সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-হিলারির সফর ও একটি বিভক্ত জাতির কাহিনী by মামুন রশীদ

হিলারির কাছে আমাদের দুই জ্যেষ্ঠ ও বিশিষ্ট নাগরিক যথাক্রমে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নাইট খেতাবপ্রাপ্ত ফজলে হাসান আবেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে 'শুল্কমুক্ত সুবিধা' চেয়েছেন। তারা নিশ্চিত জানেন, এই সুবিধা পেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে,


কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, সামাজিক সাম্য জোরদার হবে এবং প্রবৃদ্ধিও হয়ে উঠবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। আমি নিশ্চিত যে, তারা আমাদের দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন ত্বরান্বিতকরণের লক্ষ্যে উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতেও হিলারির কাছে সহায়তা কামনা করেছেন কিংবা সময় পেলে করতেন
সংবাদপত্রগুলো বলেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। হিলারিকে এ দেশে আনার কৃতিত্বটা বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ও সে সঙ্গে কিছুটা হলেও ঢাকার আমেরিকান সেন্টারের পরিচালক লরেন লাভলেইসেরই প্রাপ্য। বাংলাদেশে হিলারির সফরটি মাত্র ২০ ঘণ্টার হলেও এটাকে বেশ কার্যকর বলেই মনে করা হচ্ছে। ওই সময়টায় আমি দেশের বাইরে থাকার কারণে ঢাকার আমেরিকান সেন্টারের আমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও তরুণদের নিয়ে হিলারির সংলাপে উপস্থিত হতে পারিনি।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বেশিরভাগেরই সম্প্র্রচার থাকায় আমি সেখানে বসেই হিলারির সফর বিষয়ক বিভিন্ন খবর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখতে পেয়েছিলাম। প্রায় ১৭ বছর আগে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করেন। তখন বাংলাদেশের যেসব ইস্যুতে আলোচনা হয়েছিল, এবারেও সেগুলো নিয়ে আলোচনার কথা ছিল না। কারণ এতদিনে আমাদের দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে, যুব বা তরুণ সমাজ আগের চেয়ে অনেকটা এগিয়েছে, আমাদের দেশের অনেক নারীই আর্থ-সামাজিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে বা স্বাবলম্বী হয়েছে, তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ অধিকতর প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের এসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক অর্জনকে খেয়ে ফেলছে অস্থির ও অদূরদর্শী রাজনীতি। সেটিই যেন উঠে এসেছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ১৭ বছর পরের এই সফরে। যে কারণে তাকে বারবার সরকারি ও বিরোধী দলকে একসঙ্গে বসা এবং সরকারকে নাগরিক সমাজ, দেশকে এগিয়ে নিতে পারেন এমন সব গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের কথা বেশি করে শোনা, নিখোঁজ বা গুম হওয়ার ঘটনা রোধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের পরামর্শ দিতে দেখে আমি কিছুটা ব্যথা পেয়েছি। তবে এটাও সত্য যে, বাংলাদেশের নির্মম বাস্তবতাই তাকে এ ধরনের আলোচনায় বাধ্য করেছে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই সচরাচর প্রতিপক্ষকে নিয়ে হাসি-তামাশা, ঠাট্টা-মশকরা করে কিংবা খোঁচা দিয়ে কথা বলে সংবাদপত্রের শিরোনাম হন। তারা পারতপক্ষে পরস্পর সামান্য শুভেচ্ছাও বিনিময় করতে চান না। পরস্পর তারা প্রকাশ্যে যতটা আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা বহু গুণ অশোভন-অশালীন হয় এবং তাদের আচরণও ভয়াবহ হয়ে থাকে। এ রকম একটি স্পর্শকাতর গল্পই এখন বলতে চাই। একবার এক জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী হাসপাতালে 'প্রায় মৃত্যুশয্যায় থাকা' এক বিরোধীদলীয় নেতাকে দেখতে গিয়েছিলেন। অতীতে দীর্ঘদিন তিনি তার রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। কিন্তু তখন ওই মন্ত্রীর দলীয় শীর্ষ নেতা আপত্তি করতে পারেন_ এই কথা শুনে ওই মন্ত্রী হাসপাতালের কেবিনের দরজার সামনে থেকেই ফিরে আসেন! দুর্ভাগ্যজনক ও উপহাসের বিষয় হলো, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলই বলে যে, তারা এই দেশকে ভালোবাসে এবং দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে দুই দলই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগেই বলেছি, প্রায় ১৭ বছর আগে হিলারি ক্লিনটন কিংবা তার স্বামী বিল ক্লিনটন বাংলাদেশের যেসব ইস্যুতে আলোচনা করেছিলেন, এবারেও সেগুলো নিয়ে কথা বলার কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে সেটাই হয়েছে। অথচ হিলারির এই সফরের সময়ে আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত ছিল আমাদের তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎ ও আগামী প্রজন্মের সম্ভাবনাসহ নতুন নতুন এজেন্ডা বা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।
