রোটারির মহাসমুদ্রে-মাত্র একজন মানুষের পাশে দাঁড়াও by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
যেদিকে তাকাই, বন্ধু আর বন্ধু, এত বন্ধুও ভাগ্যে ছিল, কে জানত। বাংলাদেশের মানুষ শুনে অন্যান্য দেশের রোটারিয়ানরা গলা জড়িয়ে ধরেছেন, বলেছেন, শুনেছি তোমাদের দেশ সবচেয়ে সুন্দর, শ্যামল, যেখানে বাস করে পৃথিবীর নামকরা ব্যাঘ্র, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বাস করে ষোল কোটি শুভ্রহৃদয় মানুষ,
অল্পে যারা তুষ্ট, সব ধর্মের মানুষকে যারা আহ্বান জানায়
ব্যাংককে কুড়ি বছর পর। নতুন অনুভূতি। দু'দশকে এ শহর ও জাতি এগিয়ে গেল সামনের দিকে, দেখে বিস্মিত। বিশাল ব্যাংকক, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেতে সময় কুড়ি মিনিট, স্কাই ট্রেইন, ফ্লাইওভার, চকচকে বাস-ট্যাক্সি-টুকটুক চলে মুহূর্তের ইশারায়, প্রতি মানুষ কাজ করছে সকাল থেকে সন্ধ্যা অক্লেশে, বসে নেই কেউ।
পাঁচশ' বঙ্গসন্তান এসেছি রোটারির ১০৩তম কনভেশনে যোগ দিতে, পঁচিশ হাজার রোটারিয়ান পৃথিবীর সব দেশ থেকে। এ এক অনন্য অনুভূতি। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এসেছে নানা রঙের নানা ভাষার মানুষ। সবাই সবার গলা জড়িয়ে ধরছেন, কেউ পুরনো বন্ধু, কেউ নতুন বন্ধুত্বে আবদ্ধ। শত খাবারের ঘর, খাবার খেতে গিয়ে বন্ধুত্ব, 'হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপে' গান-নৃত্য জুড়ে দিয়েছেন গানপাগল বন্ধুরা, সঙ্গে শত স্টল যেখানে মেলে ধরেছি কে কোথায় সমাজের জন্য কী কাজ করেছি। প্রজেক্টে আনন্দ পান যারা, বক্তৃতার আসরে নেই উপস্থিত। সারাদিন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেসব সফল প্রজেক্টের উদ্যোক্তাদের যারা স্টল খুলে বসেছেন, আলাপ করছেন কীভাবে এটি তাদের দেশে উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব। অর্থের অভাব নেই, যে যত প্রজেক্ট করতে চান সম্ভব, অর্ধেক অর্থ জোগাবে রোটারি ফাউন্ডেশন। ঢাকা রোটারি ক্লাব আগামী বছর পঁচাত্তরতম জন্মদিন [আমিও হবো ৭৫] পালন করবে, বাংলাদেশেও রোটারি আগমনের ৭৫তম বছর। ঢাকা ক্লাব থেকে এক ডজন রোটারিয়ান ব্যস্ত 'হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপে'। তেরোজন রোটারি গভর্নর : ইফতেখারুল আলম, হাবিবুল্লাহ খান, এমএ মাহবুব, প্রফেসর হাফিজুল্লাহ, ড. মোশাররফ হোসেন, এমএ আউয়াল, জামাল উদ্দিন, মীর আনিসুজ্জামান, ড. মনজুরুল হক চৌধুরী, ড. ইশতিয়াক আবিদ-উজ-জামান, গোলাম মোস্তফা, সাফিনা রহমান, কমডোর রহমান ও আমাদের দু'জনকে দেখে বাংলাদেশের ১৬০টি ক্লাবের ও পশ্চিমবঙ্গের রোটারিয়ানরা মহাখুশি। আসমা ও আমি কনভেনশনে আসিনি কোনোদিন, অর্থের প্রয়োজন। পারিবারিক বন্ধু কল্যাণ ব্যানার্জি রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট। তার স্ত্রী বিনতা ব্যানার্জি বললেন, আসমা, তোমাকে এবার আসতেই হবে, তা না হলে আর কথা বলব না। সেই সুবাদেই প্রথমবারের মতো কনভেনশনে দিয়েছি উপস্থিতি। বক্তৃতা মঞ্চে উঠে দাঁড়াইনি, গাইনি কোনো গান, কোনো কবিতা, একমাত্র হজ ও ইরানে অনুষ্ঠিত রুমি কনফারেন্স ছাড়া এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোনো কনভেনশনে বা জনসমাবেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারিনি।
