সময়ের প্রেক্ষিত-জাপানে দারিদ্র্যের ফিরে আসা by মনজুরুল হক
দারিদ্র্য জাপানে অপরিচিত কোনো সংজ্ঞা নয়। মাত্র ছয় দশক আগেও যুদ্ধোত্তর জাপানে দারিদ্র্য ছিল হরহামেশাই বিরাজমান। সেই সময়ের জাপানি ছায়াছবির সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা নিশ্চয় মনে করতে পারবেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে অপরাধ চক্রের সদস্যদের কালোবাজারি এবং অন্যান্য অসামাজিক তৎপরতায় জড়িত হওয়ার বস্তুনিষ্ঠ ছবি।
তবে সেই জাপান অনেক আগেই আমাদের স্মৃতি থেকে অপসারিত। জাপান বলতে চোখের সামনে এখন ভেসে ওঠে নিয়ন বাতির জমকালো আলোর নিচে পণ্যের পসার মেলে ধরা চাকচিক্যময় সব দোকানপাট কিংবা আকাশছোঁয়া মূল্যের ডিজাইনসামগ্রী ব্যবহারকারী নারী-পুরুষের ভিড়ে পরিপূর্ণ রাজধানী টোকিওর ব্যস্ত বিভিন্ন এলাকা। তবে ইদানীং এই জাপানও ক্রমশই পিছু হাঁটতে শুরু করেছে, যদিও যুদ্ধ-পরবর্তী ক্ষুধা আর দারিদ্র্যে ভরা ছায়াছবিতে দেখা অতীতের সেই জাপানের আবারও ফিরে আসার আশঙ্কা বলা যায় সুদূরপরাহত।
তার পরও বলতে হয়, ভিন্ন এক চেহারা নিয়ে দারিদ্র্য জাপানে এখন আবারও ফিরে আসছে। এই ফিরে আসা হঠাৎ করে দেখা দেওয়ার প্রবণতা না হলেও অনেক দিন ধরেই জাপানের নীতিনির্ধারকেরা চেষ্টা করে গেছেন দারিদ্র্যের ফিরে আসার সেই খবরকে যতটা সম্ভব চেপে রাখতে। তবে নাগরিকজীবনে এর প্রভাব ক্রমশই ব্যাপক হয়ে ওঠায় জাপানের পক্ষে এখন আর সম্ভব হচ্ছে না সত্যকে অস্বীকার করে যাওয়া। গত গ্রীষ্মে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন মধ্য বামপন্থী সরকার বিষয়টি ধামচাপা দিয়ে না রেখে এখন প্রকাশ্যেই বলছে, দরিদ্র হয়ে পড়ছে জাপানের জনগণ। শুধু তা-ই নয়, দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি যে ক্রমশই সম্প্রসারিত হয়ে অল্প কিছুদিন আগেও সমতাপূর্ণ এক সমাজ হিসেবে গর্বের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরা দেশের জনগণের আগের সেই বিশ্বাস আর আস্থায় ধস নামিয়ে দিচ্ছে, তার প্রমাণও আজকাল সহজেই দৃষ্টিযোগ্য।
জাপানের দারিদ্র্যকবলিত হওয়ার বিষয়টি সরকারিভাবে প্রথম স্বীকার করা হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দারিদ্র্যসংক্রান্ত প্রতিবেদনে। জাপানের অনেকেই সেবারই প্রথম জানতে পারেন, দেশজুড়ে দারিদ্র্যের বিস্তার কতটা ভয়াবহ। এর আগে অবশ্য ২০০৪ সালে বিশ্বের অগ্রসর রাষ্ট্রগুলোর প্যারিসভিত্তিক সংগঠন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা OECD জাপানের দরিদ্র হয়ে ওঠার যে হিসাব তুলে ধরেছিল, তাতে দেশটিতে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয় ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। জাপানের তৎকালীন সরকার অবশ্য OECD-এর তুলে ধরা সেই হিসাব মেনে নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই বলা হচ্ছিল, দারিদ্র্যের সমস্যা জাপানে বড় কোনো সমস্যা নয়। তবে এখন অবশ্য গত অক্টোবরে প্রকাশিত ২০০৭ সালের সরকারি হিসাব থেকে জাপানের লোকজন জানতে পারছেন, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ বা প্রায় দুই কোটি লোককে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হচ্ছে এবং সেই হিসাব ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী পথে ধাবমান।
