আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-১৬)-শহরের সপ্রতিভ তরুণ by আলী যাকের
তখন বাঙালি মুসলমান সমাজে কমিউনিস্টদের ঘিরে এমন একটা মনগড়া ধারণার সৃষ্টি করা হতো যে মনে হতো কমিউনিস্টরা বোধ হয় জ্যান্ত মানুষ ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। অবশ্য পরে দেখেছি যে মার্কিন রক্ষণশীলরাও কমিউনিস্টদের প্রায় একই রকম মনে করত এবং করে।
১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভের পর মৃণালদা গেণ্ডারিয়ায় এলেন এবং আমরা তাঁকে দেখলাম। মোটা চশমা পরিহিত, গোঁফধারী, শ্যামলা, মাঝারি আকৃতির মৃণালদা মানুষখেকো মানুষ_এটা বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল। বিশেষ করে তিনি যখন হেসে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী খোকা? তুমি বুঝি সামনের বাড়িতে থাক?' তখন আমি তাঁর ভক্ত হয়ে গেলাম। এই সময় বেশ কিছু মানুষ যাঁদের পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হিসেবে দেখেছি, তাঁরা মৃণালদার সঙ্গে গল্প করতে আসতেন। এঁদের দূর থেকে শ্রদ্ধাভরে দেখেছি। কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি এবং অনুমতিও ছিল না। যত দূর মনে পড়ে, মৃণালদা তাঁদের বাড়ির সামনের আয়তাকার উঠানে একটি গণসংগীতের অনুষ্ঠান করেছিলেন। এ অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ গান আমাদের ভাইবোনদের মনে ধরেছিল। গানটির প্রথম চরণের কথা এবং সুর এখনো স্পষ্ট মনে আছে।
'নওজোয়ান, নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান/কোটি প্রাণ, একই প্রাণ, একই শপথে বলীয়ান।'
সেই নওজোয়ান গানের সুর বিভিন্ন সময় আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে বলতে দ্বিধা নেই। বস্তুতপক্ষে একাত্তরে পাকিস্তানিদের দ্বারা আমার শহর ঢাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে যখন আমরা আমাদের গ্রামের দিকে ছুটছি, তখন আমাদের দেশের লঞ্চঘাটে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে দাদরার তালে হাঁটতে-হাঁটতে আমি আর ভাইয়া সমস্বরে গাইছিলাম_'নওজোয়ান, নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান/ কোটি প্রাণ, একই প্রাণ, একই শপথে বলীয়ান।'
আমাদের বাড়ি, ২৯ নম্বর দীননাথ সেন রোডের উল্টোদিকে বিরাট উঠানের উত্তর-পুব কোণে ছিল একটা লাইব্রেরি। নাম সীমান্ত গ্রন্থাগার। ওই সময় খুব বেশি পাড়ায় অমন লাইব্রেরি আমার নজরে আসেনি। অথবা হয়তো ছিল, কিন্তু ব্যবহার করা হতো না। সেই অর্থে সীমান্ত গ্রন্থাগার ছিল 'লিভিং লাইব্রেরি'। ওই লাইব্রেরিতে নিয়মিত মানুষজন আসত, বই ধার করত। ফ্রি রিডিং রুমে বসে বই অথবা পত্রপত্রিকা পড়ত। সেই সীমান্ত গ্রন্থাগার এখনো বেঁচে আছে। আমাকে দিয়ে মা অথবা দিদি প্রায়ই ওখান থেকে বই আনাতেন। মায়ের পছন্দ ছিল শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ_এসব। দিদির পছন্দ ছিল সুবোধ ঘোষ, তারাশংকর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর পরের দিকে রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর_এঁরা। ক্রমে সীমান্ত গ্রন্থাগার আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়।
