কালান্তরের কড়চা-রাজনীতিতে জনমত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করেন কারা? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
পশ্চিমবঙ্গের গত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের বেশ কিছু আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম। তখন সিন্ধুর ও নন্দিগ্রামে কৃষক অসন্তোষ শুরু হয়ে গেছে। তবে মমতা-জোয়ার তখনো প্রবলভাবে দেখা দেয়নি। কলকাতার বাজারি পত্রিকা 'আনন্দবাজার' (ঢাকায় 'প্রথম আলোর' চরিত্রের কাগজ) তখনো ভোল পাল্টে মমতার পক্ষে তেমন জোরেশোরে কিছু লিখছে না।
কেবল মহাশ্বেতা দেবীর নেতৃত্বে একদল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বামফ্রন্ট সরকার ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সমালোচনা করা শুরু করেছেন মাত্র।
এক দিন এক সাংবাদিক বন্ধু ক্যালকাটা ক্লাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গিয়ে দেখি আরো দু-চারজন সাংবাদিক বন্ধু এসেছেন। তাঁদের মধ্যে সিপিএমের মুখপত্র দৈনিক 'গণশক্তি'র একজন সাংবাদিকও আছেন। তাঁকে আলাপের এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করেছি, বামফ্রন্ট তো ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু এবার যা দেখছি, তাতে তো মনে হয়, বিধানসভার আগামী নির্বাচনে তারা জয়ী হতে পারবে কি না সন্দেহের বিষয়।
তিনি হাসতে শুরু করলেন, বললেন, শুনেছি আপনি দৈনিক স্টেটসম্যানের একজন কলামিস্ট। ওই কাগজের সম্পাদক মানস ঘোষ হচ্ছেন মমতা ব্যানার্জির একমাত্র সমর্থক। ওই কাগজ পড়ে পড়ে আপনার সম্ভবত ধারণা হয়েছে, মমতা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে উৎখাত করতে পারবেন। এটা দিবাস্বপ্ন। কলকাতার দশ-পাঁচজন শহুরে মধ্যবিত্তের কথা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না। বামফ্রন্টের শিকড় গ্রামবাংলার একেবারে গভীর মাটিতে প্রোথিত। দু-একটা সিন্ধুর নন্দিগ্রাম দ্বারা সেই শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না।
তাঁকে বলেছি, শুধু মানস ঘোষ বা স্টেটসম্যান নয়, মহাশ্বেতা দেবী, শাঁওলি মিত্রসহ কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ এখন বামফ্রন্ট সরকারের প্রকাশ্য বিরোধিতায় নেমেছে। কেবল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কলকাতার শেরিফ বানিয়ে এই বিরোধিতা কি প্রতিহত করা যাবে?
বামফ্রন্ট সমর্থক সাংবাদিক বললেন, ছাড়ুন মশায় শহুরে বুদ্ধিজীবীদের কথা। এদের সমর্থন হচ্ছে বিল্বপত্রে জল। সহজেই ছলকে পড়ে যায়। কলকাতার শহুরে মধ্যবিত্তের কথা শুনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বিচার করবেন না। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছে গ্রামবাংলার আমজনতার সমর্থনের জোরে। সেই সমর্থন এখনো টিকে আছে। দু-এক জায়গায় এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে বামফ্রন্ট হেরেছে বলে মনে করবেন না, তাদের সমর্থনের ভিত্তি দুর্বল হয়েছে। ৩০ বছর ধরে পার্টি ক্ষমতায় আছে। এখন মাঝেমধ্যে একটু এদিক-সেদিক হবেই। কিন্তু গ্রামবাংলায় বামফ্রন্টের সমর্থনের শিকড় এখনো খুবই মজবুত। আগামী নির্বাচনের ফল দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। মমতা-ফমতা কোথায় ফুঁয়ে উড়ে যাবে! এই যে এখন কলকাতার বাবুদের মুখে বামফ্রন্টের সমালোচনা শুনছেন, তা হচ্ছে বাবুবিলাস। কলকাতার বাবুদের বিলাস চর্চা। গ্রামের মেহনতি মানুষ এই শহুরের বাবুদের মতো বিলাস চর্চা করে না। আর তারাই হচ্ছে বামফ্রন্টের শক্ত ঘাঁটি।
