সংশোধন বিতর্ক : ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মের সমতা by নূসরাত জাহান
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট বাতিল ঘোষণার পর থেকে অনেকে জোরেশোরে বলে আসছেন, এ রায়ের ফলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে আবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই কিভাবে ফিরে যাওয়া যায় তার উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন।
রায় ঘোষণার পর পরই সংসদ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সংবিধান সংশোধন কমিটি গঠন করে দিয়েছে। কমিটিকে পুরো সংবিধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ পেশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যত দূর জেনেছি, এ কমিটি ছয়টি বৈঠক করার পর কার্যপদ্ধতি নিয়ে একমত হতে না পেরে নির্বাহী বিভাগের পুনর্মুদ্রিত খসড়া সংবিধানের কপির জন্য প্রায় দুই মাস অপেক্ষা করেছে। সম্প্রতি কমিটি আবার কাজ শুরু করেছে। নির্বাহী বিভাগ কমিটির সদস্যদের কাছে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি পেঁৗছে দিয়েছে। যদিও কমিটির কো-চেয়ারপারসন এটিকে খসড়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। সংবিধান পুনর্মুদ্রণ বিতর্কটি ভিন্ন ইস্যু। সেটি এখানে আলোচনায় আনতে চাই না। এ নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। জেনেছি, কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_
* সংবিধানের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)-এর সঙ্গে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে বাক্যটি যোগ করে দেওয়া।
* প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' বাক্যটি সংযোজন করা হয়েছিল, যা সুপ্রিম কোর্ট সামরিক ফরমান দ্বারা সংযোজন করায় অবৈধ ঘোষণা করেছে। বাক্যটি অক্ষুণ্ন রেখে এতে 'স্রষ্টার/প্রভুর (যার যার ধর্ম অনুযায়ী যা প্রযোজ্য হয়)' তা যোগ করে দেওয়া।
* 'প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' সংবিধানে বহাল রেখে পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্ম বা গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সম-অধিকার পাওয়ার বিষয়টি সংবিধানে যোগ করে দেওয়া (অনুচ্ছেদ ২-ক)।
* রাষ্ট্রের মূলনীতিতে (অনুচ্ছেদ-৮) জনগণের পৃথক পৃথক ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখে এবং কোনো ধর্মের হানি না ঘটিয়ে যার যার ধর্ম অনুযায়ী আল্লাহর/প্রভুর/সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রথমে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা এবং তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বহাল রেখে তদানুযায়ী রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি পরিচালনা করা।
* 'ধর্মনিরপেক্ষতা'-নীতি বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহারসহ কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন বিলোপসংক্রান্ত ১৯৭২-এর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২ ফিরিয়ে আনা।
* এ ছাড়া সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওই সমিতি বা সংঘ ধর্মীয় নামযুক্ত কিংবা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে হলে তা নাগরিক বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জঙ্গি-কার্য পরিচালনা বা সংবিধানে বর্ণিত উদ্দেশ্য ও মূলনীতি-পরিপন্থী হলে তা গঠন ও সদস্য হওয়ার অধিকার বারিত করে অনুচ্ছেদ ৩৮-এর শর্তাংশ পুনর্গঠন করা।
সংসদীয় কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়গুলো আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি। জেনেছি, ইস্যুগুলো নিয়ে কমিটিতে আলোচনা চলছে এবং আরো আলোচনার সুযোগ আছে। কমিটির কো-চেয়ারপারসন বৈঠকের দিন এ কথা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' এবং 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' সংবিধানে রাখার পক্ষে কমিটির সদস্যরা ঐকমত্যে পেঁৗছেছেন। পরের দিন কোনো একটি সেমিনারে একজন বক্তা এবং অপর একজন সাংবাদিক ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে থাকতে পারে না মর্মে মন্তব্য করে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুুড়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতারাও বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকতে পারে না। এ কারণে আমি মনে করি, এ বিষয়ে সবার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া দরকার। সংসদীয় কমিটির সদস্য যাদের সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি, তাঁদের কেউ কেউ 'বিসমিল্লাহর' সঙ্গে 'সৃষ্টিকর্তার নামে', ইসলাম ধর্মের সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্ম রাখার পক্ষে হলেও সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং মূলনীতিতে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' না রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এ বাক্য বাদ দিলে যে যুক্তিতে সুফল লাভের আশায় অন্যগুলো সংবিধানে রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে তা অসার, নিরর্থক ও নিষ্ফল হবে। তাঁরা বলেছেন, এটি রেখে পাশাপাশি সবার ধর্মবিশ্বাস বিবেচনায় এনে 'স্রষ্টা/প্রভুর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' রাখার কথাটি জুড়ে দেওয়া শ্রেয় হবে। এতে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে রাজনীতি ও অপব্যাখ্যা করে বিভেদ সৃষ্টির আর সুযোগ থাকবে না।
কমিটির সদস্য যাঁদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁদের প্রায় সবাই বলেছেন, ১৯৭২-এ সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' অভিব্যক্তিটির (expression) অপব্যাখ্যা করে পরবর্তী সময়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। একটি গোষ্ঠী এটিকে 'ধর্মহীনতা' বলে আখ্যায়িত করে সংবিধান প্রণয়নকারীদের ধর্মবিরোধী এবং নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। এ কারণে দেখা যায়, ১৯৭৫-এ অসাংবিধানিক পন্থায় সরকার পরিবর্তনের পর সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধান সংশোধন করে জনগণকে এমন একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যেন ১৯৭৫ সালেই বাংলাদেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন কিংবা ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা ফিরে এসেছে। কেউ এ ধারণা বপন করে, আবার কেউ এর উৎকর্ষ সাধন করে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে গেছে। এখনো টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অথচ সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হয়, তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, 'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্ম বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এ রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদেরও বাধা দিতে পারবে না।'
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের সব ধর্মাবলম্বী নাগরিকের ধর্ম পালনে সমান অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কথা বলে গেছেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতি তথা এ দেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা। সব ধর্মের সমতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন।
সংবিধানে 'ধর্মের সমতা (equality of religion)' প্রতিফলনের জন্য সঠিক কোন শব্দ ব্যবহার করা যেত তা আইন ও ভাষাবিশেষজ্ঞদের পছন্দের বিষয় ছিল। সংবিধানে তাঁদের শব্দচয়নের যথার্থতা বিতর্কিত হওয়ার কারণে জাতির যে ভোগান্তি হয়েছে, তার দায়ভার ওই বিশেষজ্ঞরা এড়াতে পারেন না। ইতিহাসে যথাসময়ে সেটা হয়তো কেউ চিহ্নিত করে দিয়ে যাবে। কমিটির অনেক সদস্যই জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন ১৯৭২-এর সংবিধানে 'সকল ধর্মের সমতার' পরিবর্তে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দগুলো ব্যবহার করায়ই এ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কোনো রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে ওই রাষ্ট্রে কোনো ধর্মীয় কাজে রাষ্ট্রের আনুকূল্য থাকার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের কল্যাণে অনেক কিছু করে গেছেন। এটাও ভাবার বিষয়। ধর্মের সমতার ক্ষেত্রে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দগুলো সংবিধানে ব্যবহার করার কারণে ধর্মে অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্র আনুকূল্য দিয়েছে_এ কথা তখন নিন্দুকেরা প্রচার করার সুযোগ পেয়েছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের মূল সংবিধানে ১৯৭২-এ জন্মলগ্নে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অথচ এ ধারণাটি ভারতীয় সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে ১৯৭৬-এ। এরূপ সংযোজন ভারতের রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় আদৌ পরিবর্তন এনেছে কি না, এনে থাকলে প্রচারণা ব্যতীত গণজীবনে তার প্রভাব কতটুকু পড়েছে তা গবেষণার বিষয়। ভারতে ওই সংশোধন নিয়ে একাধিক মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সে দেশের আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দেবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আমাদের উদ্দেশ্য যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদ অটুট রাখা হয় এবং সব ধর্মবিশ্বাসে নিরপেক্ষতা হয়; অর্থাৎ বিভেদহীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠন হয়, জনগণের কল্যাণ হয়। তাহলে সে সুবাদে আমরা যদি জাতির পিতার রাষ্ট্র ও ধর্মবিষয়ক চিন্তার অনুসরণ করে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের বলি, তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধানমতে জীবন যাপন করো। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের বলি, তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করো। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বলি, তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করো। রাষ্ট্র তোমাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা ও সুযোগ করে দেবে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা আছে, সমস্যা হবে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের স্বার্থোদ্ধারে। তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে বাধা এসে যাবে। এক পক্ষ 'ধর্ম গেল' স্লোগান হারাবে, অন্য পক্ষের 'মনুষ্যবাদ' মতবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, এ ভয় থেকে যাবে। এ সুবাদে অনেকেই বলতে পারেন, ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পর সাংঘর্ষিক দর্শন। সংবিধানে এ দুটি একসঙ্গে থাকতে পারে না। আমি মনে করি, বিষয়টি পক্ষপাতহীন এবং গভীর অনুভূতি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। যে কাজটি আমাদের করতে হবে, তা হলো সব ধর্মের সমান অধিকার; অর্থাৎ ধর্মের সমতা সংবিধানে প্রথমে নিশ্চিত করে বলে দিতে হবে। তারপর রাষ্ট্র বলবে, রাষ্ট্র হলো ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্র হবে এমন, যেখানে কোনো একটি ধর্মের পক্ষ নিয়ে অন্য কোনো ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র এমন কোনো আচরণ করবে না, যাতে রাষ্ট্রের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয় বা রাষ্ট্রনিরপেক্ষতা হারায়।
১৯৭২-এর পর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর এগারো সালে এসে বাংলাদেশকে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে এখন জনগণ আর দেখতে চাইবে না। এরূপ দেখতে বাধ্য করা হলে জাতি পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। অনেক কিছু পাল্টে গেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য ব্যাহত করা কিংবা জাতীয়তাবোধ বিনষ্ট করার ফাঁকফোকর এখন আর পাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে কমিউনিজমকে স্বাগত জানানোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে তোরণ বানানোর সুযোগও এখন আর পাবে না। বিশ্বে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো এখন আর ভিন্ন দেশের দুরভিসন্ধির রাজনীতিতে সমর্থন দিচ্ছে না, বরং সমর্থন উঠিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিশ্বাস, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার গণজোয়ার এসেছে। সেখানকার বর্তমান অবস্থা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ দেশেও প্রমাণ আছে, তা হলো ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচন।
এরূপ পরিস্থিতিতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের দেশেও মুক্তিযুদ্ধকালীন আদর্শে জেগে ওঠা জনগণ এবং নতুন প্রজন্মের মন-মানসিকতায় অনেক পরিপক্বতা এসেছে, পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনকে সমন্বয় করে জাতি গঠনের লক্ষ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য মৌলিক কাঠামো বিনির্মাণ করে দিতে হবে। সংবিধানে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দিতে হবে, যাতে সুযোগসন্ধানীরা আর অজুহাত খুঁজে না পায়। সংবিধানে ধর্মের সমতা নিশ্চিত করে সব ধর্মাবলম্বী নাগরিককে এক কাতারে এনে জাতি গঠনের পরিবেশ সৃষ্টির এটাই উত্তম সময় এবং সুযোগ। সবাইকে মনে রাখতে হবে, ভিন্ন বক্তব্য তুলে বিভেদ সৃষ্টি করা হলে সুযোগসন্ধানীদের লাভ হবে। তখন কোনো কোনো ধর্মের রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য লাভের গোপন বা প্রকাশ্য অঙ্গীকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চোরাগোপ্তা পথ হিসেবে ব্যবহার হবে। এতে বাঙালি জাতির একতা বিনষ্ট হবে। অগ্রগতির পরিবর্তে রাষ্ট্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে, যা হবে আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য অকল্যাণকর। যা মোটেও কাম্য নয়। তাই সংসদীয় কমিটিকে তথা সংসদকে সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছতে হবে। এতে একদিকে 'জাতি বিভাজনের রাজনীতি' গুরুত্ব হারাবে, অন্যদিকে 'জাতি গঠনে ধর্মীয় অধিকারের সমতা' সংবিধানে নিশ্চিত হবে। একদিকে এতে সব ধর্মের সমতা নিশ্চিত করার গৌরব-সাফল্য যেমন থাকবে, তেমনি অন্যদিকে মিছিল, মিটিং বা রাজপথে ধর্ম টিকিয়ে রাখার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং সব রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের রাজনীতির বিষয়বস্তু ধর্মের পরিবর্তে সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্যান্য মৌলিক বিষয় অর্থাৎ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মালিকানার নীতি, মৌলিক প্রয়োজন তথা ভাত, কাপড়, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক ব্যবস্থা (১৫ অনুচ্ছেদ), গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি বিপ্লবসহ অন্যান্য বিষয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করে জনগণের আস্থা লাভের চেষ্টা করবে। তখনই এ দেশের রাজনীতি সুষ্ঠু ধারায় প্রবাহিত হওয়ার পথ খুঁজে পাবে। তাই আসুন, পুরনো স্লোগান 'রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার'-এর পরিবর্তে 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সব ধর্মের অনুসারীদের'_এ স্লোগান তুলে সব ধর্মের সমতা নিশ্চিত হওয়া সংশোধিত সংবিধানপ্রাপ্তির আশায় অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি।
