বাজারে ৬২ প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নবিদ্ধ ওষুধ! by তৌফিক মারুফ
দেশের ওষুধ সেক্টরে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে বড় ধরনের অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি। রোগী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে ওষুধ বিক্রেতারাও পড়েছেন বেকায়দায়। এর কারণ- মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি না করায় সংসদীয় কমিটির সুপারিশে সরকার ৬২টি কম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই ৬২ প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার রকমের ওষুধ বাজারে চলছে, যা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের উচিত জনস্বার্থে দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ এবং মানসম্পন্নভাবে তৈরি হয়নি এমন সব ওষুধ নিষিদ্ধ করে বাজার থেকে তুলে নেওয়া। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মকর্তাদের শাস্তির পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, নয়তো এ পরিস্থিতির অবসান হবে না।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহাবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুসারে বা অন্য যেকোনো প্রকারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা গেজেট আকারে প্রকাশ এবং পত্রপত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে কম্পানিগুলো ও চিহ্নিত ওষুধগুলোর তালিকা সর্বস্তরের মানুষকে জানাতে হবে। একই সঙ্গে ওষুধগুলো বাজার থেকে তুলে নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুরো বিষয়টিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, এগুলোর ওষুধ তো এত দিন ধরে চলে আসছে। এর মানে এসব প্রতিষ্ঠানের নিম্নমানের ওষুধ আমরাও অবলীলায় লিখে গেছি, আবার রোগীরাও তা খেয়েছে! ওষুধ প্রশাসন তাহলে কী কাজ করেছে?'
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, 'এখন চিহ্নিত হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম এবং তাদের নিম্নমানের ওষুধের তালিকা প্রকাশ না করে আরো ব্যাপক ক্ষতি করা হচ্ছে। যেসব চিকিৎসক বা রোগী এ ঘটনা জানেন না তাঁরা তো ঠিকই ওই কম্পানিগুলোর ওষুধ আগের মতোই লিখছেন এবং রোগীরাও খাচ্ছেন। আবার আমরা যাঁরা ৬২ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপের কথা জানতে পারলাম কিন্তু নামগুলো জানতে পারছি না, তাঁরা এখন কী করব? কোনো ওষুধ লিখতে গিয়েই তো বিভ্রান্তিতে ভুগছি, কারণ আমি যে ওষুধটি লিখছি, সেটি নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা কোনো কম্পানির নিম্নমানের ওষুধ কি না তা কিভাবে বুঝব?'
রাজধানীর কলাবাগান এলাকার ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম স্থানীয় লাজ ফার্মায় ওষুধ কিনতে এসে বলেন, 'প্রেশার ও ডায়াবেটিসের জন্য অনেক দিন ধরেই ওষুধ খাচ্ছি, সেদিন পেপারে দেখলাম, উপযুক্ত মান রক্ষা না করায় ৬২ ওষুধ কম্পানির উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কম্পানিগুলো বা তাদের ওষুধের নাম প্রকাশ করা হয়নি। এর পর থেকেই টেনশনে পড়ে গেছি, আমি যে ওষুধ খাই- এর মধ্যে ওই কম্পানিগুলোর ওষুধ আছে কি না।'
খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পরিস্থিতি আমরাও অনুধাবন করতে পারছি। আমি নিজেও বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারছি না। মানুষের মধ্যে ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওষুধ নিয়ে সংশয় তৈরি হতেই পারে। এটা দ্রুত অবসান করার কাজ চলছে।'
তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, 'প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করা না করার বিষয়টি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ওই সব প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়নে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে আমরা এর ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।' কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'কোন ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের জানা আছে। তালিকা সংসদীয় কমিটির কাছে এবং মন্ত্রণালয়েও আছে। আমরা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজার ও বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মানসম্পন্নভাবে তৈরি হয়নি বা কার্যকারিতা নেই এমন সব ওষুধ খুঁজে বের করে মার্কেট থেকে তুলে নিতে বলেছি। নিষিদ্ধ কোনো ওষুধ আছে কি না তা-ও দেখছি। শিগগিরই এ প্রক্রিয়া আরো জোরালো করা হবে। এ জন্য জনবল বাড়ানো হয়েছে।'
