পশ্চিমবঙ্গ-এসিড বৃষ্টিতে ভিজছে বামফ্রন্ট by অমিত বসু

২০১৩-তে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তখনই মানুষের মত কিছুটা বোঝা যাবে। ২০১৪-তে লোকসভা নির্বাচনে অবস্থাটা আরও স্পষ্ট হবে। বামফ্রন্ট ভেবেচিন্তে এবারের নির্বাচনে সব দুর্বলতা কাটিয়ে ভোটবৃষ্টিতে ভাসবে। হয়েছে উল্টো। এসিড বৃষ্টিতে ছারখার হয়েছে।


সেই জ্বালাপোড়ার যন্ত্রণা একদিনে কাটবে না। সময় দিতে হবে


১৭৯৩-এ লর্ড কর্নওয়ালিশের 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত'-এর প্রচলনে অন্তহীন অন্ধকার। চন্দ্র-সূর্য পর্যন্ত বিপর্যস্ত। গ্রাম-বাংলায় চবি্বশ ঘণ্টার লোডশেডিং। রোশনাই শুধু জমিদারের ঘরে। কর্নওয়ালিশের হাত ধরে তারা তারকা। মাটি যদি মা হয়, তাও তাদের। মানুষ যদি ক্রীতদাস হয়, তারাও মুঠোয়।
ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন নেই। এটাই আইন। আইনের শাসনের পরাকাষ্ঠা। কষ্ট করে জমিদারদের বছরে একটা কাজ, নির্দিষ্ট সময়ে ইংরেজদের কোষাগারে খাজনা তুলে দেওয়া এবং তাদের বশ্যতা মেনে নেওয়া। এক কথায় ভাগ দিয়ে ভোগ করো। মানুষকে মারো-ধরো। যত খুশি টাকার পাহাড় গড়ো। সব জমিদার এই অবিচারে সায় দেননি। বিবেকে বেধেছে। প্রজাদের পিতার মতো সামলাতে গিয়ে ইংরেজদের চক্ষুশূল হয়েছেন। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর জমিদাররা থেকেছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে জোতদাররা। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক সংগ্রাম তাদের বিরুদ্ধেই। ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসার আগেই বামফ্রন্ট স্লোগান তোলে, লাঙল যার জমি তার। ক্ষমতায় এসেই নজর দেয় ভূমি সংস্কারে। উদ্বৃত্ত জমি বণ্টন শুরু করে ভূমিহীনদের মধ্যে। অচিরেই সাফল্য আসে। জমি পেয়ে কৃষকরা বামদের পাশে দাঁড়ায়। চড়ায় আটকে থাকা গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের রাস্তা খুঁজে পায়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তাদের সাহস জোগায়। মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারীর বেতন কাঠামোর ব্যাপক পুনর্বিন্যাসে গ্রামে নতুন উপভোক্তা শ্রেণী তৈরি হয়। নির্বাচনের আগে গ্রামীণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়ায় বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
গোলাপের রূপ-গন্ধ আছে। আবার কাঁটাও আছে। প্রস্ফুটিত পুষ্পের পাপড়ির নিচে ঢাকা থাকে বলে দেখা যায় না। দেখা যায়নি সিপিএমের সেই কণ্টক। জোতদার-জমিদারদের হটিয়ে সিপিএমের জোয়ার নিষ্কণ্টক ছিল না। দলতন্ত্রকে যন্ত্র করে তৈরি হলো আঞ্চলিক মাতব্বরগোষ্ঠী। তাদের কথা শুনতে হবে, নইলে মরতে হবে। যদি বাঁচতে চাও তাদের কাছে মাথা নোয়াও। শীতে কম্বল পাবে, আর্থিক সম্বল বাড়বে। জঙ্গল কেটে বসত গড়তে পারবে। শিক্ষিত হলে চাকরি মিলবে। চাষি হলে জমি হাতে আসবে। জুলুমের প্রতিবাদ করলে জাহান্নামে যাবে।
জমিদারের জায়গায় গ্রামে অত্যাচারী মাতব্বর তৈরি হচ্ছে_ সিপিএম কি জানত না? জানত। জেলার রিপোর্ট পেঁৗছেছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সদর দফতরে। তবু চুপ করে থেকেছে। গরজ বড় বালাই। চালের কাঁকরের মতো তাদের ছুড়ে ফেলার উপায় নেই। তারাই যে ভোটের জোগানদার, তারা থাকলে ভোটের জন্য ভাবতে হয় না। ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক, লোকে সুড়সুড় করে সিপিএমকে ভোট দেবে। কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথায় জমির সর্বময় কর্তা হয়ে জমিদাররা যতই অত্যাচার করুক, ইংরেজদের বার্ষিক খাজনার গ্যারান্টি দিয়েছিল। সময়মতো কোষাগার ভর্তি হওয়ায় ইংরেজ শাসকরা তাদের ওপর প্রসন্ন ছিল। জমিদারদের আচার-আচরণ নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ খুঁজে পেত না। সিপিএম মাতব্বররা জমিদারের বিকল্প। তাদের বিরুদ্ধে নালিশ উঠলে গুরুত্ব দিত না কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। উচ্চমার্গীয় নেতাদের দরকার ছিল ভালো লোক নয়, কাজের লোক। যারা ছলে-বলে-কৌশলে ভোটবাক্স ভরতে পারে। দুর্জন হলেও তাদের সাতখুন মাফ। সিপিএম নেতাদের কাণ্ড দেখে লর্ড কর্নওয়ালিশ যদি কবরে শুয়ে হেসে ফেলেন দোষ দেওয়া যায় না।
পাঁচ বছরে চারটি ভোট। পঞ্চায়েত, পৌরসভা, লোকসভা, বিধানসভা। ভোট ইন্ডাস্ট্রিতে ভোট উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় জিততে হলে স্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়া অসম্ভব। কাজের লোক ছাঁটলে বিরোধীদের কেল্লাফতে। না, শুদ্ধিকরণ বা সংস্কার কোনো কাজের কথা নয়। লোক দেখানোর জন্য ফুঁ দিয়ে ওপরের ধুলো ওড়ানো যেতে পারে, ভেতরে নজর দেওয়া দরকার নেই। সেটা করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে।
প্রথমদিকে সিপিএম মাতব্বরদের ক্ষমতার তাপে পপকর্নের মতো ভোট ফুটেছে। লাল অতিরিক্ত আঁচে ভুট্টা পুড়ে ছারখার। সিপিএমের আগুনে পোড়া মানুষ আস্তানা খুঁজেছে বিরোধী শিবিরে।
২০০৬ পর্যন্ত বিরোধী শিবিরটা ছিল তালগাছের মতো; যেখানে আশ্রয়ের সুযোগ নেই। তালকানা। মাথার ওপর পড়লে সর্বনাশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব এটাই, তালগাছকে বিশাল বটগাছে পরিণত করেছেন।
ভারতের বৃহত্তম বটগাছটি অন্ধ্রের অনন্তপুর জেলায়। ২ দশমিক ১ হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত। দ্বিতীয়টি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এর বিস্তার ১ দশমিক ২ হেক্টর। তৃতীয়টি উদয়পুরে; ১ দশমিক ৩২ হেক্টরজুড়ে বিরাজ করছে। মমতা যে গাছটা পুঁতেছেন সেটা কিন্তু ছড়িয়েছে আরও অনেক বেশি; পশ্চিমবঙ্গের ৮৮,৭৫২ বর্গকিলোমিটারজুড়ে দাঁড়িয়ে।
বিশ্বাস করেনি বামফ্রন্ট। বাস্তবতা অস্বীকার করে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের একমাত্র আশ্রয় বামফ্রন্ট। ভোটের পর সিপিএমের মাতব্বররা জেলা থেকে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তাও ভুলে ভরা। বুক চাপড়ে তারা বলেছে, বামরা জিতছে। পরিবর্তনের হাওয়া ঘুরিয়ে প্রত্যাবর্তন করছে বামফ্রন্ট। এটা কি ইচ্ছাকৃত ভ্রান্তি, না চরম অজ্ঞতা! মানুষের কম বুঝতে না পারাটা রাজনীতিকদের চরম ব্যর্থতা।
জ্যোতি বসু বারবার বলেছেন, মানুষের মন বুঝে চল। তারা কী চাইছে দেখ। লোক চিনতে না পারলে রাজনীতি শেষ। ওপর থেকে কিছু চাপালে মানুষ নেয় না।
সে কথা কানে তোলেননি বর্তমান নেতারা। নিজেরা যা ভালো বুঝেছেন তা-ই করেছেন। মানুষকে জোর করে নিজেদের রাস্তায় টানতে চেয়েছেন। ১৯৯৬-এ সারাদেশ যখন চেয়েছে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে, তারা রাজি হননি। জ্যোতি বসু বলেছেন, এটা ঐতিহাসিক ভুল। তবু তারা সিদ্ধান্ত বদলাননি। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি।
বাম শক্তি মাত্র তিনটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরা ছাড়া বামদের খুঁজে পাওয়া যায় না। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বামদের জমি তৈরির সুযোগ থাকত। অন্তত তাদের কর্মসূচি মানুষের কাছে পেঁৗছত। সেটা হলো না।
দিলি্লতে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপিকে দূরে রাখতে কংগ্রেসের বিকল্প নেই। সেটাও মানবেন না নেতারা। ২০০৪-এ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন দিয়েও সাড়ে চার বছর পর সরে এসেছে। তুলনাহীন হঠকারিতার মাশুল দিতে হয়েছে সিপিএমকে। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। সিপিএমে গোলমালের শুরু হরকিষেণ সিং সুরজিৎকে সরিয়ে প্রকাশ কারাট সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর। তত্ত্বকথার ওপর ভিত্তি করে যে দল চালানো যায় না, জানেন না তিনি। ভোটে দাঁড়ান না বলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো যোগ নেই। নিজের 'আইডিয়া' মার্কেটিং করার কৌশল জানা থাকলেও কথা ছিল। সেটাও রপ্ত হয়নি।
জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিং সুরজিৎ বরাবর কংগ্রেসের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধী ছিলেন জ্যোতি বসুর বিশেষ বন্ধু। রাজনীতিতে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা পরবর্তী প্রজন্মের নেতারা মানেননি। শত্রু চিহ্নিত করে লড়াই চালানোটাই একমাত্র লক্ষ্য বলে জেনেছেন। শত্রুকে মিত্রে পরিণত করাটাও যে রাজনীতির অঙ্গ বিশ্বাস করেন না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনো দিনই গুরুত্ব দেয়নি সিপিএম। বিরোধী নেত্রী হিসেবে যে সম্মান তার প্রাপ্য, সেটা পাননি তিনি। সিপিএম ভুলে গেছে, অর্ধেক ভোট বিরোধীদের। তাদের বাদ দিয়ে রাজ্য চালানো অসম্ভব। রাজ্যের কল্যাণে বা উন্নয়নে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করাটা অবিবেচনার কাজ।
বামফ্রন্টের হিমালয়ান ব্লান্ডার, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া। মানুষকে না বুঝিয়ে জমি কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ভয়ঙ্কর। কৃষকের চোখে জমি যে জননী সেটা ভুলে গেল। জমি দিলে কী লাভ বা কী ক্ষতি বোঝানোই হলো না মানুষকে। জনসাধারণের সঙ্গে সরকারের দূরত্বটাই কাজে লাগাল বিরোধীরা। অথচ বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে কাজটা করলে এই বিপদ এড়ানো যেত। নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুতে তোলপাড় হলো পশ্চিমবঙ্গ। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। সেই ঝড় পেঁৗছল ২০০৯-এ লোকসভা নির্বাচনের পোলিং বুথে। ক্ষতি শুরু অবশ্য এখানে নয়, তার এক বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটে। যেখানে ছিল বামফ্রন্টের শিকড়, সেটাই উপড়ে ফেলল বিরোধীরা। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় সবার ওপরে জেলা পরিষদ, এরপর পঞ্চায়েত সমিতি, এর নিচে গ্রাম পঞ্চায়েত। জেলা পরিষদে কিছুটা মান বাঁচলেও তৃণমূল স্তরে অর্থাৎ গ্রাম পঞ্চায়েতে বামফ্রন্ট ছারখার হয়ে গেল।
২০১১-তে নির্বাচনের আগে শুরু হয় বামফ্রন্টের ক্ষমা চাওয়ার পালা। জনসমাবেশে চিৎকার করে বলতে লাগল, আমরা ভুল করেছি। আমাদের ক্ষমা করুন। ততদিনে মানুষ বামফ্রন্টকে শাস্তি দিতে প্রস্তুত। বিরোধী আন্দোলনের হাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্ত মুঠোয়। রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের সাংগঠনিক শিকড়। প্রত্যন্ত গ্রামেও তৃণমূলের শিবিরে যুদ্ধের আয়োজন।
তখনও কিন্তু মাটিতে মুখ গুঁজে বামফ্রন্ট। বাস্তব ছেড়ে স্বপ্নে বিভোর। পার্টি ক্যাডার থেকে নেতা জয় সম্পর্কে নিশ্চিত। তাদের টার্গেট শুধু মিডিয়া। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা, মিডিয়া আমাদের শেষ করতে চাইছে। অপপ্রচারে ডোবাচ্ছে। কিন্তু পারবে না। কারণ, আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন।
১৩ মে ফল ঘোষণার পর বামফ্রন্ট পর্দার আড়ালে। পলিটব্যুরোয় পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ। সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট সাফাই দিচ্ছেন, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান আক্রমণের জাল ছিঁড়ে বেরোতে চাইছেন। কিন্তু এসব করে লাভ? যা হওয়ার তা তো হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি পলিটব্যুরো বৈঠকে নতুন কর্মসূচি ঠিক করবে সিপিএম।
সেখানে আরেকটা বড় প্রশ্নের মীমাংসা হবে, প্রকাশ কারাট থাকবেন, না যাবেন। প্রকাশের অন্যতম সহযোগী সীতারাম ইয়েচুরি তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত পারবেন কি-না সেটা পরের কথা। তবে এখন যা অবস্থা, জোড়াতালি দিয়ে চলবে না। খোলনলচে বদলাতে হবে। কারাট জানিয়েছেন, কার্ল মার্কসের তত্ত্বের প্রয়োগ যুগে যুগে বদলেছে। আমরাও বদলাব। কিন্তু নিজেদের বদলানো যে সবার আগে জরুরি, মার্কসের দর্শনে সে বিষয়ে কোনো পথনির্দেশ নেই। তিনি সর্বাঙ্গীণ আর্থ-সামাজিক বিকাশের রাস্তা দেখিয়েছেন। সর্বহারাদের নেতৃত্বে দেশ চালানোর কথা বলেছেন। সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার কোনো ফর্মুলা দিতে পারেননি। তার আকর গ্রন্থ 'ড্যাস ক্যাপিটাল'-এ যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার কোনো পথনির্দেশ নেই।
মানুষ মানুষ খোঁজে। না পেলে হতাশ হয়। পার্থিব প্রাপ্তির চূড়ান্ত জায়গায় পেঁৗছেও সেই খোঁজ বন্ধ হয় না। একমাত্র মানুষই মানুষকে ভালোবাসতে পারে। সৌহার্দ্যের অকৃত্রিম সৌকর্যে চিরস্থায়ী সমাজ গঠিত হতে পারে। একজন রাজনীতিকের সব থেকে বড় কাজ মানুষের বন্ধু হওয়া। তা-ই যদি না পারল তো কী হলো?
বামফ্রন্টে সেটারই বড় অভাব। বিপর্যয়ের দিনে পাশে থাকাটাই বন্ধুত্বের সব থেকে বড় প্রমাণ। সেটা কোথায়? ছোট শরিকরা বড় শরিক সিপিএমকে প্রকাশ্যে তুলাধোনা করছে। সব দোষ তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে বলছে, বামফ্রন্ট মরেছে সিপিএমের দোষে। এসব অপরিণত রাজনীতির ছাপ। কাঁচা কথায় পাকা রাস্তা তৈরি হয় না। ব্যর্থতার দায় সবাইকে নিতে হবে। নইলে লোকে বলবে, হেরেছ বলে সিপিএমের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেতে চাইছ। সিপিএমকে যদি না-ই মানো ফ্রন্টে আছ কেন? বেরিয়ে যাও।
জোটের রাজনীতিতে ঘোঁট পাকালে বিপদ সবারই। বামফ্রন্ট হারলেও ২০০৬-এর থেকে খুব কম ভোট পায়নি। সেবার ১ কোটি ৯৮ লাখ ভোট পেয়ে ২৯৪-এর মধ্যে ২৩৫টি আসন দখল করেছিল। এবার ১ কোটি ৯৬ লাখ ভোট পেয়ে ধরে রাখতে পেরেছে মাত্র ৬১টি আসন। কেরালায় কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় এসেছে বামদের থেকে মাত্র ০.৯৮ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে। পশ্চিমবঙ্গে বিপদের প্রধান কারণ নতুন ভোটারদের বিমুখতা।
এবার নতুন ভোটার হয়েছে ৪৮ লাখ, এর মধ্যে ৩৭ লাখই তরুণ। যারা বামফ্রন্টকে জন্মাতে দেখেনি। তাদের জন্ম ১৯৭৭-এর পরে। অর্থাৎ সাতাত্তরে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার আগের সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে তারা অনভিজ্ঞ। সেই তরুণ ভোটারদের ৩৪ লাখ ভোট দিয়েছে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটকে। মাত্র ১০ লাখ বামফ্রন্টের দিকে গেছে।
এতে পরিষ্কার, নতুনরা বামদের সঙ্গে নেই। ৩৫ বছরের পুরনো সরকারকে ফেলে দেওয়াটাই তারুণ্যের ধর্ম বলে মনে করেছে। বামফ্রন্টের সামনে এখন সব থেকে বড় কাজ নতুন হওয়া। চিন্তা-ভাবনা, কাজ-কর্মে সব ক্ষেত্রে।
সিপিএমের অনেক নেতাই চাইছেন, এখনই কংগ্রেস তৃণমূল জোট সরকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই যদি করেন তবে সেটাও হবে মস্ত বড় ভুল। সংকটাপন্ন রোগী বাঁচবে কী মরবে তিন দিনের আগে বলতে পারেন না ডাক্তাররা। নতুন সরকারের থাকা না-থাকাটা তিন বছরের আগে জানা সম্ভব নয়। পলিটিক্যাল থিয়োরি সেটাই বলে। বামরা যদি জোর করে তাদের মারতে যায়, ভুল হবে। জঙ্গি আন্দোলনে বামরা তুলনাহীন। চাইলে মমতা সরকারকে তারা অচল করে দিতে পারে। কিন্তু খুনিকে মানুষ কখনোই ভালো চোখে দেখে না। ২০১৩-তে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তখনই মানুষের মত কিছুটা বোঝা যাবে। ২০১৪-তে লোকসভা নির্বাচনে অবস্থাটা আরও স্পষ্ট হবে।
বামফ্রন্ট ভেবেচিন্তে এবারের নির্বাচনে সব দুর্বলতা কাটিয়ে ভোটবৃষ্টিতে ভাসবে। হয়েছে উল্টো। এসিড বৃষ্টিতে ছারখার হয়েছে। সেই জ্বালাপোড়ার যন্ত্রণা এক দিনে কাটবে না। সময় দিতে হবে।

অমিত বসু : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.