লেখক : আইন ও রাজনীতির গবেষক
nusratjahan47@yahoo.com
* সংবিধানের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)-এর সঙ্গে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে বাক্যটি যোগ করে দেওয়া।
* প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' বাক্যটি সংযোজন করা হয়েছিল, যা সুপ্রিম কোর্ট সামরিক ফরমান দ্বারা সংযোজন করায় অবৈধ ঘোষণা করেছে। বাক্যটি অক্ষুণ্ন রেখে এতে 'স্রষ্টার/প্রভুর (যার যার ধর্ম অনুযায়ী যা প্রযোজ্য হয়)' তা যোগ করে দেওয়া।
* 'প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' সংবিধানে বহাল রেখে পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্ম বা গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সম-অধিকার পাওয়ার বিষয়টি সংবিধানে যোগ করে দেওয়া (অনুচ্ছেদ ২-ক)।
* রাষ্ট্রের মূলনীতিতে (অনুচ্ছেদ-৮) জনগণের পৃথক পৃথক ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখে এবং কোনো ধর্মের হানি না ঘটিয়ে যার যার ধর্ম অনুযায়ী আল্লাহর/প্রভুর/সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রথমে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা এবং তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বহাল রেখে তদানুযায়ী রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি পরিচালনা করা।
* 'ধর্মনিরপেক্ষতা'-নীতি বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহারসহ কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন বিলোপসংক্রান্ত ১৯৭২-এর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২ ফিরিয়ে আনা।
* এ ছাড়া সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওই সমিতি বা সংঘ ধর্মীয় নামযুক্ত কিংবা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে হলে তা নাগরিক বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জঙ্গি-কার্য পরিচালনা বা সংবিধানে বর্ণিত উদ্দেশ্য ও মূলনীতি-পরিপন্থী হলে তা গঠন ও সদস্য হওয়ার অধিকার বারিত করে অনুচ্ছেদ ৩৮-এর শর্তাংশ পুনর্গঠন করা।
সংসদীয় কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়গুলো আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি। জেনেছি, ইস্যুগুলো নিয়ে কমিটিতে আলোচনা চলছে এবং আরো আলোচনার সুযোগ আছে। কমিটির কো-চেয়ারপারসন বৈঠকের দিন এ কথা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' এবং 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' সংবিধানে রাখার পক্ষে কমিটির সদস্যরা ঐকমত্যে পেঁৗছেছেন। পরের দিন কোনো একটি সেমিনারে একজন বক্তা এবং অপর একজন সাংবাদিক ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে থাকতে পারে না মর্মে মন্তব্য করে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুুড়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতারাও বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকতে পারে না। এ কারণে আমি মনে করি, এ বিষয়ে সবার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া দরকার। সংসদীয় কমিটির সদস্য যাদের সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি, তাঁদের কেউ কেউ 'বিসমিল্লাহর' সঙ্গে 'সৃষ্টিকর্তার নামে', ইসলাম ধর্মের সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্ম রাখার পক্ষে হলেও সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং মূলনীতিতে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' না রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এ বাক্য বাদ দিলে যে যুক্তিতে সুফল লাভের আশায় অন্যগুলো সংবিধানে রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে তা অসার, নিরর্থক ও নিষ্ফল হবে। তাঁরা বলেছেন, এটি রেখে পাশাপাশি সবার ধর্মবিশ্বাস বিবেচনায় এনে 'স্রষ্টা/প্রভুর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' রাখার কথাটি জুড়ে দেওয়া শ্রেয় হবে। এতে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে রাজনীতি ও অপব্যাখ্যা করে বিভেদ সৃষ্টির আর সুযোগ থাকবে না।
