চিকিৎসা-মানুষের দেহ কি শুধুই একটা যন্ত্র? by অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ও ফরিদ কবির

একজন জীবিত মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রায় যন্ত্রের কলকবজার মতো কাজ করলেও মানুষের পুরো দেহকাঠামোটি ঠিক যন্ত্র নয়। যন্ত্র বিকল হয়ে গেলে তার অনেক অংশই আবার ব্যবহার করা যায়, মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক তেমন হয় না। মানুষ মারা গেলে তার প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই বিকল হয়ে পড়ে।


সেগুলো আর সচল করা যায় না, পুনর্ব্যবহারও করা যায় না। তবে মানুষের মৃত্যুর একটি বিশেষ অবস্থায় তার অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্য মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়; এবং তা সচলও থাকে। মানুষের ক্ষেত্রে এ বিশেষ অবস্থাটি তৈরি হয় কোনো মানুষের ‘ব্রেন-ডেথ’ হলে! এ রকম একজন মানুষকে আমরা গ্রহণ করে নিই ‘মৃত মানুষ’ হিসেবেই। কিন্তু এ ধরনের মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে জীবিত, যা অন্য শরীরে ঠিকমতো প্রতিস্থাপন করতে পারলে তা কাজ করতে পারে! অন্য দেহকে সচল রাখতে পারে!
একজন জীবিত মানুষের শরীর ও মনের গতি-প্রকৃতি সত্যিকার অর্থেই বেশ জটিল। আজকাল প্রযুক্তির এতটাই উন্নতি হয়েছে যে একজন মানুষের রোগের বিবরণ কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দিলে তার সম্ভাব্য ওষুধের নাম কম্পিউটারই বলে দিতে পারে। চিকিৎসার ব্যাপারে কম্পিউটারের অনেক ধরনের সহায়তা নিলেও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য আমরা চিকিৎসকেরই শরণাপন্ন হই। কারণ, অসুস্থতার সঙ্গে মানুষের আবেগ-অনুভূতির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানুষ তাই এখনো রোগব্যাধি হলে চিকিৎসকেরই শরণাপন্ন হয়। মানুষের জন্য সঠিক ও যথাযথ ওষুধটি কেবল একজন চিকিৎসকের পক্ষেই নির্বাচন করা সম্ভব। কারণ, একটি ওষুধ নির্বাচনের সময় চিকিৎসককে অনেক কিছুই বিবেচনায় আনতে হয়। রোগীর শারীরিক বা মানসিক অবস্থাই শুধু নয়, রোগীর অর্থনৈতিক অবস্থাও চিকিৎসককে বিবেচনার মধ্যে রাখতে হয়। যদিও সবার আগে একজন চিকিৎসককে বিবেচনায় নিতে হয় একটি ওষুধের নানা রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকির বিষয়টি।
একটা সময় ছিল যখন সান্নিপাত জ্বর বা টাইফয়েড হলে প্রায়ই মানুষের অঙ্গহানি হতো বা রোগী মারা যেত। প্রাচীনকালে ওষুধ খুব কার্যকর না হলেও সেগুলোর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল না। কিন্তু বর্তমানকালে এমন অনেক ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে, যেগুলো খুবই কার্যকর এবং শক্তিশালী; কিন্তু তাতে আছে নানা রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকিও। ওষুধের নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এসব ওষুধ সেবনের ফলে আজকাল এমন অনেক মানুষও পাওয়া যাবে, যারা ওষুধসৃষ্ট রোগে ভুগছে!
একজন প্রকৃত চিকিৎসক শুধু রোগীর চিকিৎসকই নন, তিনি রোগীর অভিভাবক ও পথনির্দেশক। রোগীর প্রতি চিকিৎসকের সহমর্মিতা না থাকলে ওষুধের যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি আছে, তা চিকিৎসকের অজান্তেই উপেক্ষিত হতে পারে। এর ফলে অনেক সময় রোগীর সংশ্লিষ্ট রোগটি সেরে গেলেও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তার শরীরে অন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের জটিলতায় রোগীর অঙ্গহানি, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যে কারণে ওষুধ দেওয়ার আগে একটি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিকিৎসককে অবশ্যই ভালোভাবে জানতে হবে।
আমরা মনে করি, একটি ওষুধের কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ঝুঁকি আছে, তা জানার অধিকার যেমন রোগীদের আছে, তেমনি রয়েছে সাধারণ নাগরিকেরও। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের উচিত, বিভিন্ন ওষুধের ঝুঁকি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা। তবে সবচেয়ে ভালো হয়, চিকিৎসক নিজেই যদি ওষুধ দেওয়ার সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ঝুঁকি সম্পর্কে রোগীকে অবহিত করেন।
আমাদের দেশে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই দোকান থেকে ওষুধ কিনে খান। এর ফলে আমাদের দেশে ওষুধসৃষ্ট রোগের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ওষুধ বিক্রি করা আমাদের দেশে আইনসংগত না হলেও ওষুধের দোকান থেকে মানুষ যেকোনো ওষুধ সহজেই সংগ্রহ করতে পারে। উন্নত বিশ্বে সামান্য কয়েক ধরনের ওষুধই কেবল ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনা যায়, যেগুলোকে ‘ওটিসি’ (ওভার দ্য কাউন্টার) নামে অভিহিত করা হয়। অন্যান্য ওষুধ ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনা যায় না। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ঝুঁকি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষ এখনো ততটা সচেতন বা সতর্ক নয়। যে কারণে চিকিৎসকদের উচিত হবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে ওষুধ ব্যবহার করা।
তিনিই সফল চিকিৎসক, যিনি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ঝুঁকি সম্পর্কে নিজে অবহিত, যিনি রোগীকে ওষুধ দেন সতর্কতার সঙ্গে, রোগীর সার্বিক দিক বিবেচনা করে। রোগীর চিকিৎসা করেন পরম মমতায়, সহানুভূতির সঙ্গে, সহমর্মিতার সঙ্গে।
অধ্যাপক এ কে আজাদ খান: চিকিৎসক।
ফরিদ কবির: লেখক।

No comments

Powered by Blogger.