দুই কোটির এই হিসাবকে অন্যভাবে বলা যায় প্রতি ছয়জনে একজন। জাপান সরকার এখন প্রকাশ্যেই বলছে, দারিদ্র্যের বিস্তার দেশজুড়ে ক্রমশই থাবা বাড়িয়ে চলেছে এবং এই অসুস্থ প্রবণতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের শিশুরা। OECD-এর ৩০টি সদস্য-দেশের মধ্যে তুলনামূলক দরিদ্র অবস্থায় বসবাসকারী শিশুদের হিসাবের দিক থেকে জাপানের অবস্থান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয়। রাজধানী টোকিওর মেট্রোপলিটন শিক্ষক সমিতির ২০০৮ সালে চালানো ভিন্ন এক জরিপে দেখা যায়, স্কুলগামী অনেক শিশুই আজকাল স্কুলে মধ্যাহ্নভোজের জন্য নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না কিংবা স্কুলভ্রমণে যেতে পারছে না। এ রকম শিশুদের অনেকেই আবার সিঙ্গল মাদার বা অবিবাহিত কিংবা বিচ্ছেদ হওয়া মায়ের সন্তান, অর্থনৈতিক জটিলতার মুখে সংসার চালানোর খরচ জোগাড়ে যেসব মাকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পরিবারের হিসাবে সিঙ্গল মাদার পরিবারের অনুপাতিক হার জাপানে মাত্র ৪ দশমিক ১ শতাংশ হলেও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের হিসাবে সে রকম পরিবারের অংশীদার হচ্ছে ৬০ শতাংশের বেশি।
কেন জাপানের এ রকম হঠাৎ দরিদ্র হয়ে ওঠা—এই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় নতুন সরকারের দেওয়া বিশ্লেষণ থেকে। সরকার বলছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের পরিসংখ্যানগত হিসাব ১৯৯৮ সাল থেকে নেওয়া শুরু হলেও উদার গণতন্ত্রী দলের নেতৃত্বাধীন পূর্ববর্তী সরকার এই হিসাব কখনোই প্রকাশ করেনি, বিশেষ করে জাপানের গোপনীয়তা বজায় রেখে চলা আমলাতন্ত্র সামাজিক ভারসাম্যহীনতা নষ্ট হতে না দেওয়ার বাসনা থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের হিসাব প্রকাশ করতে আগের সরকারগুলোকে বিরত রাখে।
গত গ্রীষ্মের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত জাপানে উদার গণতন্ত্রী দল LDP ১৯৫৫ থেকে শুরু করে প্রায় বিরতিহীনভাবে ক্ষমতাসীন ছিল। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন থাকার সেই প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ী নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে বলিষ্ঠ যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাত একসময় গড়ে ওঠে, জাপানে তা ইস্পাতকঠিন ত্রিভুজ নামে পরিচিত, গত নির্বাচনের পর যার অনেকটাই এখন ভেঙে পড়ার মুখে। আমলাতন্ত্র ছিল এর মুখ্য একটি উপাদান, রাজনীতিবিদেরা নানা কারণে যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। জাপানের সাড়া জাগানো অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে আমলাতন্ত্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে গেলেও রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলতেও বলিষ্ঠ ভূমিকা সেই একই আমলাতন্ত্র রেখেছে। ফলে গত সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী গণতন্ত্রী দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেই ঘোষণা করেছিল, নির্বাচনে বিজয়ী হলে আমলাতান্ত্রিক গোপনীয়তার বন্ধন থেকে জাপানকে তারা বের করে আনবে। সেই প্রক্রিয়াই এখন চলছে জাপানজুুড়ে, যার একটি ফল হচ্ছে এক দশক ধরে আমলাতন্ত্রের গোপন করে রাখা দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান প্রকাশে প্রধানমন্ত্রী ইয়ুকিও হাতোইয়ামার সরকারের নেওয়া উদ্যোগ। সরকার বলছে, সমস্যার বস্তুনিষ্ঠ সমাধান খুঁজে পেতে হলে এর গভীরতা সম্পর্কেও জনগণের জানা থাকা দরকার। আর সেই ধারণা থেকেই দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান প্রকাশে সরকারের এগিয়ে আসা।