কমিটির সদস্য যাঁদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁদের প্রায় সবাই বলেছেন, ১৯৭২-এ সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' অভিব্যক্তিটির (expression) অপব্যাখ্যা করে পরবর্তী সময়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। একটি গোষ্ঠী এটিকে 'ধর্মহীনতা' বলে আখ্যায়িত করে সংবিধান প্রণয়নকারীদের ধর্মবিরোধী এবং নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। এ কারণে দেখা যায়, ১৯৭৫-এ অসাংবিধানিক পন্থায় সরকার পরিবর্তনের পর সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধান সংশোধন করে জনগণকে এমন একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যেন ১৯৭৫ সালেই বাংলাদেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন কিংবা ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা ফিরে এসেছে। কেউ এ ধারণা বপন করে, আবার কেউ এর উৎকর্ষ সাধন করে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে গেছে। এখনো টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অথচ সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হয়, তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, 'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্ম বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এ রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদেরও বাধা দিতে পারবে না।'
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের সব ধর্মাবলম্বী নাগরিকের ধর্ম পালনে সমান অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কথা বলে গেছেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতি তথা এ দেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা। সব ধর্মের সমতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন।
সংবিধানে 'ধর্মের সমতা (equality of religion)' প্রতিফলনের জন্য সঠিক কোন শব্দ ব্যবহার করা যেত তা আইন ও ভাষাবিশেষজ্ঞদের পছন্দের বিষয় ছিল। সংবিধানে তাঁদের শব্দচয়নের যথার্থতা বিতর্কিত হওয়ার কারণে জাতির যে ভোগান্তি হয়েছে, তার দায়ভার ওই বিশেষজ্ঞরা এড়াতে পারেন না। ইতিহাসে যথাসময়ে সেটা হয়তো কেউ চিহ্নিত করে দিয়ে যাবে। কমিটির অনেক সদস্যই জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন ১৯৭২-এর সংবিধানে 'সকল ধর্মের সমতার' পরিবর্তে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দগুলো ব্যবহার করায়ই এ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কোনো রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে ওই রাষ্ট্রে কোনো ধর্মীয় কাজে রাষ্ট্রের আনুকূল্য থাকার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের কল্যাণে অনেক কিছু করে গেছেন। এটাও ভাবার বিষয়। ধর্মের সমতার ক্ষেত্রে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দগুলো সংবিধানে ব্যবহার করার কারণে ধর্মে অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্র আনুকূল্য দিয়েছে_এ কথা তখন নিন্দুকেরা প্রচার করার সুযোগ পেয়েছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের মূল সংবিধানে ১৯৭২-এ জন্মলগ্নে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অথচ এ ধারণাটি ভারতীয় সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে ১৯৭৬-এ। এরূপ সংযোজন ভারতের রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় আদৌ পরিবর্তন এনেছে কি না, এনে থাকলে প্রচারণা ব্যতীত গণজীবনে তার প্রভাব কতটুকু পড়েছে তা গবেষণার বিষয়। ভারতে ওই সংশোধন নিয়ে একাধিক মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সে দেশের আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দেবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আমাদের উদ্দেশ্য যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদ অটুট রাখা হয় এবং সব ধর্মবিশ্বাসে নিরপেক্ষতা হয়; অর্থাৎ বিভেদহীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠন হয়, জনগণের কল্যাণ হয়। তাহলে সে সুবাদে আমরা যদি জাতির পিতার রাষ্ট্র ও ধর্মবিষয়ক চিন্তার অনুসরণ করে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের বলি, তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধানমতে জীবন যাপন করো। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের বলি, তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করো। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বলি, তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করো। রাষ্ট্র তোমাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা ও সুযোগ করে দেবে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা আছে, সমস্যা হবে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের স্বার্থোদ্ধারে। তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে বাধা এসে যাবে। এক পক্ষ 'ধর্ম গেল' স্লোগান হারাবে, অন্য পক্ষের 'মনুষ্যবাদ' মতবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, এ ভয় থেকে যাবে। এ সুবাদে অনেকেই বলতে পারেন, ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পর সাংঘর্ষিক দর্শন। সংবিধানে এ দুটি একসঙ্গে থাকতে পারে না। আমি মনে করি, বিষয়টি পক্ষপাতহীন এবং গভীর অনুভূতি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। যে কাজটি আমাদের করতে হবে, তা হলো সব ধর্মের সমান অধিকার; অর্থাৎ ধর্মের সমতা সংবিধানে প্রথমে নিশ্চিত করে বলে দিতে হবে। তারপর রাষ্ট্র বলবে, রাষ্ট্র হলো ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্র হবে এমন, যেখানে কোনো একটি ধর্মের পক্ষ নিয়ে অন্য কোনো ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র এমন কোনো আচরণ করবে না, যাতে রাষ্ট্রের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয় বা রাষ্ট্রনিরপেক্ষতা হারায়।
১৯৭২-এর পর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর এগারো সালে এসে বাংলাদেশকে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে এখন জনগণ আর দেখতে চাইবে না। এরূপ দেখতে বাধ্য করা হলে জাতি পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। অনেক কিছু পাল্টে গেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য ব্যাহত করা কিংবা জাতীয়তাবোধ বিনষ্ট করার ফাঁকফোকর এখন আর পাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে কমিউনিজমকে স্বাগত জানানোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে তোরণ বানানোর সুযোগও এখন আর পাবে না। বিশ্বে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো এখন আর ভিন্ন দেশের দুরভিসন্ধির রাজনীতিতে সমর্থন দিচ্ছে না, বরং সমর্থন উঠিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিশ্বাস, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার গণজোয়ার এসেছে। সেখানকার বর্তমান অবস্থা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ দেশেও প্রমাণ আছে, তা হলো ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচন।
এরূপ পরিস্থিতিতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের দেশেও মুক্তিযুদ্ধকালীন আদর্শে জেগে ওঠা জনগণ এবং নতুন প্রজন্মের মন-মানসিকতায় অনেক পরিপক্বতা এসেছে, পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনকে সমন্বয় করে জাতি গঠনের লক্ষ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য মৌলিক কাঠামো বিনির্মাণ করে দিতে হবে। সংবিধানে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দিতে হবে, যাতে সুযোগসন্ধানীরা আর অজুহাত খুঁজে না পায়। সংবিধানে ধর্মের সমতা নিশ্চিত করে সব ধর্মাবলম্বী নাগরিককে এক কাতারে এনে জাতি গঠনের পরিবেশ সৃষ্টির এটাই উত্তম সময় এবং সুযোগ। সবাইকে মনে রাখতে হবে, ভিন্ন বক্তব্য তুলে বিভেদ সৃষ্টি করা হলে সুযোগসন্ধানীদের লাভ হবে। তখন কোনো কোনো ধর্মের রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য লাভের গোপন বা প্রকাশ্য অঙ্গীকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চোরাগোপ্তা পথ হিসেবে ব্যবহার হবে। এতে বাঙালি জাতির একতা বিনষ্ট হবে। অগ্রগতির পরিবর্তে রাষ্ট্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে, যা হবে আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য অকল্যাণকর। যা মোটেও কাম্য নয়। তাই সংসদীয় কমিটিকে তথা সংসদকে সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছতে হবে। এতে একদিকে 'জাতি বিভাজনের রাজনীতি' গুরুত্ব হারাবে, অন্যদিকে 'জাতি গঠনে ধর্মীয় অধিকারের সমতা' সংবিধানে নিশ্চিত হবে। একদিকে এতে সব ধর্মের সমতা নিশ্চিত করার গৌরব-সাফল্য যেমন থাকবে, তেমনি অন্যদিকে মিছিল, মিটিং বা রাজপথে ধর্ম টিকিয়ে রাখার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং সব রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের রাজনীতির বিষয়বস্তু ধর্মের পরিবর্তে সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্যান্য মৌলিক বিষয় অর্থাৎ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মালিকানার নীতি, মৌলিক প্রয়োজন তথা ভাত, কাপড়, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক ব্যবস্থা (১৫ অনুচ্ছেদ), গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি বিপ্লবসহ অন্যান্য বিষয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করে জনগণের আস্থা লাভের চেষ্টা করবে। তখনই এ দেশের রাজনীতি সুষ্ঠু ধারায় প্রবাহিত হওয়ার পথ খুঁজে পাবে। তাই আসুন, পুরনো স্লোগান 'রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার'-এর পরিবর্তে 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সব ধর্মের অনুসারীদের'_এ স্লোগান তুলে সব ধর্মের সমতা নিশ্চিত হওয়া সংশোধিত সংবিধানপ্রাপ্তির আশায় অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি।
লেখক : আইন ও রাজনীতির গবেষক
nusratjahan47@yahoo.com
No comments