লাইব্রেরি আর দ্বারকানাথ বারোরিবাবুর বাড়ির মাঝখানে, উঠোনের এক প্রান্তে একটা পাকা ভিটের ওপর বাঁধা হয়েছিল একটা দোচালা বাসা। সেখানে বাস করতেন একজন প্রৌঢ় সুতোর মিস্ত্রি আর তাঁর পরিবার। যত দূর মনে পড়ে, তার দুই সন্তান ছিল। বয়সের ফারাক থাকা সত্ত্বেও এরাও ছিল আমাদের খেলার সাথি। সময়ের আবর্তে এদের নাম-টাম ভুলে গেছি। কেবল কিছু প্যাঁজা তুলোর মতো ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি আছে মাত্র। অনেক বিকেলে আনুষ্ঠানিক খেলা_যেমন ফুটবল, ক্রিকেট বাদ দিয়ে এদের সঙ্গে মেতে উঠতাম হা ডু ডু, গোল্লাছুট অথবা টেনিস বল দিয়ে কিং-কং, কি সাতচারা খেলায়। আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল ক্রিকেট অথচ একেবারে বাড়ির পাশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কী এক আকর্ষণ খুঁজে পেতাম যে সময় পেলেই তাদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠতাম। এই খেলার একটা বড় আকর্ষণ এই ছিল যে এখানে কোনো লিঙ্গভেদ ছিল না। ছেলে এবং মেয়েরা মিলে এই খেলা খেলত। আরো একটি আকর্ষণ এই ছিল যে সেখানে আমার মাতব্বরি করার বিস্তর সুযোগ ছিল। আমি ওদের খেলা ওদের চেয়ে বেশি ভালো খেলতে পারতাম।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যে গেণ্ডারিয়ার সব মানুষ ও সব গলিঘুঁজি অতি পরিচিত হয়ে গেল। মফস্বল থেকে আসা লাজুক প্রকৃতির আমি হয়ে উঠলাম শহরের এক সপ্রতিভ তরুণ। তাদের সঙ্গে শহুরে সব কথাবার্তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমনকি ভাষাও বদলে যেতে লাগল। মাদারীপুর, ফেনী, খুলনা, কুষ্টিয়ায় একেক রকম টানে বাংলা বলতাম। সেটা এখন জগাখিচুড়ি ভাষায় পরিণত হয়ে গেল। ক্রমে ওই ভাষায়ই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অবশ্য গেণ্ডারিয়া পাড়ার উত্তর-পুবে একটা পাড়া ছিল, নাম 'নামাপাড়া'। অনেকে নাওয়াপাড়াও বলতেন। সেখানে আদি ঢাকাইয়াদের বাস ছিল। তারাও আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল ক্রমশ। ঢাকার আদিবাসীদের হৃদয় ছিল বিশাল। এরা একবার বন্ধু হিসেবে ধরে নিলে সেই প্রত্যয় টলানো সম্ভব ছিল না কারো পক্ষে। ঢাকাইয়াদের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল আমাদের। তাই সেই শিশুকাল থেকেই তাদের জেনেছি। বস্তুতপক্ষে আমার নানি ছিলেন পুরান ঢাকার বাদামতলীর অধিবাসী। ঢাকাইয়ারা শ্রেণীচরিত্র উপেক্ষা করেই সবাই ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ যেন। আমরা ঢাকায় আসার অনেক আগেই আমার নানি তাঁর তৃতীয় সন্তান প্রসবান্তে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। তবে তাঁর নিকট এবং দূর সম্পর্কের ভাইবোনেরা যেন হারানো মানিক ফিরে পাওয়া গেছে_এভাবে আমাদের বরণ করে নিয়েছিলেন। আদরের কোনো কমতি ছিল না। আর ছিল পুরান ঢাকার অত্যন্ত উপাদেয় খাবারের সমারোহ। চলবে...
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
'নওজোয়ান, নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান/কোটি প্রাণ, একই প্রাণ, একই শপথে বলীয়ান।'
সেই নওজোয়ান গানের সুর বিভিন্ন সময় আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে বলতে দ্বিধা নেই। বস্তুতপক্ষে একাত্তরে পাকিস্তানিদের দ্বারা আমার শহর ঢাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে যখন আমরা আমাদের গ্রামের দিকে ছুটছি, তখন আমাদের দেশের লঞ্চঘাটে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে দাদরার তালে হাঁটতে-হাঁটতে আমি আর ভাইয়া সমস্বরে গাইছিলাম_'নওজোয়ান, নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান/ কোটি প্রাণ, একই প্রাণ, একই শপথে বলীয়ান।'