যেদিকে তাকাই, বন্ধু আর বন্ধু, এত বন্ধুও ভাগ্যে ছিল, কে জানত। বাংলাদেশের মানুষ শুনে অন্যান্য দেশের রোটারিয়ানরা গলা জড়িয়ে ধরেছেন, বলেছেন, শুনেছি তোমাদের দেশ সবচেয়ে সুন্দর, শ্যামল, যেখানে বাস করে পৃথিবীর নামকরা ব্যাঘ্র, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বাস করে ষোল কোটি শুভ্রহৃদয় মানুষ, অল্পে যারা তুষ্ট, সব ধর্মের মানুষকে যারা আহ্বান জানায়। যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে চারদিনে ৬-৯ মে, তাদের কথা যদি বলি একটু একটু করে, একটি গ্রন্থ সাজানো যাবে অনায়াসেই। কেউ জিজ্ঞেস করলেন বঙ্গবন্ধুর কথা, এতদিন পরেও।
মূল আয়োজনের কথা বলি। মূল শহর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে 'ইমপ্যাক্ট, মুয়াং থং থানি', কুড়িটি বড় বড় হল, বড় কনভেনশনগুলো যেখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সবকিছু তৈরি, কীভাবে শহরের বড় হোটেল থেকে ডেলিগেটরা আসবেন, কীভাবে কোথায় গিয়ে নামবেন, কোন হলে গিয়ে উঠবেন, কোথায় দুপুরের খাবার খাবেন, কোথায় রেস্ট নেবেন, কীভাবে ফিরবেন, সব আগে থেকে নির্ধারিত। সেখানে ইন্টারনেট আউটলেট এক হাজার, নানা দ্রব্যসামগ্রী, কেউ জুয়েলারি কিনতে চাইলে আর শহরে যেতে হবে না। ক্যামেরা, এমনকি কারও জুতা ছিঁড়ে গেলে নতুন জুতা কেনার সুবিধা। আমার জুতা ছেঁড়ার সুবর্ণ মুহূর্তটি উপস্থিত। গিনি্ন কিনে দিলেন সুন্দর একজোড়া জুতা, যেটি ইতালি থেকে গত সপ্তাহে এখানে জায়গা করে নিয়েছে, এখন আমার পায়ে। আম ও পেয়ারার সমঝদার ইচ্ছা করলে লবণ-চিনি-মরিচ মেশানো ফল খেয়ে দিব্যি ক্ষুধা নিবৃত্তে সমর্থ হবেন।
মূল অনুষ্ঠান যেখানে একসঙ্গে বসতে পারে বিশ হাজার লোক। মূল অধিবেশন দু'ভাগে, সকালে ও বিকেলে। সকালের অধিবেশনে এসেছেন রাজকুমারী, যতক্ষণ বক্তৃতা করেছেন সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিদিন প্লেনারি সেশনে চারজন বক্তা। তাদের বক্তৃতা শোনা জীবনের অভিজ্ঞতা বৈকি। সার্কাস দেখতে এসে অনেকেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা হাতি বা বানরের নাচ দেখেই আনন্দিত, হ্যাঁ পয়সা উসুল হয়েছে। তেমনি আটজনের বক্তৃতা শোনার পর আমার মনে হয়েছে আমার এখানে আসা সার্থক হয়েছে।
প্রথমেই বলি, প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ইউনূসের কথা। তার বক্তৃতার আগে, মাঝখানে ও শেষে শ্রোতৃমণ্ডলী তিনবার দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট ধরে তাকে ভালোবাসা জানান, আর কেউ এই সম্মানে ভূষিত হননি। তিনি বলেছেন গরিব মানুষের কথা, বলেছেন যারা বড়লোক তাদের জন্য ব্যাংক, তাদের কাছে গিয়ে পয়সা জমা দিতে হয়। তারা আরও টাকা নেন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। আর আমার ব্যাংক হলো গরিবদের জন্য, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা দিই, তাদের প্রায় সবাই মহিলা। এ এক নতুন দিক যা পৃথিবী আগে জানত না। এখন