গাড়ি পোড়ানোর মামলা-অভিযোগপত্র গ্রহণ ২২ দিনেই

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন আদালত। মামলার ১১ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দাখিল এবং ২২ দিনের মাথায় অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হলো।


দ্রুত বিচার আইনে দেওয়া এই অভিযোগপত্রের ৪৫ আসামির মধ্যে ৪২ জনই বিরোধী দলের নেতা, তাঁদের কয়েকজন জাতীয় সংসদ সদস্য। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন ওই বাসের কর্মী (কন্ডাক্টর ও হেলপার), আরেকজন ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া এক ব্যক্তি।
জানতে চাইলে প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আসামি করা এবং তাঁদের জামিন না হওয়ার ঘটনার সমালোচনা করেন। গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির নেতারা গাড়ি পুড়িয়েছেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আসামিদের জামিন দেওয়া হবে না কেন? ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও দেখেছি, জামিনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। বর্তমানেও করা হচ্ছে। একজন সাংসদ জামিনে ছিলেন, তাঁর জামিনের আবেদন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হলো। এখন বিএনপি বলছে, আদালতে গিয়ে ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, বিএনপির আমলে করা আইনেই অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। সব আমলেই এটা হয়ে আসছে।’
ঢাকার মহানগর হাকিম মোহাম্মদ এরফান উল্লাহর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে এই মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম বুলবুল ও ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও মালামাল ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়। আগামী ৬ জুন পরোয়ানা তামিলসংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ ছাড়া আরেক আসামি ছাত্রদলের ওবায়দুল হক নাছিরকে গতকাল গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এই মামলায় জামিনে থাকা আসামি সাংসদ ও আইনজীবী মাহবুবউদ্দিন খোকন গতকাল আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন বর্ধিত করার আবেদন করেন। আদালত তা নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে। এটি আইনসম্মত নয়।
গতকাল দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মওদুদ আহমদ এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মাহবুবউদ্দিন খোকনকে উচ্চ আদালত জামিন দিয়েছেন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের আদেশে চার্জশিট গ্রহণ করার পর জামিন দেওয়া যাবে না—এ বিষয়টি ছিল না। আর সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিলে তা বাতিল করা যায় না। কিন্তু খোকনকে জামিন দেওয়া হয়নি। তিনি ৯ মে আত্মসমর্পণ করেছেন, তারপর জামিন দিয়েছেন আদালত। নিয়ম হচ্ছে, জামিনের অপব্যবহার করলে জামিন বাতিল হয়। কিন্তু খোকন জামিনের কোনো অপব্যবহার করেননি। তার পরও তাঁকে জামিন দেওয়া হয়নি। এতে জনমনে আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’
আদালতে শুনানি: মহানগর হাকিম আদালতে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় অভিযোগপত্রের গ্রহণযোগ্যতার শুনানি শুরু হয়। অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে গতকাল মির্জা ফখরুলের পক্ষে এককভাবে একটি আবেদন করা হয়। বাকি আসামিদের পক্ষে একই বিষয়ে পৃথক আবেদন করা হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মওদুদ আহমদ আদালতকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার আইন) সংশোধনী, ২০০২-এর ১০ ও ১২ ধারার ৩ উপধারার বিধানমতে অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, অভিযোগ আনা হয়েছে—আসামিরা ভয়ভীতি দেখিয়ে, বল প্রয়োগ ও ইচ্ছা করে যানবাহনের ক্ষতিসাধন করে দ্রুত বিচার আইনের ৪ ও ৫ ধারার অপরাধ করেছেন। এ ধরনের অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
মওদুদ আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ মামলা করেনি। পুলিশ অত্যুৎসাহী হয়ে বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে এই মামলা করেছে। তাই দ্রুত বিচার আইনের বিধান অনুযায়ী মামলা আমলে নিয়ে বিচার করার এখতিয়ার নেই। তিনি আদালতকে বলেন, আইনটি সমাজে শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য করা হলেও সরকার বিরোধী দলকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
মাহবুবউদ্দিন খোকনের জামিন বিষয়ে তাঁর আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, জামিন দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের। মাহবুবউদ্দিন একজন আইনজীবী ও সংসদ সদস্য। তিনি হাইকোর্টের নির্দেশে ৯ মে হাকিম আদালতে জামিননামা দাখিল করেন। তিনি জামিনের অপব্যবহার করেননি। আজ (সোমবার) পর্যন্ত জামিনে আছেন। তাই জামিন পেতে পারেন।
মওদুদ আহমদকে শুনানিতে সহায়তা করেন আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, গোলাম মোস্তফা খান, ইকবাল হোসেন প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু আদালতকে বলেন, পুলিশ অত্যুৎসাহী হয়ে এই মামলা করেছে—এটা ঠিক নয়। আইনের বিধান হচ্ছে, যেকোনো ব্যক্তি এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) করতে পারেন। আইন মেনেই পুলিশ মামলা করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির চালককে সাক্ষী করা হয়েছে। অভিযোগপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই।