বামফ্রন্টের কাগজের সাংবাদিকের মুখে এই দীর্ঘ বক্তৃতা শুনে আমার মনেও পশ্চিমবঙ্গে মমতা-জোয়ার সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এ জোয়ার সম্ভবত সাময়িক স্রোতের ফেনা। বেশি দিন টিকবে না। বামফ্রন্টের মতো এত বিরাট ও শক্তিশালী জোট সরকার মমতা-জোয়ারে ভেসে যাবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার পর আমার বিভ্রান্তি কাটতে দেরি হয়নি। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন নিজে এবং তাঁর সব মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্য যেমন গো-হারা হেরেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের গত রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর মন্ত্রীদেরসহ গো-হারা হেরেছেন।
আমার এই লেখায় কলকাতার এই উদাহরণটি টানার কারণ আছে। সম্প্রতি সপ্তাহখানেক ঢাকায় ছিলাম। এ সময় বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মতের কথা জেনেছি। এতে একটা ব্যাপার দেখে বিস্মিত হয়েছি, আগামী দেড় বছর পর যদি দেশের নির্দিষ্ট সাধারণ নির্বাচনটি সব বাধা-বিঘ্ন ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠে অনুষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে এই নির্বাচনের ফল কী দাঁড়াবে তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভক্ত মনোভাব বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের যারা মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মী এবং যারা দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীদের কাছে উপেক্ষিত, তারা দল সম্পর্কে চরমভাবে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ। তাদের অনেকেরই মত, সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ আর কখনো এতটা দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়েনি। অযোগ্য মন্ত্রী দ্বারা যেমন দেশ শাসন চলে না, তেমনি অযোগ্য নেতৃত্ব দ্বারা সংগঠনও শক্তিশালী করা যায় না। দলের সভানেত্রী নিজে যত দক্ষ এবং যোগ্য হন, তিনি দলের কার্যনির্বাহী নেতাদের পদে অযোগ্য ও অনুপস্থিত নেতৃত্ব বসিয়ে দেওয়ায় দলটি ঝড়ের মুখে খড়ের ঘরের মতো অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
তাদের মতে, এমন একটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন নেই, যেখানে আওয়ামী লীগে চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই, সুবিধাবাদীরা এসে কর্তৃত্ব দখল করেনি এবং নিজেদের অপকর্ম দ্বারা দলের সুনাম ধুলায় লুটিয়ে দিচ্ছে না। দলের প্রকৃত নেতা-কর্মীরা শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে এত মন্দভাগ্য, তার মূল কারণ বিএনপির সমর্থন বৃদ্ধি নয়, আওয়ামী লীগের একাধিক পর্যায়ে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং দলের হাই কমান্ডের নির্দেশকে থোড়াই কেয়ার করা। এই অবস্থায় যেকোনো পদ্ধতিতেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, আওয়ামী লীগের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নিয়ে দলের মাঠ পর্যায়ের সাধারণ নেতা-কর্মীরা সন্দিহান।
অন্যদিকে এবার ঢাকায় এমন কিছু আওয়ামী সমর্থকের সাক্ষাৎ পেয়েছি, যাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের কাছে যখন তখন পৌঁছাতে সক্ষম এবং ক্ষমতার স্বাদ ও আনন্দ দুটোই কিছু কিছু উপভোগ করেন। তাঁদের একজন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে আমাকে বললেন, গাফ্ফার ভাই, আপনি তো দেশের বাইরে থাকেন তাই মানুষের নাড়ির খবর রাখেন না। আগামী নির্বাচন যদি ঠিকঠাক মতো হতে পারে, তাহলে আওয়ামী লীগ চোখ বুজে জয়ী হবে।