জাপানের জনগণের দরিদ্র হয়ে পড়ার পেছনের মূল কারণ অবশ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসায় দেশের ব্যর্থতা। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে বুদ্বুদ অর্থনীতি ফেটে পড়া থেকে সংকটের সূচনা হলেও এর সঠিক ব্যাপ্তি অবশ্য ৯০-এর দশকের পুরোটা ধরে সেভাবে অনুভব করা যায়নি। নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠার যে চেষ্টা বিভিন্ন সময় সরকার চালিয়েছিল, তার মূলে প্রধানত ছিল জাপানের বাণিজ্যের খাতকে সতেজ করে তোলার মধ্য দিয়ে সংকট উত্তরণের চেষ্টা চালানো। ফলে সংকটকবলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মন্দ ঋণের বিশাল বোঝা থেকে বের হয়ে আসায় সাহায্য করতে লাখ কোটি ডলার খরচ করা হলেও নাগরিক জীবনের দুর্দশা লাঘবে বরাদ্দের পরিমাণ কিন্তু ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসে। অন্যদিকে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে করপোরেট জাপান বা জাপানের প্রভাবশালী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য শ্রম আইন শিথিল করে নেওয়ার মতো চাকরিসংক্রান্ত অন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, জাপানে আনেক প্রচলিত ব্যবস্থার মূলে তা আঘাত হানে এবং খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত নতুন এক শ্রমজীবী শ্রেণীর আবির্ভাবের সুযোগও তা করে দেয়। এসবের পরিণতিতে জাপান এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বিশাল এক জনসংখ্যার দেশে পরিণত হয়েছে, যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ স্বাভাবিকভাবেই হচ্ছে খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত, সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন সুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত।
তবে জাপানের দারিদ্র্যসীমাকে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের দারিদ্র্যসীমার সঙ্গে এক করে দেখা অবশ্যই ঠিক হবে না। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় দারিদ্র্যসীমা অনেক দিন ধরেই এক ডলারের কমে দিনযাপনের হিসাবে সীমিত ছিল, এখন যেটা সম্ভবত এক ডলারের সামান্য কিছু বেশিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানের দারিদ্র্যসীমা অবশ্য এই হিসাবের অনেক ঊর্ধ্বে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডের হিসাবে জাপান সরকার দারিদ্র্যসীমার হিসাবে যে আয় নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা হলো, চার সদস্যের একটি পরিবারের বার্ষিক প্রায় ২২ হাজার মার্কিন ডলার বা আনুমানিক ২০ লাখ ইয়েন। বাংলাদেশের হিসাবে এই আয় হচ্ছে বিত্তবান পরিবারের আয়ের সমতুল্য। তবে জাপানের প্রচলিত সামাজিক কাঠামোয় এই পরিমাণ অর্থে চার সদস্যের একটি পরিবারের ভরণপোষণ রীতিমতো কষ্টসাধ্য। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের গাড়ি কিংবা মুঠোফোনের মালিকানা থাকা সত্ত্বেও মধ্যবিত্তের আরামদায়ক জীবনযাপন নিশ্চিত করে নেওয়া এদের পক্ষে কষ্টকর। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতাসীন থাকা প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির নেওয়া নানা রকম সংস্কার-উদ্যোগের যে মাশুল জাপানকে এখনো দিয়ে যেতে হচ্ছে, তারই ফলে কর্মজীবী দরিদ্র নামে পরিচিত একটি জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব জাপানে লক্ষ করা যায়। এরা ঠিক বেকার না হলেও কোথাও পূর্ণকালীন কাজ না করায় সামাজিক নিরাপত্তার অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে একাধিক কাজে এদের অনেককেই জড়িত হতে হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বাধীন জাপানের নতুন মধ্য বামপন্থী সরকার এখন চাইছে দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত জনবিচ্ছিন্ন নীতির কারণে স্বল্প আয়ের লোকজনের ওপর চেপে বসা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে। তবে সরকারের ভান্ডার সীমিত হওয়ায় সরকারি বন্ড বাজারে ছাড়ার মধ্য দিয়ে আপাতত অর্থসংকুলানে সরকারকে উদ্যোগী হতে হলেও, সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজে পেতে হলে ক্রমশ সম্প্রসারমাণ ধনী আর দরিদ্রের পার্থক্য ঘুচিয়ে নেওয়ায় সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগী হতে হবে। তবে সেই পথে অগ্রসর হতে হলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার বাইরে আরও যা দরকার, তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের আন্তরিকতা। ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দলে আপাতত সেই আন্তরিকতার অভাব মোটেও নেই। ফলে সমাজের তলানিতে যারা এখন অবস্থান করছে, তাদের অনেকেরই ধারণা, এই সরকারই হচ্ছে এখন তাদের শেষ ভরসা।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