আমাদের বাড়ি, ২৯ নম্বর দীননাথ সেন রোডের উল্টোদিকে বিরাট উঠানের উত্তর-পুব কোণে ছিল একটা লাইব্রেরি। নাম সীমান্ত গ্রন্থাগার। ওই সময় খুব বেশি পাড়ায় অমন লাইব্রেরি আমার নজরে আসেনি। অথবা হয়তো ছিল, কিন্তু ব্যবহার করা হতো না। সেই অর্থে সীমান্ত গ্রন্থাগার ছিল 'লিভিং লাইব্রেরি'। ওই লাইব্রেরিতে নিয়মিত মানুষজন আসত, বই ধার করত। ফ্রি রিডিং রুমে বসে বই অথবা পত্রপত্রিকা পড়ত। সেই সীমান্ত গ্রন্থাগার এখনো বেঁচে আছে। আমাকে দিয়ে মা অথবা দিদি প্রায়ই ওখান থেকে বই আনাতেন। মায়ের পছন্দ ছিল শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ_এসব। দিদির পছন্দ ছিল সুবোধ ঘোষ, তারাশংকর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর পরের দিকে রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর_এঁরা। ক্রমে সীমান্ত গ্রন্থাগার আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়।
লাইব্রেরি আর দ্বারকানাথ বারোরিবাবুর বাড়ির মাঝখানে, উঠোনের এক প্রান্তে একটা পাকা ভিটের ওপর বাঁধা হয়েছিল একটা দোচালা বাসা। সেখানে বাস করতেন একজন প্রৌঢ় সুতোর মিস্ত্রি আর তাঁর পরিবার। যত দূর মনে পড়ে, তার দুই সন্তান ছিল। বয়সের ফারাক থাকা সত্ত্বেও এরাও ছিল আমাদের খেলার সাথি। সময়ের আবর্তে এদের নাম-টাম ভুলে গেছি। কেবল কিছু প্যাঁজা তুলোর মতো ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি আছে মাত্র। অনেক বিকেলে আনুষ্ঠানিক খেলা_যেমন ফুটবল, ক্রিকেট বাদ দিয়ে এদের সঙ্গে মেতে উঠতাম হা ডু ডু, গোল্লাছুট অথবা টেনিস বল দিয়ে কিং-কং, কি সাতচারা খেলায়। আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল ক্রিকেট অথচ একেবারে বাড়ির পাশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কী এক আকর্ষণ খুঁজে পেতাম যে সময় পেলেই তাদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠতাম। এই খেলার একটা বড় আকর্ষণ এই ছিল যে এখানে কোনো লিঙ্গভেদ ছিল না। ছেলে এবং মেয়েরা মিলে এই খেলা খেলত। আরো একটি আকর্ষণ এই ছিল যে সেখানে আমার মাতব্বরি করার বিস্তর সুযোগ ছিল। আমি ওদের খেলা ওদের চেয়ে বেশি ভালো খেলতে পারতাম।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যে গেণ্ডারিয়ার সব মানুষ ও সব গলিঘুঁজি অতি পরিচিত হয়ে গেল। মফস্বল থেকে আসা লাজুক প্রকৃতির আমি হয়ে উঠলাম শহরের এক সপ্রতিভ তরুণ। তাদের সঙ্গে শহুরে সব কথাবার্তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমনকি ভাষাও বদলে যেতে লাগল। মাদারীপুর, ফেনী, খুলনা, কুষ্টিয়ায় একেক রকম টানে বাংলা বলতাম। সেটা এখন জগাখিচুড়ি ভাষায় পরিণত হয়ে গেল। ক্রমে ওই ভাষায়ই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অবশ্য গেণ্ডারিয়া পাড়ার উত্তর-পুবে একটা পাড়া ছিল, নাম 'নামাপাড়া'। অনেকে নাওয়াপাড়াও বলতেন। সেখানে আদি ঢাকাইয়াদের বাস ছিল। তারাও আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল ক্রমশ। ঢাকার আদিবাসীদের হৃদয় ছিল বিশাল। এরা একবার বন্ধু হিসেবে ধরে নিলে সেই প্রত্যয় টলানো সম্ভব ছিল না কারো পক্ষে। ঢাকাইয়াদের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল আমাদের। তাই সেই শিশুকাল থেকেই তাদের জেনেছি। বস্তুতপক্ষে আমার নানি ছিলেন পুরান ঢাকার বাদামতলীর অধিবাসী। ঢাকাইয়ারা শ্রেণীচরিত্র উপেক্ষা করেই সবাই ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ যেন। আমরা ঢাকায় আসার অনেক আগেই আমার নানি তাঁর তৃতীয় সন্তান প্রসবান্তে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। তবে তাঁর নিকট এবং দূর সম্পর্কের ভাইবোনেরা যেন হারানো মানিক ফিরে পাওয়া গেছে_এভাবে আমাদের বরণ করে নিয়েছিলেন। আদরের কোনো কমতি ছিল না। আর ছিল পুরান ঢাকার অত্যন্ত উপাদেয় খাবারের সমারোহ। চলবে...
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments