপ্ত হওয়ার আগে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা উচিত।
রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ। সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, জেনেভা।
২০০৭ সালে যে আর্থিক সংকট শুরু হয়, তার কারণে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতি গভীর মন্দায় পড়ে। অবশ্য উন্নত দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নিম্নগতি দেখা দেয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উদ্দীপিত করে মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়। উন্নয়নশীল দেশেও এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বেশ কিছু দেশে মন্দা মোকাবিলার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে কোন দেশ কতটা জোরের সঙ্গে এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, তা সেই দেশের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যের ওপর নির্ভরশীল। যদি স্বাভাবিক অবস্থায়ও কোনো দেশের বাজেটে ঘাটতি থাকে, তবে মন্দাবস্থায় তার পক্ষে ব্যয় বাড়ানো দুষ্কর। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উদ্দীপিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হলে সরকারের ব্যয়ও বাড়াতে হয়। এ ধরনের অবস্থায় সহায়তা প্রদানের জন্য আইএমএফকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ভিত্তিকে দৃঢ়তর করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ওপরে বর্ণিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর জন্য আইএমএফ তিনটি নতুন ঋণব্যবস্থার প্রবর্তন করে: (১) স্বল্প মেয়াদের জন্য চলতি ঋণ, (২) সীমিত শর্ত সাপেক্ষে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ঋণ এবং (৩) মধ্য মেয়াদে নমনীয় ভিত্তিতে সম্প্রসারিত ঋণ। কোনো দেশ যদি অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে অবশ্যই আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু সবার জন্য যেমন একই মাপের কাপড় সঠিক নয়, তেমনি সব নিম্ন-আয়ের দেশের জন্য একই কাঠামোতে ঋণ প্রযোজ্য হবে, তাও ঠিক নয়। এখানেই আইএমএফের ভুল। তা ছাড়া আইএমএফের সব ঋণের সঙ্গেই কিছু শর্ত জড়িত থাকে, সেসব শর্ত পালন করা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য নজরদারির ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যা পরিস্থিতি, তাতে এ ধরনের শর্ত সাপেক্ষে এবং নজরদারিসমেত ঋণ নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই যুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক।
তবে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সফল কি না, তার জবাব দিতে হলে আরও কিছু বিষয় দেখতে হবে। প্রথমে অর্থনীতির শক্তির দিকগুলোই দেখা যাক। দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাকের ওপর তেমন নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। অবশ্য কোনো কোনো মাসে পোশাক রপ্তানি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তা নয়, যদিও সে জন্য চাহিদার ঘাটতিই মূল কারণ ছিল কি না, তা বলা মুশকিল। বৈদেশিক মুদ্রার দ্বিতীয় প্রধান উৎসও প্রেষিতক (রেমিট্যান্স) বা বিদেশে কর্মরত নাগরিকদের পাঠানো অর্থ তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ২০০৯ সালে বিদেশে গমনকারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেলেও প্রেষিতকের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেশ ভালো পর্যায়ে উঠেছে। বাজেটের দিকে তাকালেও দেখা যায় যে ঘাটতি তেমন বাড়েনি। এসব থেকে মনে হয় যে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা বেশ সন্তোষজনক। তবে অবস্থাটি কি সত্যিই পরিতৃপ্ত হওয়ার মতো? আমার কিন্তু মনে হয় না। তবে কারণগুলোও বোঝা দরকার।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সাফল্যকে আমি খাটো করে দেখছি না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট এবং মন্দায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়নি। আবার সংকট দেখা দিলে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি সত্যিকারভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে? এটাও স্বীকার করতে হবে যে এখনো বাংলাদেশ সরকারের সামাজিক লক্ষ্যগুলো মোটামুটি সীমিত প্রকৃতির এবং সেসব লক্ষ্য অর্জনে বাজেটের ওপর চাপও সীমিত। সামাজিক লক্ষ্য ও অঙ্গীকারগুলোর দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচি জোরদার করা প্রয়োজন। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলেও তা জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে অর্থনীতির প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে এবং সে ব্যাপারে যে পরিমাণকে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয় তা হলো তিন মাসের আমদানির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থাকা। মাত্র কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জন করেছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল পাঁচ মাসের আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের কিছু বেশি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভারতেরও রিজার্ভ সেই তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া মাত্র কয়েক মাসের অবস্থা দেখে পরিতৃপ্ত না থেকে মধ্য মেয়াদের গড় চিত্রটির দিকে তাকানো উচিত।
দ্বিতীয়ত, ব্যয় বাড়িয়ে বড় আকারের উদ্দীপনা প্রদানের ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করতে হলে সরকার তা কি পারত? সরকারের বাজেটে প্রয়োজনীয় স্থান ছিল কি? বিভিন্ন খাতকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে যে উদ্দীপনা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তা দেশের অর্থনীতির আয়তনের (এবং বাজেটের) তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। অন্যান্য অনুন্নত দেশে এর চেয়ে বড় আকারের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বস্তুত, বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে বাংলাদেশ ‘অতি অসংরক্ষিত’ (high exposure) দেশ, আর সংকটের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এর সক্ষমতাকে মাঝারি মাত্রার বলে ধরা হয়।
তৃতীয়ত, বাজেট ঘাটতি সীমিত থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রশাসনের দুর্বলতা। এ বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানো অতি প্রয়োজন এবং দক্ষতা বাড়লে (অর্থাৎ ব্যয় বাড়লে) বাজেট ঘাটতিও বাড়বে, যদি না রাজস্ব আয়ও আনুপাতিকভাবে বাড়ানো যায়।
চতুর্থত, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় স্থিতি আনয়নকারী হাতিয়ার বা অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজার। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বেকারত্ব বিমা বা ভাতা। বেকার বা দরিদ্রদের জন্য কার্যক্রম, যেমন ফুড স্ট্যাম্প বা কর্মসংস্থান কর্মসূচিও অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে কাজ করতে পারে। অর্থনীতির নিম্নগতির সময় বেকারত্ব বাড়লে বেকারত্ব ভাতা হিসেবে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ বাড়ে। এর ফলে অর্থনীতিতে চাহিদার ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কমে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ ধরনের অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজার নেই বললেই চলে। কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতা সীমিত এবং সংকটের সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থাও নেই। বাজারভিত্তিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অটোমেটিক স্ট্যাবিলাইজারের ব্যবস্থা করার সময় এসেছে। পরের সংকটের জন্য প্রস্তুতি রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
পঞ্চমত, বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা খুবই সীমিত, যদিও বয়স্ক-ভাতা, বিধবা-ভাতা ও কিছু সামাজিক সুরক্ষা জালের কার্যক্রম রয়েছে। এসব কার্যক্রমের আওতা, সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যা ও কার্যকারিতা বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য বাজেটে যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বয়স্ক-ভাতার কথা ধরা যাক। ২০০৯ সালের বাজেটে এর পরিমাণ বাড়ানোর পরও মাথাপিছু ভাতার পরিমাণ দারিদ্র্যরেখার সমপরিমাণ আয়ের এক-চতুর্থাংশের মতো। এই কার্যক্রমের আওতায় সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যাও সীমিত। দারিদ্র্য হ্রাসে কোনো ভূমিকা রাখতে হলে এই কার্যক্রমগুলোর আওতা এবং মাথাপিছু ভাতার পরিমাণও বাড়াতে হবে।
ষষ্ঠত, বিদ্যমান কর্মসংস্থান কর্মসূচিগুলো সামাজিক সুরক্ষার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর কোনো আইনগত নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া তাদের আওতায় অন্তর্ভুক্ত জনসংখ্যা সীমিত এবং বেকারত্ব ভাতার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি একটি সর্বজনীন কর্মসংস্থান কার্যক্রম চালু করা হয় এবং এর আওতায় বেকারত্ব ভাতার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে ব্যয় কত হবে তা হিসাব করা উচিত এবং বাজেটে তা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে কি না দেখা দরকার।
সপ্তমত, প্রেষিতকের পরিমাণ না কমলেও প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ২০০৮ সালের আট লাখ ৭৫ হাজার থেকে ২০০৯ সালে চার লাখ ৭৫ হাজারে নেমে গেছে। দেশের অভ্যন্তরে চার লাখ অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, নাকি তারা প্রচ্ছন্ন বেকারত্বে ভুগছে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আরও একটি প্রশ্ন হলো, যদি কোনো সময় বিশালসংখ্যক শ্রমিক দেশে ফিরতে শুরু করে, তবে সে অবস্থা কীভাবে সামাল দেওয়া হবে? দেশের অর্থনীতিতে তাদের আত্মীভূত করা এবং প্রেষিতকের উৎপাদনমূলক খাতে ব্যবহারের বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখা দরকার।
অর্থনীতির স্বাস্থ্য নিয়ে পরিতৃপ্ত হওয়ার আগে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা উচিত।
রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ। সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, জেনেভা।
No comments