পাকিস্তানি দখলদার হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে বিজয় অর্জনের ৪১ বছর পরে এসে আমাদের সরকারি দল কর্তৃক বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন কিংবা বিপরীতভাবে বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও যে কোনো অজুহাতে বা কোনো কারণ ছাড়াই সরকারি দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা বা উৎখাতের হুমকি-ধমকি দেওয়ার কথা নয়। এখন আমাদের অধিকতর অগ্রমুখী ও দূরদর্শী ইস্যু বা বিষয় নিয়েই আলোচনায় ব্যস্ত থাকা উচিত। উভয় দলের প্রতিই অনুরোধ, আমাদের জাতির গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করবেন না। আমাদের এখন টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতায়/দক্ষতার উন্নয়ন, উদ্যোক্তাদের সমর্থন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন ও প্রযুক্তির অবারিত ব্যবহার বিষয়ে অধিকতর জোর দেওয়া দরকার। প্রভাবশালী কোনো সংস্থা বা দেশের কোনো সেলিব্রেটি বা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কিংবা ক্ষমতাসীনরা কেউ বাংলাদেশে এলে তাদের কাছে ঘনিষ্ঠ বা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার চেষ্টা এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করাটাই যেন অনেক বড় কাজ হয়ে ওঠে আমাদের রাজনীতিবিদদের।
অন্যদিকে হিলারির কাছে আমাদের দুই জ্যেষ্ঠ ও বিশিষ্ট নাগরিক যথাক্রমে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নাইট খেতাবপ্রাপ্ত স্যার ফজলে হাসান আবেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে 'শুল্কমুক্ত সুবিধা' চেয়েছেন। তারা নিশ্চিত জানেন, এই সুবিধা পেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, সামাজিক সাম্য জোরদার হবে এবং প্রবৃদ্ধিও হয়ে উঠবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। আমি নিশ্চিত যে, তারা আমাদের দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন ত্বরান্বিতকরণের লক্ষ্যে উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতেও হিলারির কাছে সহায়তা কামনা করেছেন কিংবা সময় পেলে করতেন। হিলারির সফরকালে বাংলাদেশের জন্য একটি দুঃখজনক দিক ছিল, তিনি একদিকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদের মতো দেশের দু'জন জ্যেষ্ঠ ও সত্তরোর্ধ্ব নাগরিকের সঙ্গে এ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ইস্যু বা অগ্রমুখী ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন; অন্যদিকে তাকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তথা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আলোচনায় এ দেশের বহু দিনের পুরনো রাজনৈতিক ইস্যু এবং 'একই কৃষ্টি-সভ্যতার দেশে' জাতির দ্বিধাবিভক্তি নিয়েও কথা
বলতে হয়।
১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে জাতির জন্ম, তার এখন ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা। এর ওপর কৃষ্টি-সংস্কৃতিও অভিন্ন হওয়ায় জাতি হিসেবে আমাদের একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবারই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় কাজ করা উচিত। কিন্তু জাতির বিনির্মাণে আমরা আদৌ যেমন ঐক্যবদ্ধ হইনি, তেমনি সমগ্র জনগণের পুরো শক্তিকেও কাজে লাগাতে পারিনি। যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারা সংখ্যায় কম হলেও এখনও আমাদের জাতীয় উন্নয়নে বাধা বা বিভেদ সৃষ্টির কারণ হয়ে আছে। তারা এই তরুণ জাতিটাকে তার সর্বশক্তি দিয়ে এগোতে দিচ্ছে না। বর্তমানে এই দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশেরই গড় বয়স ৪০ বছরের নিচে, যারা নৈতিকভাবেই জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চায় এবং তাদের সেই সামর্থ্যও আছে।
১৯৭১ সালে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করার সুবাদে আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলেও পরবর্তীকালে নানা কারণে আমাদের মধ্যে বিভক্তি এসেছে এবং বিভক্তি চলছে। সেজন্য স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে এসেও আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে অতীতের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকুতি জানাতে হয়। এটি হলে হাতেগোনা কতিপয় যুদ্ধাপরাধী ও 'বিপথগামী' আমাদের আটকাতে বা পেছনের দিকে টানতে পারবে না। যত তাড়াতাড়ি নিশ্চিত যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, ততই দেশের জন্য তা মঙ্গলকর হবে। ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির প্রতিশ্রুতি আরও দীপ্যমান হবে। গুটিকতক লোক একটি বৃহৎ জাতির ঐক্যের পথে আর বাধা হতে পারবে না। বিশ্ব তখন আমাদের শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে সম্মান করবে। তখনই কেবল আমরা সফরকারী বিদেশি রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে অনুকম্পা/সাহায্য চাওয়া কিংবা 'শোবার ঘরে আমরা কেমন আচরণ করব' তা শিখতে 'জ্ঞান অনুদান' নেওয়ার চেয়ে বরং সমমর্যাদায়
মাথা তুলে আলোচনা-সমঝোতা প্রক্রিয়া চালাতে পারব।

মামুন রশীদ :ব্যাংকার এবং অর্থনীতি বিশ্লেষক
 

No comments

Powered by Blogger.