মহাপরিচালক বলেন, 'বিভ্রান্তির দিকে না তাকিয়ে চিকিৎসকরা বরং বড় বড় ওষুধ কম্পানির ওষুধ লিখলেই তো পারেন, কারণ বড় কম্পানিগুলোতে মানসম্পন্নভাবেই ওষুধ প্রস্তুত হয়ে থাকে। এ ছাড়া দেশে সব মিলিয়ে যে ওষুধ উৎপাদন বা বাজারজাত হয়ে থাকে এর মধ্যে ৮০ শতাংশই মানসম্পন্নভাবে হয় বলে আমরা জানি। বাকি মাত্র ২০ শতাংশের মতো ওষুধ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। আর এই ২০ শতাংশ নিম্নমানের ওষুধ যারা তৈরি করে সেসব কম্পানির তেমন পরিচিতিও নেই। এগুলো বুঝেশুনে ওষুধ লিখলে আর খেলে কোনো বিভ্রান্তি হওয়ার সুযোগ থাকে না।'
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, সরকারি হিসাবে দেশে অনুমোদিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানের জেনেরিক ওষুধের আওতায় ব্র্যান্ড বা ট্রেড হিসেবে তৈরি বা বাজারজাতকৃত ওষুধ আছে ২০ হাজার ৪৫৬টি। এর ২০ শতাংশ নিম্নমানের, সে সংখ্যা চার হাজারের কম নয়। আর এই চার হাজার ওষুধের বেশির ভাগই ওই ৬২টি কম্পানিতে তৈরি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও শঙ্কার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১০ মে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অভিযোগে ৬২টি ওষুধ কম্পানির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানকে তিন মাসের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। ওই বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম সাংবাদিকদের জানান, সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই মন্ত্রণালয় এ পদক্ষেপ নিয়েছে। তিন মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী ওষুধ উৎপাদন শুরু না করে, তবে তাদের সনদ বাতিলের সুপারিশ করবে কমিটি। তিনি সাময়িক বন্ধ রাখা ৬২টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করতে রাজি হননি।
সংসদীয় কমিটির তদন্ত টিমে অন্তর্ভুক্ত জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার দেশে যতগুলো ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কথা বলছে, তা পাইনি। আমরা মাত্র ১৮৩টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছি। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে মানসম্পন্ন ওষুধ প্রস্তুতে প্রয়োজনীয় গুণগত পদ্ধতি ও সুবিধাবলি আছে কি না তা পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। প্রতিবেদনে ওষুধের মান নিয়ে আমরা কোনো কাজ করিনি।' এ জন্য আলাদা পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। ফলে কোন কম্পানির কোন ওষুধ মানসম্পন্ন আর কোনটি মানসম্পন্ন নয়, এমন কিছু প্রতিবেদনে নেই। ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম জনস্বার্থে প্রকাশ এবং তাদের নিম্নমানের ওষুধ চিহ্নিত করে তা দ্রুত বাজার থেকে প্রত্যাহার প্রয়োজন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি যেহেতু তদন্ত কমিটির সঙ্গে যুক্ত, তাই এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না।'
ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওই কম্পানিগুলোর ওষুধ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমরা জানতে পারছি না ওই ওষুধ কোনগুলো। তালিকা নিয়ে কেন লুকোচুরি করা হচ্ছে তা-ও বুঝতে পারছি না। কিভাবে এবং কোন কোন দিক বিবেচনায় নিয়ে ওই তালিকা করা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়, সঠিক মানদণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে মানসম্পন্ন উপায়ে ওষুধ প্রস্তুত না করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরো বেশি হবে।