তিনি আরো বললেন, সরকারের বিরুদ্ধে যত চিৎকার শুনছেন, সবই শহুরে মধ্যবিত্তদের। যারা পান থেকে চুন খসলেই অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পেছনে গ্রামের মানুষ একাট্টা। তারাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার। সরকারের কৃষিনীতির সাফল্যে কৃষক খুশি। মজুররা, এমনকি দিনমজুররা এখন ভালো উপার্জন করে। সরকারের শিক্ষানীতিতে গ্রামের একেবারে নিঃসম্বল পরিবারের সন্তান পর্যন্ত নিখরচায় লেখাপড়া করছে। আর কী চাই? শহরের মানুষ আর কিছু মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীর 'গেল গেল' চিৎকারে আওয়ামী লীগের কিছু যায়-আসে না। শেখ হাসিনার পার্সোনাল পপুলারিটির রেট যে ৭০ শতাংশের ওপরে, সে খবর কি কাগজে দেখেননি? বলেছি, দেখেছি। কিন্তু কথায় বলে- কাজির গরু কিতাবে থাকে, গোয়ালে থাকে না। জনমতের সঠিক হিসাবও অনেক সময় বাস্তবে ফলতে দেখা যায়নি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বিজয়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার রেট সর্বোচ্চ থাকা সত্ত্বেও তাঁর দল কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল। এই আওয়ামী বন্ধুকে দুটো গল্প বলেছি; দুটোই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমিন। আমি তখন ছাত্র। একই সঙ্গে দৈনিক সংবাদে চাকরি করি। নূরুল আমিন ছিলেন সংবাদের তৎকালীন মালিক।
১৯৫৩ সালের মধ্যভাগ থেকে নির্বাচন প্রচারণা জমজমাট হয়ে ওঠে। এ সময় মুখ্যমন্ত্রী সংবাদের সম্পাদক খায়রুল কবিরকে ডেকে নির্দেশ দেন, হক-ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগ যে নির্বাচনে জয়ী হবে এ সম্পর্কে সংবাদে একটি রিপোর্ট প্রকাশের জন্য। তিনি জানালেন, সব সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট তিনি পেয়েছেন। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, নূরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমানে যে ক্ষোভ দেখা যায়, তা আসলে শহরের ছাত্র-শিক্ষক ও পেশাজীবী শ্রেণীর ক্ষোভ। তা গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়নি। সুতরাং নির্বাচনে মুসলিম লীগের হেরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এই গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, শহুরে মধ্যবিত্তদের অসন্তোষে মুসলিম লীগ সরকারের ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারা সহজেই নির্বাচনে জয়ী হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী কতটা ফলেছিল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফল তার প্রমাণ। তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
দ্বিতীয় গল্পটিও সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমলের, ১৯৬৯-এর প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে পরের। এই ঝড়ে ১০ লাখ নর-নারী এক রাতে মারা যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো নেতা এই ঝড়-দুর্গতদের দেখতে আসেননি। তাঁরা অবজ্ঞার সুরে বলেছেন, এটা ন্যাচারাল ক্যালামিটি, আমরা কী করব? যা হোক, এর দীর্ঘকাল পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঝড়ে দুর্গত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দেখতে আসেন। তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠেছে।
ভুট্টো ঢাকায় এসে সরাসরি যান ভোলার দ্বীপাঞ্চলে। সেখানে দুর্গত মানুষকে তাদের দুর্গতির কথা জিজ্ঞাসা না করে জিজ্ঞাসা করলেন, তোম এক পাকিস্তান মাংতা হ্যায়, না দো পাকিস্তান? সাধারণ মানুষ তাঁর এই প্রশ্নের তাৎপর্য কী বুঝবে? তারা জবাব দিয়েছে, এক পাকিস্তান চাই। আর যায় কোথা? ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে উড়ে গেলেন। সংবাদ সম্মেলন ডেকে বললেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ শেখ মুজিবের ছয় দফা চায় না। তারা এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী। ছয় দফা-ছয় দফা করে যে চিৎকার, তা পূর্ব পাকিস্তানের শহুরে মধ্যবিত্ত, ছাত্র, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের চিৎকার। তা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার কাছেও জুলফিকার আলী ভুট্টো এই একই মন্তব্য করেছিলেন। তার ফল কী হয়েছিল, ১৯৭০-এর নির্বাচন ও '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তার প্রমাণ।
আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয়ে বিশ্বাসী বন্ধুকে বলেছি, আমার কথা দ্বারা তিনি যেন মনে না করেন, আগামী নির্বাচন যথাসময়ে বিনা বাধায় হতে পারলে আওয়ামী লীগ তাতে জয়ী হবে না, এমন ইঙ্গিত আমি দিচ্ছি। আমার কথা, অতীতের অভিজ্ঞতা বলে দেশের পল্লীবাসী মানুষ কোনো সরকারের ওপর যতই সন্তুষ্ট থাকুক, নির্বাচনের আগে তাদের মতামত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করে শহরবাসী মধ্যবিত্ত। শহরের ছাত্র-যুবক, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা যদি সরকারের ওপর বিক্ষুব্ধ হন, তার প্রভাব পল্লীর বিশাল-বিরাট জনসংখ্যার ওপর গিয়ে পড়ে। এটা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও সত্য।
এই সত্যটিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যদি মনে করে, সন্তুষ্ট রুরাল ভোটেই তারা নির্বাচনে বাজিমাত করবে, তাহলে বড় ভুল করা হবে। শহরের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনের দুঃসহ সমস্যাগুলো লাঘব করাকে প্রায়োরিটি দিয়ে আগামী দেড় বছরে যদি তারা শহরের সমালোচনা মুখর মধ্যবিত্তকে, মিডিয়াকে, বুদ্ধিজীবী-ক্রিটিকদের শান্ত করতে না পারে, তাহলে সেই অসন্তোষের ঢেউ গ্রামবাংলাতেও গিয়ে পৌঁছবে এবং তাকে প্লাবিত করবে। এখনই সতর্ক না হলে সরকারের পক্ষে সেই প্লাবন রোখা সম্ভব হবে না।
আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় দুর্ভাগ্য, ক্ষমতায় গেলেই তারা আত্মসন্তোষে ভোগে। সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পাত্তা দেয় না। সহজেই আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় অক্ষমতা দেখায়। তাদের প্রচার-প্রোপাগান্ডা শক্তি এতই দুর্বল যে নিজেদের ভালো কাজগুলোও তারা জনগণের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না।
এখনো সময় আছে। অহঙ্কার, জেদ ও আত্মসন্তোষের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগ যদি শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের বিরাট অংশকে (বিরোধী দলের চিহ্নিত ব্যক্তিদের নয়) আবার অসন্তোষমুক্ত করে নিজেদের দিকে টানতে পারে, তাহলে অবশ্যই আগামী নির্বাচনে তাদের জেতার সম্ভাবনা আছে। কারণ এই শহুরে মধ্যবিত্তরা বোঝেন, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই দুর্ভাগা দেশের চরম দুর্ভাগ্য কোথায় গিয়ে পৌঁছবে?
লন্ডন, ২১ মে, সোমবার, ২০১২
এক দিন এক সাংবাদিক বন্ধু ক্যালকাটা ক্লাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গিয়ে দেখি আরো দু-চারজন সাংবাদিক বন্ধু এসেছেন। তাঁদের মধ্যে সিপিএমের মুখপত্র দৈনিক 'গণশক্তি'র একজন সাংবাদিকও আছেন। তাঁকে আলাপের এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করেছি, বামফ্রন্ট তো ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু এবার যা দেখছি, তাতে তো মনে হয়, বিধানসভার আগামী নির্বাচনে তারা জয়ী হতে পারবে কি না সন্দেহের বিষয়।
তিনি হাসতে শুরু করলেন, বললেন, শুনেছি আপনি দৈনিক স্টেটসম্যানের একজন কলামিস্ট। ওই কাগজের সম্পাদক মানস ঘোষ হচ্ছেন মমতা ব্যানার্জির একমাত্র সমর্থক। ওই কাগজ পড়ে পড়ে আপনার সম্ভবত ধারণা হয়েছে, মমতা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে উৎখাত করতে পারবেন। এটা দিবাস্বপ্ন। কলকাতার দশ-পাঁচজন শহুরে মধ্যবিত্তের কথা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না। বামফ্রন্টের শিকড় গ্রামবাংলার একেবারে গভীর মাটিতে প্রোথিত। দু-একটা সিন্ধুর নন্দিগ্রাম দ্বারা সেই শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না।
তাঁকে বলেছি, শুধু মানস ঘোষ বা স্টেটসম্যান নয়, মহাশ্বেতা দেবী, শাঁওলি মিত্রসহ কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ এখন বামফ্রন্ট সরকারের প্রকাশ্য বিরোধিতায় নেমেছে। কেবল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কলকাতার শেরিফ বানিয়ে এই বিরোধিতা কি প্রতিহত করা যাবে?