আমেরিকার শহরগুলোতে গরিবদের জন্য তৈরি হয়েছে এই নতুন ব্যাংক। এ ছাড়া জানালেন, গরিবদের জন্য শুধু দান নয় 'সোশ্যাল বিজনেস' অর্থাৎ যে ব্যবসায় গরিবদের স্থান থাকবে, ওই টাকা শেষ হয়ে যাবে না। রোটারিয়ানদের আহ্বান জানালেন 'সোশ্যাল বিজনেসে' নতুন পুঁজি খাটাতে। এতে দু'দিক সামলানো যাবে। একটি তাদের টাকা, তাদের টাকাই থাকবে। মুনাফা যাবে গরিবদের কাছে, গরিবরা কাজ পাবে, টাকা শেষ হয়ে যাবে না। প্রফেসর ইউনূসের একেকটি বাক্য শেষ হতে লাগছে এক মিনিট সময়, আর আরেক মিনিট করতালির জন্য। মনে পড়ল, সোভিয়েত ইউনিয়নের তাশখন্দ শহরে গেয়েছিলাম ভাওয়াইয়া গান ১৯৬৭ সালে, 'ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে', গানটি তিন মিনিটের, করতালি এক মিনিটের। ইউনূসের বক্তৃতার পর গ্রিনরুমে তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি জড়িয়ে ধরে বললেন : আব্বাসী, এ সাফল্য আমার নয়, সমস্ত বাংলাদেশের। আসমাসহ শত শত প্রাচ্যবাসীর চোখে সেদিন চোখের পানি। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।
কল্যাণ ব্যানার্জি তৃতীয় বাঙালি, যিনি রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি, স্মার্ট, বিনয়ী, সপ্রতিভ, কর্মচঞ্চল। সমস্ত অবয়ব কল্যাণের স্পর্শে অবধূত, স্ত্রী বিনতা, বিনম্র, সি্নগ্ধশ্রী ও কল্যাণময়ী। এমন একজন দম্পতিকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমরা আপ্লুত। তার বক্তৃতা প্রতিটি রোটারিয়ানকে করেছে স্পর্শিত। বললেন, বেশি লাগবে না, মাত্র একজন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, অনুভব করুন কী সে স্পর্শের মূল্য, বিধাতা কখন এসে আলোকিত করেন আপনার জীবন। জলবিহীন জীবন পৃথিবীর অর্ধেক লোককে করেছে তৃষিত, নিজের জন্য নির্ধারিত জলের সাশ্রয় করুন, সেই সাশ্রয়ের টাকা রোটারিকে পাঠান, আফ্রিকার জলবিহীন তৃষিত ধরায় তা আনবে খানিকটা তৃষ্ণার জল, তাই-বা মন্দ কি। তার প্রতিটি কথা এখনও যেন আমার মন্দ্রস্পর্শে নিনাদিত। সহজ কথা বলতে আমায় বল যে, সহজ কথা যায় যে বলা সহজে। প্রয়োজন : সহজ কথা উপলব্ধির মানুষের।
মূল বক্তাদের মধ্যে ভালো লেগেছে কনভেনশন সভাপতি সদাহাস্য ও.পি ভায়েস, ব্যাংকক সিমফনি অর্কেস্ট্রার পরিবেশনা, টাটা ইয়াংয়ের থাই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা, ব্যাংকক পিয়ানো ট্রায়োর পরিবেশনা, তিনজন বুলগেরীয় শিল্পী কিরিললিয়েফ, আলেকজান্ডার গসপদিনভ ও ইলিয়ান নেদাভের সঙ্গীত, অস্ট্রেলিয়ার গ্গ্নোবাল পোভার্টি প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা হিউ ইভান, ইউনাইটেড ন্যাশন্স ফাউন্ডেশনের গিলিয়ন সোরেনসন ও রাজশ্রী বিরলার বক্তৃতা।
অ্যাঞ্জেলিক কিডজোজো, যিনি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তা গায়িকা, সঙ্গীত রচয়িতা এবং ইউনিসেফের 'গুডউইল অ্যাম্বাসাডর' এত সুন্দর গাইলেন যে তার কণ্ঠ এখনও কানে বাজছে। তার সুর দেওয়া 'মালায়কি', গত বছর ডিসেম্বরে নোবেল শান্তি পুরস্কার অনুষ্ঠানে গীত হলে সবাই হন অভিভূত। আমি স্থির নিশ্চিত যে, অ্যাঞ্জেলিককে ঢাকায় আনা হলে বাংলাদেশের মানুষ তার গান শুনে হতো উদ্বুদ্ধ। পৃথিবীর অনেক লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিক গায়ক শিল্পী এখানে উপস্থিত, তাদের সবার স্টেজে ওঠার সুযোগ হয়নি, শোনাও এক বিরাট অভিজ্ঞতা, এ অভিজ্ঞতা অমূল্য।
পঞ্চাশটি সেশনে গুরুগম্ভীর আলোচনায় বিভক্ত হলেন কয়েক হাজার রোটারিয়ান চারদিন ধরে, কেউ পোলিও. কেউ জলকষ্ট, কেউ স্যানিটেশন, কেউ শিক্ষা, কেউ স্বাস্থ্য, কেউ গ্রামসেবা, কেউ তারুণ্যসেবা, কেউ মাতৃঋণ নিয়ে ব্যস্ত। আমি কী নিয়ে ব্যস্ত? পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাঙালিরা এসেছেন রবীন্দ্রতর্পণের জন্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে। জানালাম, এক বছর ধরে ওই কাজটি করেছি। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ সমবায়ে হতে চলেছে 'হারমোনি কমিটি', যাতে এলাকার যাতায়াত সমস্যা সমাধানকল্পে রোটারি নেতৃত্ব এগিয়ে এসে কিছু কাজ করে। কমিটিতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছি।
সাউথ এশিয়ার রোটারিয়ানরা বড় হোটেলে আয়োজন করেছেন টি পার্টি, কখনও নদীবিহারে নৃত্যগীত সংবলিত ভোজসভা। সেগুলোতে যাইনি। ব্যাংকক হাসপাতালে কাটিয়েছি দু'দিন, দু'জনেরই জীর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন থাইল্যান্ডের ডাক্তাররা। এর চেয়ে ভালো ডাক্তার দেশেই আছে। তফাত হলো : তারা মনোযোগী, সময় দিয়েছেন, রিপোর্ট দিয়েছেন এবং রোগ নির্ণয় পিনপয়েন্টেড। নতুন সভাপতি জাপানের সাকুজি তানাকা আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ঢাকা রোটারির পঁচাত্তরতম জন্মদিনে। তানাকা জানালেন, আগামী বছর কনভেনশন পর্তুগালের লিসবনে। আসবেন অতি অবশ্য। এ মিলনমেলা প্রতি বছরে মাত্র একবার। আসবেন তো?
মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
ব্যাংককে কুড়ি বছর পর। নতুন অনুভূতি। দু'দশকে এ শহর ও জাতি এগিয়ে গেল সামনের দিকে, দেখে বিস্মিত। বিশাল ব্যাংকক, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেতে সময় কুড়ি মিনিট, স্কাই ট্রেইন, ফ্লাইওভার, চকচকে বাস-ট্যাক্সি-টুকটুক চলে মুহূর্তের ইশারায়, প্রতি মানুষ কাজ করছে সকাল থেকে সন্ধ্যা অক্লেশে, বসে নেই কেউ।
পাঁচশ' বঙ্গসন্তান এসেছি রোটারির ১০৩তম কনভেশনে যোগ দিতে, পঁচিশ হাজার রোটারিয়ান পৃথিবীর সব দেশ থেকে। এ এক অনন্য অনুভূতি। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এসেছে নানা রঙের নানা ভাষার মানুষ। সবাই সবার গলা জড়িয়ে ধরছেন, কেউ পুরনো বন্ধু, কেউ নতুন বন্ধুত্বে আবদ্ধ। শত খাবারের ঘর, খাবার খেতে গিয়ে বন্ধুত্ব, 'হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপে' গান-নৃত্য জুড়ে দিয়েছেন গানপাগল বন্ধুরা, সঙ্গে শত স্টল যেখানে মেলে ধরেছি কে কোথায় সমাজের জন্য কী কাজ করেছি। প্রজেক্টে আনন্দ পান যারা, বক্তৃতার আসরে নেই উপস্থিত। সারাদিন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেসব সফল প্রজেক্টের উদ্যোক্তাদের যারা স্টল খুলে বসেছেন, আলাপ করছেন কীভাবে এটি তাদের দেশে উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব। অর্থের অভাব নেই, যে যত প্রজেক্ট করতে চান সম্ভব, অর্ধেক অর্থ জোগাবে রোটারি ফাউন্ডেশন। ঢাকা রোটারি ক্লাব আগামী বছর পঁচাত্তরতম জন্মদিন [আমিও হবো ৭৫] পালন করবে, বাংলাদেশেও রোটারি আগমনের ৭৫তম বছর। ঢাকা ক্লাব থেকে এক ডজন রোটারিয়ান ব্যস্ত 'হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপে'। তেরোজন রোটারি গভর্নর : ইফতেখারুল আলম, হাবিবুল্লাহ খান, এমএ মাহবুব, প্রফেসর হাফিজুল্লাহ, ড. মোশাররফ হোসেন, এমএ আউয়াল, জামাল উদ্দিন, মীর আনিসুজ্জামান, ড. মনজুরুল হক চৌধুরী, ড. ইশতিয়াক আবিদ-উজ-জামান, গোলাম মোস্তফা, সাফিনা রহমান, কমডোর রহমান ও আমাদের দু'জনকে দেখে বাংলাদেশের ১৬০টি ক্লাবের ও পশ্চিমবঙ্গের রোটারিয়ানরা মহাখুশি। আসমা ও আমি কনভেনশনে আসিনি কোনোদিন, অর্থের প্রয়োজন। পারিবারিক বন্ধু কল্যাণ ব্যানার্জি রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট। তার স্ত্রী বিনতা ব্যানার্জি বললেন, আসমা, তোমাকে এবার আসতেই হবে, তা না হলে আর কথা বলব না। সেই সুবাদেই প্রথমবারের মতো কনভেনশনে দিয়েছি উপস্থিতি। বক্তৃতা মঞ্চে উঠে দাঁড়াইনি, গাইনি কোনো গান, কোনো কবিতা, একমাত্র হজ ও ইরানে অনুষ্ঠিত রুমি কনফারেন্স ছাড়া এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোনো কনভেনশনে বা জনসমাবেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারিনি।
যেদিকে তাকাই, বন্ধু আর বন্ধু, এত বন্ধুও ভাগ্যে ছিল, কে জানত। বাংলাদেশের মানুষ শুনে অন্যান্য দেশের রোটারিয়ানরা গলা জড়িয়ে ধরেছেন, বলেছেন, শুনেছি তোমাদের দেশ সবচেয়ে সুন্দর, শ্যামল, যেখানে বাস করে পৃথিবীর নামকরা ব্যাঘ্র, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বাস করে ষোল কোটি শুভ্রহৃদয় মানুষ, অল্পে যারা তুষ্ট, সব ধর্মের মানুষকে যারা আহ্বান জানায়। যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে চারদিনে ৬-৯ মে, তাদের কথা যদি বলি একটু একটু করে, একটি গ্রন্থ সাজানো যাবে অনায়াসেই। কেউ জিজ্ঞেস করলেন বঙ্গবন্ধুর কথা, এতদিন পরেও।
মূল আয়োজনের কথা বলি। মূল শহর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে 'ইমপ্যাক্ট, মুয়াং থং থানি', কুড়িটি বড় বড় হল, বড় কনভেনশনগুলো যেখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সবকিছু তৈরি, কীভাবে শহরের বড় হোটেল থেকে ডেলিগেটরা আসবেন, কীভাবে কোথায় গিয়ে নামবেন, কোন হলে গিয়ে উঠবেন, কোথায় দুপুরের খাবার খাবেন, কোথায় রেস্ট নেবেন, কীভাবে ফিরবেন, সব আগে থেকে নির্ধারিত। সেখানে ইন্টারনেট আউটলেট এক হাজার, নানা দ্রব্যসামগ্রী, কেউ জুয়েলারি কিনতে চাইলে আর শহরে যেতে হবে না। ক্যামেরা, এমনকি কারও জুতা ছিঁড়ে গেলে নতুন জুতা কেনার সুবিধা। আমার জুতা ছেঁড়ার সুবর্ণ মুহূর্তটি উপস্থিত। গিনি্ন কিনে দিলেন সুন্দর একজোড়া জুতা, যেটি ইতালি থেকে গত সপ্তাহে এখানে জায়গা করে নিয়েছে, এখন আমার পায়ে। আম ও পেয়ারার সমঝদার ইচ্ছা করলে লবণ-চিনি-মরিচ মেশানো ফল খেয়ে দিব্যি ক্ষুধা নিবৃত্তে সমর্থ হবেন।
মূল অনুষ্ঠান যেখানে একসঙ্গে বসতে পারে বিশ হাজার লোক। মূল অধিবেশন দু'ভাগে, সকালে ও বিকেলে। সকালের অধিবেশনে এসেছেন রাজকুমারী, যতক্ষণ বক্তৃতা করেছেন সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিদিন প্লেনারি সেশনে চারজন বক্তা। তাদের বক্তৃতা শোনা জীবনের অভিজ্ঞতা বৈকি। সার্কাস দেখতে এসে অনেকেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা হাতি বা বানরের নাচ দেখেই আনন্দিত, হ্যাঁ পয়সা উসুল হয়েছে। তেমনি আটজনের বক্তৃতা শোনার পর আমার মনে হয়েছে আমার এখানে আসা সার্থক হয়েছে।
প্রথমেই বলি, প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ইউনূসের কথা। তার বক্তৃতার আগে, মাঝখানে ও শেষে শ্রোতৃমণ্ডলী তিনবার দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট ধরে তাকে ভালোবাসা জানান, আর কেউ এই সম্মানে ভূষিত হননি। তিনি বলেছেন গরিব মানুষের কথা, বলেছেন যারা বড়লোক তাদের জন্য ব্যাংক, তাদের কাছে গিয়ে পয়সা জমা দিতে হয়। তারা আরও টাকা নেন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। আর আমার ব্যাংক হলো গরিবদের জন্য, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা দিই, তাদের প্রায় সবাই মহিলা। এ এক নতুন দিক যা পৃথিবী আগে জানত না। এখন আমেরিকার শহরগুলোতে গরিবদের জন্য তৈরি হয়েছে এই নতুন ব্যাংক। এ ছাড়া জানালেন, গরিবদের জন্য শুধু দান নয় 'সোশ্যাল বিজনেস' অর্থাৎ যে ব্যবসায় গরিবদের স্থান থাকবে, ওই টাকা শেষ হয়ে যাবে না। রোটারিয়ানদের আহ্বান জানালেন 'সোশ্যাল বিজনেসে' নতুন পুঁজি খাটাতে। এতে দু'দিক সামলানো যাবে। একটি তাদের টাকা, তাদের টাকাই থাকবে। মুনাফা যাবে গরিবদের কাছে, গরিবরা কাজ পাবে, টাকা শেষ হয়ে যাবে না। প্রফেসর ইউনূসের একেকটি বাক্য শেষ হতে লাগছে এক মিনিট সময়, আর আরেক মিনিট করতালির জন্য। মনে পড়ল, সোভিয়েত ইউনিয়নের তাশখন্দ শহরে গেয়েছিলাম ভাওয়াইয়া গান ১৯৬৭ সালে, 'ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে', গানটি তিন মিনিটের, করতালি এক মিনিটের। ইউনূসের বক্তৃতার পর গ্রিনরুমে তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি জড়িয়ে ধরে বললেন : আব্বাসী, এ সাফল্য আমার নয়, সমস্ত বাংলাদেশের। আসমাসহ শত শত প্রাচ্যবাসীর চোখে সেদিন চোখের পানি। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।
কল্যাণ ব্যানার্জি তৃতীয় বাঙালি, যিনি রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি, স্মার্ট, বিনয়ী, সপ্রতিভ, কর্মচঞ্চল। সমস্ত অবয়ব কল্যাণের স্পর্শে অবধূত, স্ত্রী বিনতা, বিনম্র, সি্নগ্ধশ্রী ও কল্যাণময়ী। এমন একজন দম্পতিকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমরা আপ্লুত। তার বক্তৃতা প্রতিটি রোটারিয়ানকে করেছে স্পর্শিত। বললেন, বেশি লাগবে না, মাত্র একজন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, অনুভব করুন কী সে স্পর্শের মূল্য, বিধাতা কখন এসে আলোকিত করেন আপনার জীবন। জলবিহীন জীবন পৃথিবীর অর্ধেক লোককে করেছে তৃষিত, নিজের জন্য নির্ধারিত জলের সাশ্রয় করুন, সেই সাশ্রয়ের টাকা রোটারিকে পাঠান, আফ্রিকার জলবিহীন তৃষিত ধরায় তা আনবে খানিকটা তৃষ্ণার জল, তাই-বা মন্দ কি। তার প্রতিটি কথা এখনও যেন আমার মন্দ্রস্পর্শে নিনাদিত। সহজ কথা বলতে আমায় বল যে, সহজ কথা যায় যে বলা সহজে। প্রয়োজন : সহজ কথা উপলব্ধির মানুষের।
মূল বক্তাদের মধ্যে ভালো লেগেছে কনভেনশন সভাপতি সদাহাস্য ও.পি ভায়েস, ব্যাংকক সিমফনি অর্কেস্ট্রার পরিবেশনা, টাটা ইয়াংয়ের থাই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা, ব্যাংকক পিয়ানো ট্রায়োর পরিবেশনা, তিনজন বুলগেরীয় শিল্পী কিরিললিয়েফ, আলেকজান্ডার গসপদিনভ ও ইলিয়ান নেদাভের সঙ্গীত, অস্ট্রেলিয়ার গ্গ্নোবাল পোভার্টি প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা হিউ ইভান, ইউনাইটেড ন্যাশন্স ফাউন্ডেশনের গিলিয়ন সোরেনসন ও রাজশ্রী বিরলার বক্তৃতা।
অ্যাঞ্জেলিক কিডজোজো, যিনি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তা গায়িকা, সঙ্গীত রচয়িতা এবং ইউনিসেফের 'গুডউইল অ্যাম্বাসাডর' এত সুন্দর গাইলেন যে তার কণ্ঠ এখনও কানে বাজছে। তার সুর দেওয়া 'মালায়কি', গত বছর ডিসেম্বরে নোবেল শান্তি পুরস্কার অনুষ্ঠানে গীত হলে সবাই হন অভিভূত। আমি স্থির নিশ্চিত যে, অ্যাঞ্জেলিককে ঢাকায় আনা হলে বাংলাদেশের মানুষ তার গান শুনে হতো উদ্বুদ্ধ। পৃথিবীর অনেক লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিক গায়ক শিল্পী এখানে উপস্থিত, তাদের সবার স্টেজে ওঠার সুযোগ হয়নি, শোনাও এক বিরাট অভিজ্ঞতা, এ অভিজ্ঞতা অমূল্য।
পঞ্চাশটি সেশনে গুরুগম্ভীর আলোচনায় বিভক্ত হলেন কয়েক হাজার রোটারিয়ান চারদিন ধরে, কেউ পোলিও. কেউ জলকষ্ট, কেউ স্যানিটেশন, কেউ শিক্ষা, কেউ স্বাস্থ্য, কেউ গ্রামসেবা, কেউ তারুণ্যসেবা, কেউ মাতৃঋণ নিয়ে ব্যস্ত। আমি কী নিয়ে ব্যস্ত? পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাঙালিরা এসেছেন রবীন্দ্রতর্পণের জন্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে। জানালাম, এক বছর ধরে ওই কাজটি করেছি। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ সমবায়ে হতে চলেছে 'হারমোনি কমিটি', যাতে এলাকার যাতায়াত সমস্যা সমাধানকল্পে রোটারি নেতৃত্ব এগিয়ে এসে কিছু কাজ করে। কমিটিতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছি।
সাউথ এশিয়ার রোটারিয়ানরা বড় হোটেলে আয়োজন করেছেন টি পার্টি, কখনও নদীবিহারে নৃত্যগীত সংবলিত ভোজসভা। সেগুলোতে যাইনি। ব্যাংকক হাসপাতালে কাটিয়েছি দু'দিন, দু'জনেরই জীর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন থাইল্যান্ডের ডাক্তাররা। এর চেয়ে ভালো ডাক্তার দেশেই আছে। তফাত হলো : তারা মনোযোগী, সময় দিয়েছেন, রিপোর্ট দিয়েছেন এবং রোগ নির্ণয় পিনপয়েন্টেড। নতুন সভাপতি জাপানের সাকুজি তানাকা আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ঢাকা রোটারির পঁচাত্তরতম জন্মদিনে। তানাকা জানালেন, আগামী বছর কনভেনশন পর্তুগালের লিসবনে। আসবেন অতি অবশ্য। এ মিলনমেলা প্রতি বছরে মাত্র একবার। আসবেন তো?
মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
No comments