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মান দেখার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নাজমুল হাসান এমপিকে প্রধান করে ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই সংসদীয় উপকমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে সংসদ সদস্যের বাইরে আরো তিনজন বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উপকমিটি দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ শেষে গত বছরের ৩ জুলাই সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদন পেশ করে। এতে ৬২টি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে বলে চিহ্নিত করা হয়। এর ভিত্তিতে মূল কমিটি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে ওই ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। এরপর ওষুধ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১৮ ডিসেম্বর চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তবে এ কমিটি ওই ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নিজেরা আবার তদন্ত করে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১৮টি কম্পানির ওপর তদন্ত করে ৯টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে এবং এ বিষয়ে গত ২২ মার্চ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন দেখে সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ক্ষুব্ধ হন। পরে সংসদীয় কমিটির ১০ এপ্রিলের বৈঠকে চিহ্নিত ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ এবং বাজারজাত করে থাকলে তা প্রত্যাহার ও বাজেয়াপ্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। বৈঠকে বলা হয়, এসব নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সতর্ক হবে এবং মানসম্মত ওষুধ বাজারজাত করবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, চিহ্নিত ৬২টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে সংসদীয় কমিটির সভাপতির বক্তব্যে বলা হয় : বিষয়টি ব্যাপক আকারে প্রচার হলে বিদেশে ওষুধ রপ্তানির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। বৈঠকের পরে কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম সাংবাদিকদের বলেন, নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে তালিকা দিয়েছে, সে সম্পর্কে শেখ সেলিম বলেন, ওই তালিকায় ভুল রয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সংসদীয় কমিটির নির্দেশ উপক্ষো নয়, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংশোধন করা যায় কি না সে চেষ্টা করেছিলাম।' তাদের দেওয়া তালিকার ক্ষেত্রে কিছুটা ভুল স্বীকার করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের তালিকায় নিছক আমার ভুলের কারণেই অপসোনিন গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত হয়েছিল। আমি বরিশালে গিয়ে স্রেফ কৌতূহলবশত ওই কম্পানির কারখানা দেখতে গিয়েছিলাম, কারণ তাদের এমন কিছু প্রজেক্ট আছে যা দেশের আর কোথাও নেই। এ ক্ষেত্রে আমার পরিদর্শনের তালিকায় অপসোনিনের নাম ছিল, সেটা কী করে অন্য তালিকায় ঢুকে গেছে বুঝে উঠতে পারছি না। অপসোনিন গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ বা নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ নেই। আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও ওই ভুল স্বীকার করেছি।'
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহাবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুসারে বা অন্য যেকোনো প্রকারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা গেজেট আকারে প্রকাশ এবং পত্রপত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে কম্পানিগুলো ও চিহ্নিত ওষুধগুলোর তালিকা সর্বস্তরের মানুষকে জানাতে হবে। একই সঙ্গে ওষুধগুলো বাজার থেকে তুলে নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুরো বিষয়টিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, এগুলোর ওষুধ তো এত দিন ধরে চলে আসছে। এর মানে এসব প্রতিষ্ঠানের নিম্নমানের ওষুধ আমরাও অবলীলায় লিখে গেছি, আবার রোগীরাও তা খেয়েছে! ওষুধ প্রশাসন তাহলে কী কাজ করেছে?'
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, 'এখন চিহ্নিত হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম এবং তাদের নিম্নমানের ওষুধের তালিকা প্রকাশ না করে আরো ব্যাপক ক্ষতি করা হচ্ছে। যেসব চিকিৎসক বা রোগী এ ঘটনা জানেন না তাঁরা তো ঠিকই ওই কম্পানিগুলোর ওষুধ আগের মতোই লিখছেন এবং রোগীরাও খাচ্ছেন। আবার আমরা যাঁরা ৬২ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপের কথা জানতে পারলাম কিন্তু নামগুলো জানতে পারছি না, তাঁরা এখন কী করব? কোনো ওষুধ লিখতে গিয়েই তো বিভ্রান্তিতে ভুগছি, কারণ আমি যে ওষুধটি লিখছি, সেটি নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা কোনো কম্পানির নিম্নমানের ওষুধ কি না তা কিভাবে বুঝব?'
রাজধানীর কলাবাগান এলাকার ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম স্থানীয় লাজ ফার্মায় ওষুধ কিনতে এসে বলেন, 'প্রেশার ও ডায়াবেটিসের জন্য অনেক দিন ধরেই ওষুধ খাচ্ছি, সেদিন পেপারে দেখলাম, উপযুক্ত মান রক্ষা না করায় ৬২ ওষুধ কম্পানির উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কম্পানিগুলো বা তাদের ওষুধের নাম প্রকাশ করা হয়নি। এর পর থেকেই টেনশনে পড়ে গেছি, আমি যে ওষুধ খাই- এর মধ্যে ওই কম্পানিগুলোর ওষুধ আছে কি না।'
খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পরিস্থিতি আমরাও অনুধাবন করতে পারছি। আমি নিজেও বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারছি না। মানুষের মধ্যে ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওষুধ নিয়ে সংশয় তৈরি হতেই পারে। এটা দ্রুত অবসান করার কাজ চলছে।'
তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, 'প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করা না করার বিষয়টি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ওই সব প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়নে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে আমরা এর ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।' কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'কোন ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের জানা আছে। তালিকা সংসদীয় কমিটির কাছে এবং মন্ত্রণালয়েও আছে। আমরা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজার ও বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মানসম্পন্নভাবে তৈরি হয়নি বা কার্যকারিতা নেই এমন সব ওষুধ খুঁজে বের করে মার্কেট থেকে তুলে নিতে বলেছি। নিষিদ্ধ কোনো ওষুধ আছে কি না তা-ও দেখছি। শিগগিরই এ প্রক্রিয়া আরো জোরালো করা হবে। এ জন্য জনবল বাড়ানো হয়েছে।'
মহাপরিচালক বলেন, 'বিভ্রান্তির দিকে না তাকিয়ে চিকিৎসকরা বরং বড় বড় ওষুধ কম্পানির ওষুধ লিখলেই তো পারেন, কারণ বড় কম্পানিগুলোতে মানসম্পন্নভাবেই ওষুধ প্রস্তুত হয়ে থাকে। এ ছাড়া দেশে সব মিলিয়ে যে ওষুধ উৎপাদন বা বাজারজাত হয়ে থাকে এর মধ্যে ৮০ শতাংশই মানসম্পন্নভাবে হয় বলে আমরা জানি। বাকি মাত্র ২০ শতাংশের মতো ওষুধ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। আর এই ২০ শতাংশ নিম্নমানের ওষুধ যারা তৈরি করে সেসব কম্পানির তেমন পরিচিতিও নেই। এগুলো বুঝেশুনে ওষুধ লিখলে আর খেলে কোনো বিভ্রান্তি হওয়ার সুযোগ থাকে না।'
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, সরকারি হিসাবে দেশে অনুমোদিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানের জেনেরিক ওষুধের আওতায় ব্র্যান্ড বা ট্রেড হিসেবে তৈরি বা বাজারজাতকৃত ওষুধ আছে ২০ হাজার ৪৫৬টি। এর ২০ শতাংশ নিম্নমানের, সে সংখ্যা চার হাজারের কম নয়। আর এই চার হাজার ওষুধের বেশির ভাগই ওই ৬২টি কম্পানিতে তৈরি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও শঙ্কার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১০ মে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অভিযোগে ৬২টি ওষুধ কম্পানির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানকে তিন মাসের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। ওই বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম সাংবাদিকদের জানান, সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই মন্ত্রণালয় এ পদক্ষেপ নিয়েছে। তিন মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী ওষুধ উৎপাদন শুরু না করে, তবে তাদের সনদ বাতিলের সুপারিশ করবে কমিটি। তিনি সাময়িক বন্ধ রাখা ৬২টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করতে রাজি হননি।
সংসদীয় কমিটির তদন্ত টিমে অন্তর্ভুক্ত জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার দেশে যতগুলো ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কথা বলছে, তা পাইনি। আমরা মাত্র ১৮৩টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছি। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে মানসম্পন্ন ওষুধ প্রস্তুতে প্রয়োজনীয় গুণগত পদ্ধতি ও সুবিধাবলি আছে কি না তা পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। প্রতিবেদনে ওষুধের মান নিয়ে আমরা কোনো কাজ করিনি।' এ জন্য আলাদা পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। ফলে কোন কম্পানির কোন ওষুধ মানসম্পন্ন আর কোনটি মানসম্পন্ন নয়, এমন কিছু প্রতিবেদনে নেই। ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম জনস্বার্থে প্রকাশ এবং তাদের নিম্নমানের ওষুধ চিহ্নিত করে তা দ্রুত বাজার থেকে প্রত্যাহার প্রয়োজন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি যেহেতু তদন্ত কমিটির সঙ্গে যুক্ত, তাই এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না।'
ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওই কম্পানিগুলোর ওষুধ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমরা জানতে পারছি না ওই ওষুধ কোনগুলো। তালিকা নিয়ে কেন লুকোচুরি করা হচ্ছে তা-ও বুঝতে পারছি না। কিভাবে এবং কোন কোন দিক বিবেচনায় নিয়ে ওই তালিকা করা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়, সঠিক মানদণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে মানসম্পন্ন উপায়ে ওষুধ প্রস্তুত না করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরো বেশি হবে।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মান দেখার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নাজমুল হাসান এমপিকে প্রধান করে ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই সংসদীয় উপকমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে সংসদ সদস্যের বাইরে আরো তিনজন বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উপকমিটি দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ শেষে গত বছরের ৩ জুলাই সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদন পেশ করে। এতে ৬২টি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে বলে চিহ্নিত করা হয়। এর ভিত্তিতে মূল কমিটি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে ওই ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। এরপর ওষুধ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১৮ ডিসেম্বর চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তবে এ কমিটি ওই ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নিজেরা আবার তদন্ত করে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১৮টি কম্পানির ওপর তদন্ত করে ৯টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে এবং এ বিষয়ে গত ২২ মার্চ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন দেখে সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ক্ষুব্ধ হন। পরে সংসদীয় কমিটির ১০ এপ্রিলের বৈঠকে চিহ্নিত ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ এবং বাজারজাত করে থাকলে তা প্রত্যাহার ও বাজেয়াপ্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। বৈঠকে বলা হয়, এসব নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সতর্ক হবে এবং মানসম্মত ওষুধ বাজারজাত করবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, চিহ্নিত ৬২টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে সংসদীয় কমিটির সভাপতির বক্তব্যে বলা হয় : বিষয়টি ব্যাপক আকারে প্রচার হলে বিদেশে ওষুধ রপ্তানির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। বৈঠকের পরে কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম সাংবাদিকদের বলেন, নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে তালিকা দিয়েছে, সে সম্পর্কে শেখ সেলিম বলেন, ওই তালিকায় ভুল রয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সংসদীয় কমিটির নির্দেশ উপক্ষো নয়, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংশোধন করা যায় কি না সে চেষ্টা করেছিলাম।' তাদের দেওয়া তালিকার ক্ষেত্রে কিছুটা ভুল স্বীকার করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের তালিকায় নিছক আমার ভুলের কারণেই অপসোনিন গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত হয়েছিল। আমি বরিশালে গিয়ে স্রেফ কৌতূহলবশত ওই কম্পানির কারখানা দেখতে গিয়েছিলাম, কারণ তাদের এমন কিছু প্রজেক্ট আছে যা দেশের আর কোথাও নেই। এ ক্ষেত্রে আমার পরিদর্শনের তালিকায় অপসোনিনের নাম ছিল, সেটা কী করে অন্য তালিকায় ঢুকে গেছে বুঝে উঠতে পারছি না। অপসোনিন গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ বা নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ নেই। আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও ওই ভুল স্বীকার করেছি।'
No comments