তার পরও বলতে হয়, ভিন্ন এক চেহারা নিয়ে দারিদ্র্য জাপানে এখন আবারও ফিরে আসছে। এই ফিরে আসা হঠাৎ করে দেখা দেওয়ার প্রবণতা না হলেও অনেক দিন ধরেই জাপানের নীতিনির্ধারকেরা চেষ্টা করে গেছেন দারিদ্র্যের ফিরে আসার সেই খবরকে যতটা সম্ভব চেপে রাখতে। তবে নাগরিকজীবনে এর প্রভাব ক্রমশই ব্যাপক হয়ে ওঠায় জাপানের পক্ষে এখন আর সম্ভব হচ্ছে না সত্যকে অস্বীকার করে যাওয়া। গত গ্রীষ্মে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন মধ্য বামপন্থী সরকার বিষয়টি ধামচাপা দিয়ে না রেখে এখন প্রকাশ্যেই বলছে, দরিদ্র হয়ে পড়ছে জাপানের জনগণ। শুধু তা-ই নয়, দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি যে ক্রমশই সম্প্রসারিত হয়ে অল্প কিছুদিন আগেও সমতাপূর্ণ এক সমাজ হিসেবে গর্বের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরা দেশের জনগণের আগের সেই বিশ্বাস আর আস্থায় ধস নামিয়ে দিচ্ছে, তার প্রমাণও আজকাল সহজেই দৃষ্টিযোগ্য।
জাপানের দারিদ্র্যকবলিত হওয়ার বিষয়টি সরকারিভাবে প্রথম স্বীকার করা হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দারিদ্র্যসংক্রান্ত প্রতিবেদনে। জাপানের অনেকেই সেবারই প্রথম জানতে পারেন, দেশজুড়ে দারিদ্র্যের বিস্তার কতটা ভয়াবহ। এর আগে অবশ্য ২০০৪ সালে বিশ্বের অগ্রসর রাষ্ট্রগুলোর প্যারিসভিত্তিক সংগঠন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা OECD জাপানের দরিদ্র হয়ে ওঠার যে হিসাব তুলে ধরেছিল, তাতে দেশটিতে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয় ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। জাপানের তৎকালীন সরকার অবশ্য OECD-এর তুলে ধরা সেই হিসাব মেনে নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই বলা হচ্ছিল, দারিদ্র্যের সমস্যা জাপানে বড় কোনো সমস্যা নয়। তবে এখন অবশ্য গত অক্টোবরে প্রকাশিত ২০০৭ সালের সরকারি হিসাব থেকে জাপানের লোকজন জানতে পারছেন, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ বা প্রায় দুই কোটি লোককে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হচ্ছে এবং সেই হিসাব ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী পথে ধাবমান।
দুই কোটির এই হিসাবকে অন্যভাবে বলা যায় প্রতি ছয়জনে একজন। জাপান সরকার এখন প্রকাশ্যেই বলছে, দারিদ্র্যের বিস্তার দেশজুড়ে ক্রমশই থাবা বাড়িয়ে চলেছে এবং এই অসুস্থ প্রবণতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের শিশুরা। OECD-এর ৩০টি সদস্য-দেশের মধ্যে তুলনামূলক দরিদ্র অবস্থায় বসবাসকারী শিশুদের হিসাবের দিক থেকে জাপানের অবস্থান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয়। রাজধানী টোকিওর মেট্রোপলিটন শিক্ষক সমিতির ২০০৮ সালে চালানো ভিন্ন এক জরিপে দেখা যায়, স্কুলগামী অনেক শিশুই আজকাল স্কুলে মধ্যাহ্নভোজের জন্য নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না কিংবা স্কুলভ্রমণে যেতে পারছে না। এ রকম শিশুদের অনেকেই আবার সিঙ্গল মাদার বা অবিবাহিত কিংবা বিচ্ছেদ হওয়া মায়ের সন্তান, অর্থনৈতিক জটিলতার মুখে সংসার চালানোর খরচ জোগাড়ে যেসব মাকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পরিবারের হিসাবে সিঙ্গল মাদার পরিবারের অনুপাতিক হার জাপানে মাত্র ৪ দশমিক ১ শতাংশ হলেও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের হিসাবে সে রকম পরিবারের অংশীদার হচ্ছে ৬০ শতাংশের বেশি।
