বিশৃঙ্খলা-রাজনীতিতে বহমান সুনামি by মোহীত উল আলম

মাস দুয়েক আগের তুলনায় রাজনীতি এখন আগের চেয়ে সংঘাতমুখর হলেও অধিকতর পরিষ্কার হয়েছে। বিরোধী দল কী চায়, সরকারি দলও বা কী চায়, তা পরিষ্কার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ১৭ মে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস স্মরণে ছাত্রলীগের দেওয়া তাঁকে প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন,


বিরোধী দল যদি বর্তমান ধারার উচ্ছৃঙ্খল রাজনীতি চালিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাদের সঠিক পথে কীভাবে আনতে হয়, তা সরকারি দলের জানা আছে। সোজা বাংলায় বললে, যেমন কুকুর তেমনি মুগুরের ব্যবস্থা করার কথা সরকারি দলের জানা আছে। পত্রিকায় আরও এসেছে, বাইরের বা ভেতরের যত চাপই সরকারের ওপর থাকুক না কেন, সরকার বিরোধী দলের বর্তমান ধারার রাজনীতি—হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি কঠোর হস্তে দমন করবে। প্রধানমন্ত্রী ওই একই ভাষণে সরকারের সহনশীলতাকে সরকারের দুর্বলতা না ভাবার কথাও জানিয়েছেন বিরোধী দলকে। বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ২৯ জন (পরের দিন খায়রুল কবির খোকনের গ্রেপ্তারের ঘটনাসহ ৩০ জন) এবং শরিক দলের চারজন নেতাসহ এখন ৩৪ জন নেতা কারাবন্দী হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা ছিল তেজগাঁও থানায় এবং দ্রুত বিচার আদালতে যে তাঁরা হরতালের সময় গাড়িতে অগ্নিসংযোগে ইন্ধন দেওয়াসহ পুলিশকে দায়িত্ব পালনে বাধা দিয়েছিলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে তাঁরা কারান্তরীণ হন এবং সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখানে সরকারের কোনো হাত নেই, পুলিশি মামলার ওপর রায় দিয়েছেন বিচারক এবং সে মামলা যেহেতু জামিনযোগ্য ছিল না, সে জন্য তাঁরা কারাগারে প্রেরিত হয়েছেন, যেহেতু আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন (মাহবুব উল আলম হানিফ)।
তাহলে সরকারি দলের রাজনীতি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ছবি পাওয়া গেল যে তারা বিরোধী দলের কর্মসূচি বিশৃঙ্খলা পরিপূর্ণ ও নাগরিক জীবনের জন্য নিরাপত্তার হুমকি হয়ে উঠলে শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স দেখাবে। বিরোধী দলের রাজনীতিও পরিষ্কার। তারা কোনো নিয়মতান্ত্রিকতার দিকে যাবে না। সংসদ বর্জন করবে, কিন্তু বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করবে। সবকিছুর জন্য সরকারকে দায়ী করবে এবং মুহুর্মুহু হরতাল দিয়ে সরকারকে কোণঠাসা করে একপর্যায়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে কিংবা সরকার পদত্যাগ না করলে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করবে। এদিক থেকে বিরোধী দলের অবস্থানও পরিষ্কার।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুটি বিবদমান দলই আগের চেয়ে স্বচ্ছতর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং বোঝা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে শুধু সামনাসামনি যুদ্ধটা বাকি। এ ক্ষেত্রে অন্য সবার দায়িত্ব হচ্ছে এ দুটি দল বা জোটকে এ রকম সাংঘর্ষিক অবস্থানে উপনীত হওয়া থেকে বিরত রাখা। কীভাবে? সেটা হচ্ছে যুক্তির সাহায্যে। যদিও যেকোনো প্রবল আবেগের প্রথম শিকার হচ্ছে যুক্তি।
বিবদমান ইস্যুগুলো টেবিলে আনা যাক।
প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদ থাকার ফলে আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটি তুলে দিয়েছে। এর আগে উচ্চ-আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটি বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে রায় দিয়েছিল। বলেছিল, এটা রহিত হওয়া দরকার, যদিও আগামী দুটি নির্বাচন এর অধীনে হতে পারে। আওয়ামী লীগ রায়টির প্রথম অংশকে ভিত্তি করে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নেয় এবং পরের অংশ সম্পর্কে থাকে নিশ্চুপ। কিন্তু সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিশ্চিহ্নকরণ আইনটি আলোচনায় উঠলে বিরোধী দল সংসদ বর্জন অব্যাহত রাখার কারণে তাদের কোনো ভিন্নমত পরিবেশনের সুযোগ তারা নিল না। এ বিষয়ে আমার আগের লেখা কয়েকটি কলামে আমি ব্যক্তিগত মত দিয়েছি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এতে দেশকে অসাংবিধানিক পথে নিয়ে যাওয়ার একটি দরজা সব সময় খোলা থাকে। কিন্তু সংসদে কথা বলার সুযোগ নেই—এ অজুহাতে বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে চলে বলে জাতি তাদের কাছ থেকে প্রার্থিত ভূমিকা পায় না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের আন্দোলনের নামে বিরোধী দল বিক্ষোভ, হরতাল, অবেরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, গাড়ি ভাঙচুরসহ সম্পদ বিনষ্টের বহু কর্মসূচি একের পর এক দিয়ে যাচ্ছে। ফলত এটা পরিষ্কার যে সরকারি দল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত রেখেই নির্বাচনে যায়, বিরোধী দল সেখানে অংশগ্রহণ করবে না। ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তাহলে এ কথাটি সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির বিল যেদিন এল সেদিনই বিরোধী দল বলে ফেলতে পারত। এত হরতাল দেওয়ার তখন দরকার হতো না। ফলে এ কথা মনে করার কারণ আছে যে বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসুক বা না আসুক, তার চেয়ে তৎপর এ ব্যাপারে যে সরকারি দল মেয়াদ শেষ করার আগেই যেন পদত্যাগ করে। কিন্তু সরকারি দলও একটি নির্বাচিত দল, তাদের জনসমর্থন হয়তো আগের চেয়ে কমেছে, কিন্তু এখনো যা আছে তা বিপুল। এটাও খুব উপেক্ষা করার বিষয় হতে পারে না যে একটি আন্তর্জাতিক জরিপের ফলাফলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর ৭৭ শতাংশ আস্থা ভোট পড়েছে এবং জনপ্রিয়তার আঙ্গিকে বিশ্বে সরকারপ্রধানদের মধ্যে তাঁর স্থান হচ্ছে সপ্তম। সেখানে বিরোধী দল এটা কেন বুঝতে চায় না যে রাস্তার আন্দোলনের ফলে জনগণের, বিশেষ করে দরিদ্র জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে, কিন্তু যে ইস্যুটির বিরুদ্ধে বিরোধী দল আন্দোলন করছে সেটির কিছু হয় না।
কিন্তু বিরোধী দল সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা সরকারি দলের একটি প্রতীতিকে প্রায় নিঃসন্দেহে প্রমাণ করছে। সেটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যত কেন্দ্রীভূত, যতই সুনির্দিষ্ট হচ্ছে, ততই যেন বিরোধী দলের রাজনীতির মধ্যে অনিয়মতান্ত্রিকতা বেড়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধী দলের সমর্থকেরা কিছু কর্মসূচি নিয়েছে—যেমন হঠাৎ করে অতর্কিতে পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ করা, যার ফলে বোঝা যায় তাদের এজেন্ডা হলো যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল করা। প্রধান বিরোধী দল, সজ্ঞানে কিংবা অসতর্কভাবে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায় না সে রকম দক্ষিণপন্থী দলগুলোর ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই মানুষের ইতিহাসসচেতনতা বাড়ছে, বাড়ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা। পূর্বে, বিশেষ করে আশির দশকে, পাকিস্তান বা যেকোনো ধর্মভিত্তিক দেশকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হতো এবং সে আলোকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে পরিচালিত করার অভিলাষ সক্রিয় ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের উত্তরোত্তর অবনয়নে এবং বাংলাদেশে একুশ শতকের শুরুতে ধর্মীয় চেতনার নামে জঙ্গিবাদের উগ্র বিকাশের ফলে এবং বর্তমানের বিরোধী দল সে রকম একটি বিকাশকে সে সময় প্রশ্রয় দেওয়াতে মানুষের মোহমুক্তি হয়। সে জন্য যু্দ্ধাপরাধীর বিচার এখন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে। এটা সরকারি দল করছে বলে হচ্ছে তা নয়, মানুষ চাইছে বলে হচ্ছে। তবে সরকারি দলের শক্ত হাতের পরিচালনা যু্দ্ধাপরাধীর বিচার সম্ভব করে তুলছে।
সাংসদ ইলিয়াস আলী গাড়িচালকসহ গুম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া প্রকাশে বিরোধী দলের রাজনৈতিক দৈন্য স্পষ্ট হয়েছে। আমরা যদি ধরেও নিই যে এটি সরকারের কোনো সংস্থা করেছে, কিন্তু বিরোধী দল আইনের পথে না গিয়ে যেভাবে অকাতরে হরতালসহ নানা বিধ্বংসী কর্মসূচিতে গেল তাতে একটি প্রশ্ন তাদের মনে কেন এল না যে যদি ইলিয়াস আলীকে পাওয়া না যায়, তাহলে হরতালগুলো কি সরকারকে চাপে ফেলছে নাকি সাধারণভাবে জনজীবনের দুর্ভোগ (মোট পাঁচজনের মৃত্যুসহ) বাড়িয়ে দিয়েছে? দুর্যোগপীড়িত জনগণ তখন কেন বিরোধী দলের দিকে ঝুঁকবে? আর ইলিয়াস আলী যে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোনো ঝগড়া থেকে নিরুদ্দিষ্ট হননি, সে ব্যাপারেও বিরোধী দল এত নিশ্চিন্ত হলো কী করে? বা এ চিন্তাটা তাদের ধারণায় স্থান পেল না কেন? যারা বিরোধী দলের সমর্থক নয়, তারা কিন্তু এ প্রশ্নটা বারবার ওজন করে দেখেছে যে শুধু সরকারপক্ষ থেকে নয়, আরও নানা সূত্র থেকে ইলিয়াস আলীর শত্রুপক্ষ সৃষ্টি হতে পারে।
বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধিতা এখন চরমে উঠেছে। তার পরও দেখা যাচ্ছে, যুক্তির পাল্লা সরকারি দলের দিকে ভারী। তবে সরকারি দল দুটো ইস্যুতে এখনো তাদের অবস্থান জাতির কাছে পরিষ্কার করতে পারেনি। একটি হচ্ছে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ইস্যু, আরেকটি হচ্ছে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের তৎকালীন এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকার খোঁজ পাওয়া। সুরঞ্জিত দায়দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন, এখন আছেন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে। রেলওয়ের একটি তদন্ত কমিটি রায় দিয়েছে যে এ টাকার ঘাপলার ব্যাপারে সুরঞ্জিত জড়িত ছিলেন না। তাই তিনি রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং পুনরায় রেলমন্ত্রী হওয়ার যাচনা করেছেন। তিনি যদি নির্দোষও হন, কিন্তু একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করলে পুরো ঘটনাটার প্রেক্ষাপট জাতির কাছে ধোঁয়াটে হয়ে থাকবে। ঠিক সে রকম বিশ্বব্যাংক প্রমাণ সহকারে বলেছে, পদ্মা সেতুর ঠিকাদার নিয়োগের বেলায় দুর্নীতি হয়েছিল এবং দুর্নীতির উৎস কোথায় ছিল সেটিও তারা উল্লেখ করেছে, কিন্তু সরকারের এ ব্যাপারে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো কেবল চোখে ছাই উড়িয়ে দেওয়ার মতো হয়েছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। পদ্মা সেতু সমগ্র জাতির আরাধ্য একটি স্বপ্ন, ঠিক যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে যাওয়াও একটি স্বপ্ন। অথচ সে স্বপ্নের প্রাধান্যকে কোন যুক্তিতে পেছনে ফেলে সরকারি দল বিটিং অ্যাবাউট দ্য বুশ করছে, সেটা বোঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অথবা, একটা বিরাট অথবা, যদি আমাদের নিজেদের টাকা দিয়ে আমরা পদ্মা সেতুটি করে ফেলতে পারি, মন্দ কী? চেষ্টা করা যাক।
ড. মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.