বাঙালি বিস্মৃতিপ্রবণ! by সুভাষ সাহা

রাজনীতি নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন এমন অনেকে বাঙালিকে বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি বলতে চান। সম্ভবত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের মনোজগতে মানুষের মননের গভীরতা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রবল। এ কারণেই কি তারা নিজেরা যা বলবেন,


যা করবেন এবং যা দেখাবেন তাতেই জনগণ সর্বদা আস্থা স্থাপন করতে বাধ্য বলে মনে করে থাকেন? তা না হলে কিছুদিন আগেও সরকার পরিচালনায় থাকার সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বেমালুম চেপে গিয়ে বিরোধী দলে ফেরা মাত্রই উল্টো গীত গাইতে পারেন কী করে! আসলেই কি মানুষ তার জীবিতকালে ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে ছাপ রেখে যাওয়ার মতো ঘটনা হোক, তা কি ভুলতে পারে? একমাত্র বয়সের ভারে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকলে কোনো কোনো ঘটনা মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়, অন্যথায় অবসরে বা বিতর্কে গড়গড় করে অতীতকে উগড়ে দিতে পারে মানুষ। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এই সত্যকে মুখে যতটা জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ততটা গুরুত্ব দিয়ে এটাকে শাশ্বত সত্য হিসেবে গ্রহণ করলে রাজনীতিকরা নিজেদের অতীতকর্মের মূল্যায়ন যেমন করতে পারতেন, তেমনি কর্মফল কী হতে পারে তাও সম্যক উপলব্ধি করতেন।
সম্প্রতি এক বৈঠকী আলোচনায় সাবেক এক ছাত্রনেতা প্রশ্ন রাখেন, 'বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ব্যর্থতায় মানুষ অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ হলেও কেন তারা এখনও বিরোধী দলের ডাকে রাস্তায় নামছে না।' সত্যিই তো দুঃসহ যানজটে মানুষের মধ্যে চরম বিরক্তির ভাব দেখা গেলেও এ জন্য তারা রাস্তায় নেমে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে নারাজ।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও রাজনৈতিক হত্যা, গুমের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। এর কোনোটিরই বিচার হয়নি ওই সরকারের আমলে। বরং বিভিন্নভাবে এসব হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো হাই প্রোফাইল হত্যাকাণ্ডের বিচার পর্যন্ত হয়নি। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আয়োজিত শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্র তো মানুষ টিভির বদৌলতে প্রত্যক্ষ করেছে। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য কল্পনা করলে এখনও শিউরে উঠতে হয়। এ ঘটনাকে কীভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে তাতো দেশবাসীর অজানা নেই। অথচ এর বিচার হলে তৎকালীন সরকারি জোট জনআস্থা কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে পারত। এসব কারণেই কি বর্তমান বিরোধী শিবিরের চার ডজনের মতো নেতাকে কারাগারে প্রেরণের পরও এর বিরুদ্ধে জনতার ঢল নেমে রাস্তা সয়লাব করতে দেখা যায়নি!
বাঙালিকে বোকা ঠাউরে বড্ড ভুল করছেন রাজনীতিকরা। বাঙালি বোকা নয়, বিস্মৃতিপ্রবণও নয়। বয়স্করা এখনও নাতি-নাতনিদের কাছে একাত্তর সালে তাদের এলাকায় কী ঘটেছিল, এমনকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল তা বলে দিতে পারেন। যারা অশীতিপর তারা সাতলি্লশে ভারতবর্ষ ভাগের কথাও স্মরণ করতে পারেন। তাই এ দেশের মানুষ রাজনীতিবিদদের কাজের মূল্যায়ন করেন না তা ঠিক নয়। জোট সরকার আমলে জোরদার জঙ্গি তৎপরতা, গুম-খুন বা অব্যবস্থা ও দুর্নীতি মানুষ বিস্মৃত হয়েছে এটা ভাবা বোকামি। মানুষ বর্তমান সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব যেমন কষছে, তেমনি বিরোধীরা ক্ষমতায় থাকার সময় কী ধরনের আচরণ করেছে তাও বিচার করে দেখছে। তুলনামূলক বিচারের পাল্লায় এখন সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই। যারা বাঙালিকে বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি আখ্যা দেন তারা নিজেরাই বোকার স্বর্গে বাস করেন।
 

No comments

Powered by Blogger.