কেন জাপানের এ রকম হঠাৎ দরিদ্র হয়ে ওঠা—এই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় নতুন সরকারের দেওয়া বিশ্লেষণ থেকে। সরকার বলছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের পরিসংখ্যানগত হিসাব ১৯৯৮ সাল থেকে নেওয়া শুরু হলেও উদার গণতন্ত্রী দলের নেতৃত্বাধীন পূর্ববর্তী সরকার এই হিসাব কখনোই প্রকাশ করেনি, বিশেষ করে জাপানের গোপনীয়তা বজায় রেখে চলা আমলাতন্ত্র সামাজিক ভারসাম্যহীনতা নষ্ট হতে না দেওয়ার বাসনা থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের হিসাব প্রকাশ করতে আগের সরকারগুলোকে বিরত রাখে।
গত গ্রীষ্মের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত জাপানে উদার গণতন্ত্রী দল LDP ১৯৫৫ থেকে শুরু করে প্রায় বিরতিহীনভাবে ক্ষমতাসীন ছিল। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন থাকার সেই প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ী নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে বলিষ্ঠ যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাত একসময় গড়ে ওঠে, জাপানে তা ইস্পাতকঠিন ত্রিভুজ নামে পরিচিত, গত নির্বাচনের পর যার অনেকটাই এখন ভেঙে পড়ার মুখে। আমলাতন্ত্র ছিল এর মুখ্য একটি উপাদান, রাজনীতিবিদেরা নানা কারণে যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। জাপানের সাড়া জাগানো অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে আমলাতন্ত্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে গেলেও রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলতেও বলিষ্ঠ ভূমিকা সেই একই আমলাতন্ত্র রেখেছে। ফলে গত সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী গণতন্ত্রী দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেই ঘোষণা করেছিল, নির্বাচনে বিজয়ী হলে আমলাতান্ত্রিক গোপনীয়তার বন্ধন থেকে জাপানকে তারা বের করে আনবে। সেই প্রক্রিয়াই এখন চলছে জাপানজুুড়ে, যার একটি ফল হচ্ছে এক দশক ধরে আমলাতন্ত্রের গোপন করে রাখা দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান প্রকাশে প্রধানমন্ত্রী ইয়ুকিও হাতোইয়ামার সরকারের নেওয়া উদ্যোগ। সরকার বলছে, সমস্যার বস্তুনিষ্ঠ সমাধান খুঁজে পেতে হলে এর গভীরতা সম্পর্কেও জনগণের জানা থাকা দরকার। আর সেই ধারণা থেকেই দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান প্রকাশে সরকারের এগিয়ে আসা।
জাপানের জনগণের দরিদ্র হয়ে পড়ার পেছনের মূল কারণ অবশ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসায় দেশের ব্যর্থতা। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে বুদ্বুদ অর্থনীতি ফেটে পড়া থেকে সংকটের সূচনা হলেও এর সঠিক ব্যাপ্তি অবশ্য ৯০-এর দশকের পুরোটা ধরে সেভাবে অনুভব করা যায়নি। নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠার যে চেষ্টা বিভিন্ন সময় সরকার চালিয়েছিল, তার মূলে প্রধানত ছিল জাপানের বাণিজ্যের খাতকে সতেজ করে তোলার মধ্য দিয়ে সংকট উত্তরণের চেষ্টা চালানো। ফলে সংকটকবলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মন্দ ঋণের বিশাল বোঝা থেকে বের হয়ে আসায় সাহায্য করতে লাখ কোটি ডলার খরচ করা হলেও নাগরিক জীবনের দুর্দশা লাঘবে বরাদ্দের পরিমাণ কিন্তু ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসে। অন্যদিকে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে করপোরেট জাপান বা জাপানের প্রভাবশালী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য