মাহবুবউদ্দিনের জামিনের বিরোধিতা করে পিপি বলেন, ৯ মে মাহবুবউদ্দিন আদালতে জামিননামা দাখিল করেন। কিন্তু এই মামলার এক আসামির পক্ষে মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন শুনানির অপেক্ষায় থাকায় আদালত আজ পর্যন্ত জামিনে রাখেন। যেহেতু মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, তাই জামিন পাওয়ার সুযোগ নেই।
দুই পক্ষের শুনানি শেষে আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন এবং খোকনের জামিনের আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আইনে সাজা: ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী নজিবুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত বিচার আইনের ১০(২) ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করার পর থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আসামি পলাতক থাকলে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। এ আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আদালত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে অর্থদাণ্ডাদেশ দিতে পারেন।
জানতে চাইলে মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, আইনগত প্রক্রিয়া শেষে আগামী মাসেই এই মামলার বিচারকাজ শুরু হতে পারে।
পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য: আসামিপক্ষের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে আসামিদের আত্মপক্ষের সুযোগ দিতে হবে। আইনে এই সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আদালত আসামিপক্ষকে সেই সুযোগ দেননি। তা ছাড়া, অভিযোগপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে আসামিকে হাজির করতে হবে। সরকারের চাপে আসামিদের হাজির না করে আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন। এটা অন্যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী এ এফ এম রেজাউল করিম বলেন, অভিযোগপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে আসামিদের উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। আইনে এমন কোনো বিধানও নেই। অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির সময় আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে।
মাসুদ আহমেদ তালুকদার অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকার দ্রুত বিচার আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে মামলা দিয়ে কারাগারে ভরে দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এ এফ এম রেজাউল করিম বলেন, ২০০২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন দ্রুত বিচার আইন করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার তা বর্ধিত করেছে মাত্র। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য।
বিএনপির গুম হওয়া নেতা ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফেরত দেওয়ার দাবিতে গত ২৯ ও ৩০ এপ্রিল হরতাল ডাকা হয়। ২৯ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অদূরে ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করে। এর ১১ দিনের মাথায় ১০ মে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
প্রতিবাদ ও কর্মসূচি: গতকাল অভিযোগপত্রের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে এবং মাহবুবউদ্দিনের জামিনের শুনানিকালে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তাঁরা বলেন, মামলা দিয়ে বিরোধী দলকে দমানো যাবে না। আদালতের আদেশের পরপরই জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মিয়া ও আইনজীবী নেতা সানাউল্লাহ মিয়া আজ (মঙ্গলবার) ঢাকায় আদালত বর্জনের ঘোষণাসহ সারা দেশে আইনজীবীদের কালো ব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেন। পরে এই কর্মসূচি বাতিল করে আজ কালো ব্যাজ ধারণ ও বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ: মির্জা ফখরুল ছাড়া বাকি আসামিরা হলেন: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, আ স ম হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সহসভাপতি সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক, স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম, উত্তর যুবদলের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, দক্ষিণ যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান, সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী, ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের (দক্ষিণ) সভাপতি ইয়াসিন আলী, ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার, ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের (দক্ষিণ) আহ্বায়ক হাবিবুর রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল মতিন, ছাত্রদল উত্তরের সাধারণ সম্পাদক কামাল আনোয়ার আহমেদ, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মো. আনোয়ারুজ্জামান, সাবেক কমিশনার ইউনুস মৃধা, বিএনপির নেতা লুৎফুর রহমান, নবী সোলায়মান, কামরুজ্জামান রতন, মান্নান হোসেন শাহীন, ইসমাইল খান শাহীন, বাসের কর্মী সোহেল ওরফে সোহান মিয়া ও জসিমউদ্দিন এবং ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা যুবক মানিক রতন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নেতারা হলেন: বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি আন্দালিব রহমান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সভাপতি শেখ শওকত হোসেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ও এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ।

No comments

Powered by Blogger.