বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ-খোকন কারাগারে, ঢাকায় আজ নিম্ন আদালত বর্জন

হরতালের রাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের ৪৩ নেতাসহ ৪৫ জনকে অভিযুক্ত করে দাখিল করা চার্জশিট গ্রহণ করেছেন আদালত। একই সঙ্গে এই নেতাদের অভিযোগ আদালতের আমলে নেওয়া হয়েছে।


গতকাল সোমবার ঢাকার মহানগর হাকিম ও দ্রুত বিচার আদালত-৭-এর বিচারক এরফান উল্লাহ চার্জশিট গ্রহণ ও অভিযোগ আমলে নেওয়ার আদেশ দেন। পাশাপাশি এ মামলায় পলাতক তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও তাঁদের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ মামলার আরেক আসামি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি না করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন একই আদালত। এ ঘটনায় গতকাল আদালতে বিশৃঙ্খলা ও বিচারককে গালাগালির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আজ ঢাকায় নিম্ন আদালত বর্জন এবং সারা দেশে কালোব্যাজ ধারণ ও বিক্ষোভ করবেন। গতকাল বিএনপিপন্থী আইনজীবী নেতা এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
গত ১০ মে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক নুরুল আমিন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২-এর ৪ ও ৫ ধারায় দাখিল করা এ অভিযোগপত্রে ১৮ জনকে সাক্ষী করা হয়।
মামলার ঘটনা : বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতালে গত ২৯ এপ্রিল রাত ৯টা ৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে সাত-আটটি সাদা মাইক্রোবাস থেকে নেমে একদল লোক একটি বাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয়। ভয়ে বাসে থাকা লোকজন গাড়ি থেকে নেমে যায়। এলাকায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় বিএনপিসহ ১৮ দলের ৪৪ নেতা-কর্মীকে আসামি করে তেজগাঁও থানায় দ্রুত বিচার আইনের ৪ ও ৫ ধারায় মামলা করে পুলিশ। একই দিন সচিবালয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় বিএনপি ও সমমনা দলের নেতা-কর্মীদের আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা হয়।
আসামিরা দুটি মামলায় আগাম জামিনের আবেদন করেন হাইকোর্টে। গত ৭ মে আসামিরা বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের বেঞ্চে হাজির হন। তাঁদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানি করার পর দুই বিচারপতি দ্বিধাবিভক্ত আদেশ দেন।
সিনিয়র বিচারপতি পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন। তবে জুনিয়র বিচারপতি সরাসরি জামিন না দিয়ে তাঁদের এক সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ফলে বিষয়টি মীমাংসার জন্য আগাম জামিনের আবেদনের নথি প্রধান বিচারপতির কাছে যায়। তিনি পরবর্তী শুনানির জন্য বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার-উল হকের তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান।
গত রবিবার তৃতীয় বেঞ্চে আগাম জামিনের আবেদনের ওপর শুনানি হয়। ওই দিন আদালত আসামিদের আগাম জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে প্রত্যেককে ১৬ মের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। একদিন পর সচিবালয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের আগাম জামিন দেন হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ।
অন্য আসামিরা কারাগারে : হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বুধবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, এলডিপি নেতা অলি আহমদ, বিজেপি নেতা আন্দালিব পার্থ, জাগপা নেতা শফিউল আলম প্রধান, পিএনপি নেতা শওকত হোসেন নিলুসহ ১৮ দলীয় জোটের ৩৩ নেতা ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে গেলে তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর আগে এ মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও দপ্তর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভীসহ আট আসামি গ্রেপ্তার হন। তাঁরাও কারাগারে রয়েছেন।
খোকন কারাগারে : গত ৩ মে এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন হাইকোর্ট থেকে এক সপ্তাহের জন্য জামিন পান। গত ৯ মে হাইকোর্টের জামিনের মেয়াদ শেষ হলে খোকন মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির হয়ে জামিন চান। মহানগর হাকিম ও দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক ২০ মে পর্যন্ত তাঁকে জামিন দেন। ২০ মে খোকন আদালতে জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করলে আদালত গতকাল ২১ মে আবেদনটি শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।
গতকাল মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতে হাজির হন। তাঁর পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুনানি করেন। তাঁকে সহায়তা করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। আইনজীবীরা বলেন, মাহবুব উদ্দিন খোকন একজন সংসদ সদস্য। তিনি একজন আইনজীবী। হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পাওয়ার পর তিনি প্রতি ধার্য তারিখে হাজিরা দিয়েছেন। এই আদালতও তাঁকে জামিন দিয়েছেন। জামিনের শর্ত তিনি ভঙ্গ করেননি। তিনি পলাতক হবেন না।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জামিনের বিরোধিতা করেন। শুনানি শেষে আদালত জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন নামঞ্জুর করে খোকনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
চার্জশিট গ্রহণ : গতকাল মামলার চার্জশিট গ্রহণ-সংক্রান্ত শুনানির দিন ধার্য ছিল। কারাগারে থাকা ৪১ আসামিকে হাজির না করে তাঁদের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ ও অপরাধ আমলে নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
সকালে মির্জা ফখরুলসহ অন্য নেতাদের পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একটি আবেদন দিয়ে বলেন, দ্রুত বিচার আইনের একটি ধারার বিধান অনুসারে আসামিদের উপস্থিতি ছাড়া ও তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এই মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করার এখতিয়ার এ আদালতের নেই। তাই অভিযোগপত্র গ্রহণ ও আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেওয়ার শুনানি মুলতবি করার আবেদন জানানো হয়। আদালত ওই আবেদন নামঞ্জুর করেন।
তিন আসামির বিরুদ্ধে পরোয়ানা : ব্যারিস্টার খোকনকে নিয়ে এ মামলায় মোট ৪২ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হলো। তাঁদের মধ্যে বাসের চালক ও হেলপার ছাড়া অন্য ৪০ জনই বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা। তিন আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন। তাঁরা হলেন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মো. মকবুল আহমেদ, ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি নুরুল ইসলাম ওরফে বুলবুল ও ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ও তাঁদের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আবেদন করার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত গতকাল সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, তিনজনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে গতকালই সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে জারি করা পরোয়ানা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন আগামী ৬ জুনের মধ্যে দাখিল করতে থানা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালতে হৈচৈ : আদালতের আদেশের পর গতকাল বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের অনেকে আদালতের মধ্যেই হৈচৈ শুরু করেন। ব্যারিস্টার খোকনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশের পরই বিএনপি নেত্রী ও এমপি সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া বিচারককে উদ্দেশ করে গালিগালাজ করেন। কয়েকজন আইনজীবী আদালতের দরজা-জানালায় লাথি মারেন। এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁদের নিবৃত্ত করেন।
মিছিল-সমাবেশ : ব্যারিস্টার খোকনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। সুপ্রিম কোর্টেও আইনজীবীরা মিছিল-সমাবেশ করেন। সমাবেশে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দাবি করেন, অযৌক্তিকভাবে খোকনের জামিনের মেয়াদ না বাড়িয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, আসামিদের আদালতে হাজির না করে মামলার চার্জশিট গ্রহণ ও আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়া বেআইনি হয়েছে। আইনে আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার বিধান রয়েছে, যা বিচারক মানেননি।
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য : ঢাকার মহানগর দায়রা আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, মাহবুব উদ্দিন খোকনের জামিনের মেয়াদ ২০ মে শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত মামলার গুণাগুণ বিচার করেই তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আইনিপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.