বামফ্রন্ট সমর্থক সাংবাদিক বললেন, ছাড়ুন মশায় শহুরে বুদ্ধিজীবীদের কথা। এদের সমর্থন হচ্ছে বিল্বপত্রে জল। সহজেই ছলকে পড়ে যায়। কলকাতার শহুরে মধ্যবিত্তের কথা শুনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বিচার করবেন না। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছে গ্রামবাংলার আমজনতার সমর্থনের জোরে। সেই সমর্থন এখনো টিকে আছে। দু-এক জায়গায় এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে বামফ্রন্ট হেরেছে বলে মনে করবেন না, তাদের সমর্থনের ভিত্তি দুর্বল হয়েছে। ৩০ বছর ধরে পার্টি ক্ষমতায় আছে। এখন মাঝেমধ্যে একটু এদিক-সেদিক হবেই। কিন্তু গ্রামবাংলায় বামফ্রন্টের সমর্থনের শিকড় এখনো খুবই মজবুত। আগামী নির্বাচনের ফল দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। মমতা-ফমতা কোথায় ফুঁয়ে উড়ে যাবে! এই যে এখন কলকাতার বাবুদের মুখে বামফ্রন্টের সমালোচনা শুনছেন, তা হচ্ছে বাবুবিলাস। কলকাতার বাবুদের বিলাস চর্চা। গ্রামের মেহনতি মানুষ এই শহুরের বাবুদের মতো বিলাস চর্চা করে না। আর তারাই হচ্ছে বামফ্রন্টের শক্ত ঘাঁটি।
বামফ্রন্টের কাগজের সাংবাদিকের মুখে এই দীর্ঘ বক্তৃতা শুনে আমার মনেও পশ্চিমবঙ্গে মমতা-জোয়ার সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এ জোয়ার সম্ভবত সাময়িক স্রোতের ফেনা। বেশি দিন টিকবে না। বামফ্রন্টের মতো এত বিরাট ও শক্তিশালী জোট সরকার মমতা-জোয়ারে ভেসে যাবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার পর আমার বিভ্রান্তি কাটতে দেরি হয়নি। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন নিজে এবং তাঁর সব মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্য যেমন গো-হারা হেরেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের গত রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর মন্ত্রীদেরসহ গো-হারা হেরেছেন।
আমার এই লেখায় কলকাতার এই উদাহরণটি টানার কারণ আছে। সম্প্রতি সপ্তাহখানেক ঢাকায় ছিলাম। এ সময় বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মতের কথা জেনেছি। এতে একটা ব্যাপার দেখে বিস্মিত হয়েছি, আগামী দেড় বছর পর যদি দেশের নির্দিষ্ট সাধারণ নির্বাচনটি সব বাধা-বিঘ্ন ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠে অনুষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে এই নির্বাচনের ফল কী দাঁড়াবে তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভক্ত মনোভাব বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের যারা মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মী এবং যারা দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীদের কাছে উপেক্ষিত, তারা দল সম্পর্কে চরমভাবে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ। তাদের অনেকেরই মত, সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ আর কখনো এতটা দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়েনি। অযোগ্য মন্ত্রী দ্বারা যেমন দেশ শাসন চলে না, তেমনি অযোগ্য নেতৃত্ব দ্বারা সংগঠনও শক্তিশালী করা যায় না। দলের সভানেত্রী নিজে যত দক্ষ এবং যোগ্য হন, তিনি দলের কার্যনির্বাহী নেতাদের পদে অযোগ্য ও অনুপস্থিত নেতৃত্ব বসিয়ে দেওয়ায় দলটি ঝড়ের মুখে খড়ের ঘরের মতো অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
তাদের মতে, এমন একটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন নেই, যেখানে আওয়ামী লীগে চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই, সুবিধাবাদীরা এসে কর্তৃত্ব দখল করেনি এবং নিজেদের অপকর্ম দ্বারা দলের সুনাম ধুলায় লুটিয়ে দিচ্ছে না। দলের প্রকৃত নেতা-কর্মীরা শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে এত মন্দভাগ্য, তার মূল কারণ বিএনপির সমর্থন বৃদ্ধি নয়, আওয়ামী লীগের একাধিক পর্যায়ে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং দলের হাই কমান্ডের নির্দেশকে থোড়াই কেয়ার করা। এই অবস্থায় যেকোনো পদ্ধতিতেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, আওয়ামী লীগের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নিয়ে দলের মাঠ পর্যায়ের সাধারণ নেতা-কর্মীরা সন্দিহান।
অন্যদিকে এবার ঢাকায় এমন কিছু আওয়ামী সমর্থকের সাক্ষাৎ পেয়েছি, যাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের কাছে যখন তখন পৌঁছাতে সক্ষম এবং ক্ষমতার স্বাদ ও আনন্দ দুটোই কিছু কিছু উপভোগ করেন। তাঁদের একজন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে আমাকে বললেন, গাফ্ফার ভাই, আপনি তো দেশের বাইরে থাকেন তাই মানুষের নাড়ির খবর রাখেন না। আগামী নির্বাচন যদি ঠিকঠাক মতো হতে পারে, তাহলে আওয়ামী লীগ চোখ বুজে জয়ী হবে।
তিনি আরো বললেন, সরকারের বিরুদ্ধে যত চিৎকার শুনছেন, সবই শহুরে মধ্যবিত্তদের। যারা পান থেকে চুন খসলেই অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পেছনে গ্রামের মানুষ একাট্টা। তারাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার। সরকারের কৃষিনীতির সাফল্যে কৃষক খুশি। মজুররা, এমনকি দিনমজুররা এখন ভালো উপার্জন করে। সরকারের শিক্ষানীতিতে গ্রামের একেবারে নিঃসম্বল পরিবারের সন্তান পর্যন্ত নিখরচায় লেখাপড়া করছে। আর কী চাই? শহরের মানুষ আর কিছু মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীর 'গেল গেল' চিৎকারে আওয়ামী লীগের কিছু যায়-আসে না। শেখ হাসিনার পার্সোনাল পপুলারিটির রেট যে ৭০ শতাংশের ওপরে, সে খবর কি কাগজে দেখেননি? বলেছি, দেখেছি। কিন্তু কথায় বলে- কাজির গরু কিতাবে থাকে, গোয়ালে থাকে না। জনমতের সঠিক হিসাবও অনেক সময় বাস্তবে ফলতে দেখা যায়নি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বিজয়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার রেট সর্বোচ্চ থাকা সত্ত্বেও তাঁর দল কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল। এই আওয়ামী বন্ধুকে দুটো গল্প বলেছি; দুটোই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমিন। আমি তখন ছাত্র। একই সঙ্গে দৈনিক সংবাদে চাকরি করি। নূরুল আমিন ছিলেন সংবাদের তৎকালীন মালিক।
১৯৫৩ সালের মধ্যভাগ থেকে নির্বাচন প্রচারণা জমজমাট হয়ে ওঠে। এ সময় মুখ্যমন্ত্রী সংবাদের সম্পাদক খায়রুল কবিরকে ডেকে নির্দেশ দেন, হক-ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগ যে নির্বাচনে জয়ী হবে এ সম্পর্কে সংবাদে একটি রিপোর্ট প্রকাশের জন্য। তিনি জানালেন, সব সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট তিনি পেয়েছেন। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, নূরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমানে যে ক্ষোভ দেখা যায়, তা আসলে শহরের ছাত্র-শিক্ষক ও পেশাজীবী শ্রেণীর ক্ষোভ। তা গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়নি। সুতরাং নির্বাচনে মুসলিম লীগের হেরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এই গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, শহুরে মধ্যবিত্তদের অসন্তোষে মুসলিম লীগ সরকারের ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারা সহজেই নির্বাচনে জয়ী হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী কতটা ফলেছিল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফল তার প্রমাণ। তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
দ্বিতীয় গল্পটিও সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমলের, ১৯৬৯-এর প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে পরের। এই ঝড়ে ১০ লাখ নর-নারী এক রাতে মারা যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো নেতা এই ঝড়-দুর্গতদের দেখতে আসেননি। তাঁরা অবজ্ঞার সুরে বলেছেন, এটা ন্যাচারাল ক্যালামিটি, আমরা কী করব? যা হোক, এর দীর্ঘকাল পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঝড়ে দুর্গত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দেখতে আসেন। তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠেছে।
ভুট্টো ঢাকায় এসে সরাসরি যান ভোলার দ্বীপাঞ্চলে। সেখানে দুর্গত মানুষকে তাদের দুর্গতির কথা জিজ্ঞাসা না করে জিজ্ঞাসা করলেন, তোম এক পাকিস্তান মাংতা হ্যায়, না দো পাকিস্তান? সাধারণ মানুষ তাঁর এই প্রশ্নের তাৎপর্য কী বুঝবে? তারা জবাব দিয়েছে, এক পাকিস্তান চাই। আর যায় কোথা? ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে উড়ে গেলেন। সংবাদ সম্মেলন ডেকে বললেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ শেখ মুজিবের ছয় দফা চায় না। তারা এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী। ছয় দফা-ছয় দফা করে যে চিৎকার, তা পূর্ব পাকিস্তানের শহুরে মধ্যবিত্ত, ছাত্র, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের চিৎকার। তা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার কাছেও জুলফিকার আলী ভুট্টো এই একই মন্তব্য করেছিলেন। তার ফল কী হয়েছিল, ১৯৭০-এর নির্বাচন ও '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তার প্রমাণ।
আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয়ে বিশ্বাসী বন্ধুকে বলেছি, আমার কথা দ্বারা তিনি যেন মনে না করেন, আগামী নির্বাচন যথাসময়ে বিনা বাধায় হতে পারলে আওয়ামী লীগ তাতে জয়ী হবে না, এমন ইঙ্গিত আমি দিচ্ছি। আমার কথা, অতীতের অভিজ্ঞতা বলে দেশের পল্লীবাসী মানুষ কোনো সরকারের ওপর যতই সন্তুষ্ট থাকুক, নির্বাচনের আগে তাদের মতামত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করে শহরবাসী মধ্যবিত্ত। শহরের ছাত্র-যুবক, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা যদি সরকারের ওপর বিক্ষুব্ধ হন, তার প্রভাব পল্লীর বিশাল-বিরাট জনসংখ্যার ওপর গিয়ে পড়ে। এটা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও সত্য।
এই সত্যটিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যদি মনে করে, সন্তুষ্ট রুরাল ভোটেই তারা নির্বাচনে বাজিমাত করবে, তাহলে বড় ভুল করা হবে। শহরের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনের দুঃসহ সমস্যাগুলো লাঘব করাকে প্রায়োরিটি দিয়ে আগামী দেড় বছরে যদি তারা শহরের সমালোচনা মুখর মধ্যবিত্তকে, মিডিয়াকে, বুদ্ধিজীবী-ক্রিটিকদের শান্ত করতে না পারে, তাহলে সেই অসন্তোষের ঢেউ গ্রামবাংলাতেও গিয়ে পৌঁছবে এবং তাকে প্লাবিত করবে। এখনই সতর্ক না হলে সরকারের পক্ষে সেই প্লাবন রোখা সম্ভব হবে না।
আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় দুর্ভাগ্য, ক্ষমতায় গেলেই তারা আত্মসন্তোষে ভোগে। সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পাত্তা দেয় না। সহজেই আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় অক্ষমতা দেখায়। তাদের প্রচার-প্রোপাগান্ডা শক্তি এতই দুর্বল যে নিজেদের ভালো কাজগুলোও তারা জনগণের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না।
এখনো সময় আছে। অহঙ্কার, জেদ ও আত্মসন্তোষের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগ যদি শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের বিরাট অংশকে (বিরোধী দলের চিহ্নিত ব্যক্তিদের নয়) আবার অসন্তোষমুক্ত করে নিজেদের দিকে টানতে পারে, তাহলে অবশ্যই আগামী নির্বাচনে তাদের জেতার সম্ভাবনা আছে। কারণ এই শহুরে মধ্যবিত্তরা বোঝেন, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই দুর্ভাগা দেশের চরম দুর্ভাগ্য কোথায় গিয়ে পৌঁছবে?
লন্ডন, ২১ মে, সোমবার, ২০১২
No comments