সাংসদ গিয়াস উদ্দিনের যত অনিয়ম-সাংসদের নিয়োগ-বাণিজ্য ঘুষ নিয়েও চাকরি দেননি
শিক্ষক নিয়োগের জন্য ঘুষ নিয়েছিলেন গফরগাঁওয়ের সাংসদ গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ। আর ঘুষ দিয়েছিলেন সাংসদেরই ঘনিষ্ঠ, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার কবীর। আনোয়ার কবীর গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন,
উপজেলার রসুলপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য তিনি দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন সাংসদকে। কিন্তু আরও বেশি টাকা নিয়ে সাংসদ অন্য একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি এখনো টাকা ফেরত পাননি।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এই আনোয়ার কবীর সাংসদের পক্ষে প্রস্তাবক ছিলেন। তিনি এখন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ভাবখালী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
আনোয়ার কবীর জানান, ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে সাংসদের তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল ইসলামের হাতে তিনি দুই লাখ টাকা দেন। সাংসদের পরামর্শেই তিনি সাইফুলের হাতে টাকা দেন বলে জানান। এ সময় স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান ও উপজেলা পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ইলিয়াস উপস্থিত ছিলেন। পুরো বিষয়টি জানতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদের ঘনিষ্ঠ মীর আবু তালেব। টাকা লেনদেনের সময় উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করে আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি সাংসদ বেশি টাকা পেয়ে অন্য আরেকজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। সাংসদের সঙ্গে কথা বলে টাকা উঠিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন মীর আবু তালেব। একাধিকবার তাঁর সঙ্গে বৈঠকও হয় এ বিষয়ে।’
জানতে চাইলে আবু তালেব বলেন, ‘টাকা তুলে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু সাংসদ এখন টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করছেন। সাংসদ বলছেন, সাইফুল ও সাংসদের সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আবদুস সালাম টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছেন।’ তালেব বলেন, সাংসদ এই টাকা সাইফুল ও সালামের কাছ থেকে উদ্ধার করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁকে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি। তালেব জানান, সাংসদের কথা বলে এপিএস আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে টাকা নেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, তালেব ও সালামের উপস্থিতিতে বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে। তাঁকে আরও প্রশ্ন করা হলে ‘আপনি কথা রেকর্ড করছেন’ বলেই লাইন কেটে দেন।
গফরগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ এবং রৌহা নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়কে এমপিওভুক্তির কথা বলে সাংসদ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। গত ১৭ ডিসেম্বর গফরগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান আবদুল খালেক। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যান ফাহমী গোলন্দাজসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, ১২-১৩ লাখ টাকার বিনিময়ে আবদুল খালেককে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন সাংসদ গিয়াস। এর পরদিনই এই নিয়োগ দেওয়া হয়।
৩১ ডিসেম্বর এই নিয়োগ বাতিলের দাবিতে অভিভাবকসহ স্থানীয় লোকজন উপজেলা সদরে মিছিল করে। অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ওই কলেজের তিনজনসহ ১৪ জন আবেদন করেছিলেন। সাংসদ গিয়াস ওই কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি।
রৌহা নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উপজেলা পৌর জামায়াতের নেতা ও গফরগাঁও উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি মারুফ আহম্মেদ। অভিযোগ আছে, সাংসদ অর্থের বিনিময়ে জামায়াতের প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি করিয়েছেন। এ নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
জানতে চাইলে মারুফ আহম্মেদ টাকা দিয়ে এমপিওভুক্তি হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, এখন আর তিনি রাজনীতি করেন না। এদিকে অর্থের বিনিময়ে ভুয়া নিবন্ধন করিয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণীর কার্যক্রম বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া লংগাইর বালিকা মাদ্রাসার সুপার পদে সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছেন লংগাইর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু বকর ছিদ্দিক। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ কর্মী মজিদ হত্যা মামলার আসামি তিনি। অভিযোগ আছে, অর্থের বিনিময়ে সাংসদ এই নিয়োগে সহায়তা করেন। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটিও করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত তিন বছরে জেলার গফরগাঁও উপজেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে।
টাকা নিয়ে শিক্ষকসহ নানা পদে নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে গফরগাঁও উপজেলার পাঁচপাইর দাখিল মাদ্রাসা, হান্নান মাস্টার বহুমুখী হাইস্কুল, লামকাইন উচ্চবিদ্যালয়, জয়ধরখালী উচ্চবিদ্যালয়, গয়েশখালী গার্লস স্কুল, ছিপান উচ্চবিদ্যালয়, কান্দিপাড় আবদুর রহমান ডিগ্রি কলেজ, পাগলা সাহেব আলী একাডেমি, চরমলন্দ উচ্চবিদ্যালয়সহ আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, সাংসদ নিজে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হতে পারেন। এ ছাড়া সাংসদের চাহিদাপত্র (ডিও লেটার) অনুযায়ী এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ গঠন করতে হয়। এই সুযোগ নিয়েই সাংসদ নির্বাচনী এলাকার সব প্রতিষ্ঠানে তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিসহ অন্যান্য পদে বসিয়েছেন। তাঁদের মাধ্যমেই নিয়োগ-বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ গিয়াস উদ্দিন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিপত্র অনুযায়ী নিয়োগ হয়। আর কমিটি নিয়োগ দেয়। আমি কেন প্রভাব বিস্তার করতে যাব। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই।’ তাঁর দাবি, গত তিন বছরে এলাকায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করায় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে একটি মহল একের পর এক বিরোধ সৃষ্টিসহ মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে।
রোববার রাতে আবারও তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আর নতুন করে কিছু বলতে চাই না। যা বলার শনিবারই বলেছি।’
সাংসদের আবদার: শুধু নিয়োগই নয়, সাংসদ গিয়াসের বিরুদ্ধে মনোনীত ডিলারের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া টিআর-কাবিখার খাদ্যশস্য বিতরণ না করার জন্যও উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৪ এপ্রিল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে দেওয়া এক চাহিদাপত্রে সাংসদ গিয়াস এ পর্যন্ত বিশেষ বরাদ্দের টিআর কাকে কাকে দেওয়া হয়েছে এর তালিকা ও পরিমাণ ফাহাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজল মিয়ার কাছে হস্তান্তর করার জন্য নির্দেশ দেন। ভবিষ্যতে টিআর-কাবিখার খাদ্যশস্য বরাদ্দ যাতে তাঁর প্রতিনিধির পরামর্শ ছাড়া না দেওয়া হয়, সে নির্দেশও দেন সাংসদ।
জবাবে গফরগাঁও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ১৬ এপ্রিল পাল্টা চিঠিতে জানিয়ে দেন, বিধি মোতাবেক সাংসদের প্রতিনিধির কাছে খাদ্যশস্য বরাদ্দের তালিকা দেওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলেও চিঠিতে বলা হয়।
No comments