শ্রম আইন শিথিল করে নেওয়ার মতো চাকরিসংক্রান্ত অন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, জাপানে আনেক প্রচলিত ব্যবস্থার মূলে তা আঘাত হানে এবং খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত নতুন এক শ্রমজীবী শ্রেণীর আবির্ভাবের সুযোগও তা করে দেয়। এসবের পরিণতিতে জাপান এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বিশাল এক জনসংখ্যার দেশে পরিণত হয়েছে, যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ স্বাভাবিকভাবেই হচ্ছে খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত, সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন সুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত।
তবে জাপানের দারিদ্র্যসীমাকে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের দারিদ্র্যসীমার সঙ্গে এক করে দেখা অবশ্যই ঠিক হবে না। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় দারিদ্র্যসীমা অনেক দিন ধরেই এক ডলারের কমে দিনযাপনের হিসাবে সীমিত ছিল, এখন যেটা সম্ভবত এক ডলারের সামান্য কিছু বেশিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানের দারিদ্র্যসীমা অবশ্য এই হিসাবের অনেক ঊর্ধ্বে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডের হিসাবে জাপান সরকার দারিদ্র্যসীমার হিসাবে যে আয় নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা হলো, চার সদস্যের একটি পরিবারের বার্ষিক প্রায় ২২ হাজার মার্কিন ডলার বা আনুমানিক ২০ লাখ ইয়েন। বাংলাদেশের হিসাবে এই আয় হচ্ছে বিত্তবান পরিবারের আয়ের সমতুল্য। তবে জাপানের প্রচলিত সামাজিক কাঠামোয় এই পরিমাণ অর্থে চার সদস্যের একটি পরিবারের ভরণপোষণ রীতিমতো কষ্টসাধ্য। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের গাড়ি কিংবা মুঠোফোনের মালিকানা থাকা সত্ত্বেও মধ্যবিত্তের আরামদায়ক জীবনযাপন নিশ্চিত করে নেওয়া এদের পক্ষে কষ্টকর। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতাসীন থাকা প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির নেওয়া নানা রকম সংস্কার-উদ্যোগের যে মাশুল জাপানকে এখনো দিয়ে যেতে হচ্ছে, তারই ফলে কর্মজীবী দরিদ্র নামে পরিচিত একটি জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব জাপানে লক্ষ করা যায়। এরা ঠিক বেকার না হলেও কোথাও পূর্ণকালীন কাজ না করায় সামাজিক নিরাপত্তার অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে একাধিক কাজে এদের অনেককেই জড়িত হতে হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বাধীন জাপানের নতুন মধ্য বামপন্থী সরকার এখন চাইছে দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত জনবিচ্ছিন্ন নীতির কারণে স্বল্প আয়ের লোকজনের ওপর চেপে বসা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে। তবে সরকারের ভান্ডার সীমিত হওয়ায় সরকারি বন্ড বাজারে ছাড়ার মধ্য দিয়ে আপাতত অর্থসংকুলানে সরকারকে উদ্যোগী হতে হলেও, সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজে পেতে হলে ক্রমশ সম্প্রসারমাণ ধনী আর দরিদ্রের পার্থক্য ঘুচিয়ে নেওয়ায় সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগী হতে হবে। তবে সেই পথে অগ্রসর হতে হলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার বাইরে আরও যা দরকার, তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের আন্তরিকতা। ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দলে আপাতত সেই আন্তরিকতার অভাব মোটেও নেই। ফলে সমাজের তলানিতে যারা এখন অবস্থান করছে, তাদের অনেকেরই ধারণা, এই সরকারই হচ্ছে এখন তাদের শেষ ভরসা।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments