নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-সময় বদলায়, সবাই বদলান না by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
চট্টগ্রাম শহরের রেয়াজুদ্দিন বাজার এলাকায় একজন প্রৌঢ় মাংস বিক্রেতা আছেন, যিনি ক্রেতাদের সঙ্গে দরদস্তুর করার সময় নানা রকম রসিকতা করতে অভ্যস্ত। তাঁর কাছে হয়তো এটা ‘মনোরঞ্জন’-এর একটি পদ্ধতি, কারণ এসব কথাবার্তায় তাঁর ক্রেতাদের মধ্যে কেউ কেউ বিকৃত আনন্দ লাভ করেন।
কাউকে এমনকি এ ধরনের অশ্লীল কথাবার্তা বলতে তাঁকে প্রলুব্ধ করতেও দেখেছি। যেকোনো প্রসঙ্গকেই অশ্লীলতার দিকে মোড় দেওয়া এবং নারীকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের লক্ষ করে তোলার ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা(?) প্রায় বিস্ময়কর।
এই মাংস বিক্রেতা নিরক্ষর, সমাজে গুরুত্বহীন ব্যক্তি। ফলে তাঁর কথায় কান না দিলেও চলে। কিন্তু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সভা-সমাবেশে কি অহরহ এ রকম মন্তব্যই আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি না, যাতে নারী সম্পর্কে চরম অবমাননার প্রকাশ ঘটছে?
এলডিপি নেতা কর্নেল অলি আহমদ উচ্চশিক্ষিত, পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তাঁর মতো একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদকেও জনমনোরঞ্জনের একই বিকৃত পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেখলে হতাশা তৈরি হয় বৈকি!
নিজের নির্বাচনী এলাকা চন্দনাইশের এক সমাবেশে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘চন্দনাইশে একজন মহিলা এমপি দিয়ে হাজার যুবকের সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তাই টুঙ্গিপাড়া থেকে বেশি করে সুন্দরী মহিলাদের এনে চন্দনাইশে দিলে যুবসমাজের কল্যাণ হবে’ (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৯ নভেম্বর ’১১)। বোঝা যায় সংরক্ষিত আসনের স্থানীয় মহিলা সাংসদকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন কর্নেল অলি। পাশাপাশি ‘টুঙ্গিপাড়া’র কথা উল্লেখ করে তিনি কার দিকে অঙুলি নির্দেশ করেছেন তা-ও না বোঝার কোনো কারণ নেই।
এলডিপির সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রদল ও যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সমাবেশে এ কথা বলেছেন তিনি। ছাত্র ও যুবকদের নতুন যুগের রাজনীতির আদর্শ ও একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে যিনি নারী নেতৃত্বের প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিত করে সস্তা রসিকতা করতে পারেন, নারী সম্পর্কে অসম্মানের মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে উসকে দিতে পারেন, তাঁর অনুসারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
অবশ্য নারীর প্রতি কর্নেল অলির এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব নতুন কিছু না। বিএনপির এই সাবেক নেতা গত জোট সরকারের আমলে দলে গুরুত্ব হারিয়ে ও মন্ত্রিত্ব-বঞ্চিত হয়ে যখন এলডিপি গঠন করেন, তখনো তাঁর নানান বক্তৃতায় এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘মহিলার পায়ের কাছে বসে আমি রাজনীতি করতে পারব না।’ তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের দুর্নীতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেছিলেন, ‘মা ভালো হলে ছেলেরা এ রকম হবে কেন?’ এমনকি খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে এনেছেন দাবি করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমিই বেগম জিয়াকে রান্নাঘর থেকে রাজনীতিতে এনেছি, আবারও তাঁকে রান্নাঘরে ফিরে যেতে হবে।’
নিজের এসব মত ও মন্তব্য কর্নেল অলি নিশ্চয়ই ভুলে যেতে চাইবেন। কারণ এখন তিনি নিজেই ফিরে যেতে চান খালেদা জিয়ার ‘রান্নাঘরে’। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে এখন ঘন ঘন দেখা করছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে, তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতেও কোনো কুণ্ঠা নেই মনে। কিন্তু নারী নেতৃত্ব নিয়ে তাঁর মনোভাব গোপন নেই। চন্দনাইশের মহিলা সাংসদ সম্পর্কে এখন যা বলছেন, খালেদা জিয়াকে নিয়ে অন্যভাবে তা-ই বলেছিলেন। এখন খালেদা জিয়া সম্পর্কে তিনি কিছু বলছেন না তাঁর অর্থ এই নয়, যোগ্যতা ও দক্ষতার বিচারে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি তিনি অনুরক্ত বা আস্থাশীল। পুরো ব্যাপারটিই নিজের রাজনীতির ভবিষ্যতের সঙ্গে, নিজের স্বার্থচিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
নারী নেতৃত্ব নিয়ে যিনি আজ কটাক্ষ করেছেন, তিনিই একসময় নিজের জেতা আসনের উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাজ অলিকে প্রার্থী করতে দ্বিধাবোধ করেননি। ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে মমতাজ অলি যদি আবার প্রার্থী হতে চান, তখন সমর্থক-অনুসারীদের উদ্দেশে নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে যেসব কথা এখন তিনি বলছেন তা-কি বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না তাঁর দিকে?
যা-ই হোক, চন্দনাইশে অলি যেসব বক্তব্য রেখেছেন তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মামলা করেছেন আফতাব মাহমুদ (শিমুল) নামের এক তরুণ। তিনি দাবি করেছেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে কর্নেল অলি প্রধানমন্ত্রী ও মহিলা সাংসদের মর্যাদাহানির পাশাপাশি চন্দনাইশের ছাত্র-যুবকদেরও অসম্মান করেছেন। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে আসামিকে সাত দিনের মধ্যে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করেছেন। মামলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা জানি না। তবে নারী নেতৃত্ব, এমনকি সমাজের যেকোনো স্তরের নারী সম্পর্কে প্রকাশ্যে অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার বলে মনে করি।
অলির বক্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। তবে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন বা কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর মতো কর্মসূচিকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া মনে হলেও, আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর ওপর হামলার ঘটনাকে মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই। যে ঘটনা আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, তাকে এগোতে দেওয়া উচিত স্বাভাবিক গতিতেই। প্রথম আলোকে (আলোকিত চট্টগ্রাম) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অলি বলেছেন, ‘কোনো ভদ্রমহিলা বা ভদ্রলোক সম্পর্কে আমি কখনো খারাপ মন্তব্য করিনি।’ তাহলে সেই পত্রিকায় প্রতিবাদপত্র পাঠাননি কেন?—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রয়োজন মনে করিনি।’ আসলে জনসভায় উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকের কাছেই তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করা আছে। ফলে এর দায় এড়ানোর উপায় তাঁর নেই।
আসলে সময়-সুযোগমতো একেক রকম কথা বলার কর্নেল অলির স্বভাবসিদ্ধ। যেমন গত নির্বাচনের আগে জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে অনেক বিষোদগার করেছিলেন তিনি। তখন অনেকেই ধারণা করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী সংগঠনটির ওপর একজন মুক্তিযোদ্ধার এই রাগ-ক্ষোভ স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল, তাঁর লক্ষ্য জামায়াত নয়, বরং সাতকানিয়ার নির্বাচনী আসনটি। এখানে জামায়াতের সংগঠন শক্তিশালী। ফলে চারদলীয় জোটের অংশীদার হিসেবে জামায়াত এ আসনটির দাবি ছাড়তে নারাজ। ২০০১ সালে বিএনপি চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াতকে এ আসনটি ছেড়ে দিলেও অলি হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে এখানে নির্বাচন করেন। মূলত বিএনপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েনের শুরু তখন থেকেই।
বিএনপিতে গুরুত্ব হারানোর পর কিছুদিন মাঠের রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন কর্নেল অলি। তখন রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, গবেষণা-অভিসন্দর্ভ তৈরি করেছেন এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল রাজনীতির এই উচ্চতর পাঠ তাঁর মধ্যে নতুন বোধোদয় ঘটাবে, নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা ঘটবে তাঁর নেতৃত্বে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তা হয়নি। এরশাদ সরকার আমলে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন দুই নেত্রীকে ইঙ্গিত করে নানা অশ্লীল মন্তব্য করতেন। এখন আবার তিনি সেই নারীর নেতৃত্বে আস্থা রেখে বিএনপি করছেন। এতকাল পর নারী নেতৃত্ব নিয়ে কর্নেল অলির দৃষ্টিভঙ্গি, মত ও মন্তব্য সেই পুরোনো কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। সময় বদলে যায়, আমাদের রাজনীতিকেরা বদলান না।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
এই মাংস বিক্রেতা নিরক্ষর, সমাজে গুরুত্বহীন ব্যক্তি। ফলে তাঁর কথায় কান না দিলেও চলে। কিন্তু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সভা-সমাবেশে কি অহরহ এ রকম মন্তব্যই আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি না, যাতে নারী সম্পর্কে চরম অবমাননার প্রকাশ ঘটছে?
এলডিপি নেতা কর্নেল অলি আহমদ উচ্চশিক্ষিত, পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তাঁর মতো একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদকেও জনমনোরঞ্জনের একই বিকৃত পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেখলে হতাশা তৈরি হয় বৈকি!
নিজের নির্বাচনী এলাকা চন্দনাইশের এক সমাবেশে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘চন্দনাইশে একজন মহিলা এমপি দিয়ে হাজার যুবকের সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তাই টুঙ্গিপাড়া থেকে বেশি করে সুন্দরী মহিলাদের এনে চন্দনাইশে দিলে যুবসমাজের কল্যাণ হবে’ (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৯ নভেম্বর ’১১)। বোঝা যায় সংরক্ষিত আসনের স্থানীয় মহিলা সাংসদকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন কর্নেল অলি। পাশাপাশি ‘টুঙ্গিপাড়া’র কথা উল্লেখ করে তিনি কার দিকে অঙুলি নির্দেশ করেছেন তা-ও না বোঝার কোনো কারণ নেই।
এলডিপির সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রদল ও যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সমাবেশে এ কথা বলেছেন তিনি। ছাত্র ও যুবকদের নতুন যুগের রাজনীতির আদর্শ ও একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে যিনি নারী নেতৃত্বের প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিত করে সস্তা রসিকতা করতে পারেন, নারী সম্পর্কে অসম্মানের মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে উসকে দিতে পারেন, তাঁর অনুসারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
অবশ্য নারীর প্রতি কর্নেল অলির এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব নতুন কিছু না। বিএনপির এই সাবেক নেতা গত জোট সরকারের আমলে দলে গুরুত্ব হারিয়ে ও মন্ত্রিত্ব-বঞ্চিত হয়ে যখন এলডিপি গঠন করেন, তখনো তাঁর নানান বক্তৃতায় এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘মহিলার পায়ের কাছে বসে আমি রাজনীতি করতে পারব না।’ তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের দুর্নীতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেছিলেন, ‘মা ভালো হলে ছেলেরা এ রকম হবে কেন?’ এমনকি খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে এনেছেন দাবি করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমিই বেগম জিয়াকে রান্নাঘর থেকে রাজনীতিতে এনেছি, আবারও তাঁকে রান্নাঘরে ফিরে যেতে হবে।’
নিজের এসব মত ও মন্তব্য কর্নেল অলি নিশ্চয়ই ভুলে যেতে চাইবেন। কারণ এখন তিনি নিজেই ফিরে যেতে চান খালেদা জিয়ার ‘রান্নাঘরে’। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে এখন ঘন ঘন দেখা করছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে, তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতেও কোনো কুণ্ঠা নেই মনে। কিন্তু নারী নেতৃত্ব নিয়ে তাঁর মনোভাব গোপন নেই। চন্দনাইশের মহিলা সাংসদ সম্পর্কে এখন যা বলছেন, খালেদা জিয়াকে নিয়ে অন্যভাবে তা-ই বলেছিলেন। এখন খালেদা জিয়া সম্পর্কে তিনি কিছু বলছেন না তাঁর অর্থ এই নয়, যোগ্যতা ও দক্ষতার বিচারে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি তিনি অনুরক্ত বা আস্থাশীল। পুরো ব্যাপারটিই নিজের রাজনীতির ভবিষ্যতের সঙ্গে, নিজের স্বার্থচিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
নারী নেতৃত্ব নিয়ে যিনি আজ কটাক্ষ করেছেন, তিনিই একসময় নিজের জেতা আসনের উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাজ অলিকে প্রার্থী করতে দ্বিধাবোধ করেননি। ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে মমতাজ অলি যদি আবার প্রার্থী হতে চান, তখন সমর্থক-অনুসারীদের উদ্দেশে নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে যেসব কথা এখন তিনি বলছেন তা-কি বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না তাঁর দিকে?
যা-ই হোক, চন্দনাইশে অলি যেসব বক্তব্য রেখেছেন তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মামলা করেছেন আফতাব মাহমুদ (শিমুল) নামের এক তরুণ। তিনি দাবি করেছেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে কর্নেল অলি প্রধানমন্ত্রী ও মহিলা সাংসদের মর্যাদাহানির পাশাপাশি চন্দনাইশের ছাত্র-যুবকদেরও অসম্মান করেছেন। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে আসামিকে সাত দিনের মধ্যে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করেছেন। মামলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা জানি না। তবে নারী নেতৃত্ব, এমনকি সমাজের যেকোনো স্তরের নারী সম্পর্কে প্রকাশ্যে অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার বলে মনে করি।
অলির বক্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। তবে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন বা কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর মতো কর্মসূচিকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া মনে হলেও, আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর ওপর হামলার ঘটনাকে মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই। যে ঘটনা আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, তাকে এগোতে দেওয়া উচিত স্বাভাবিক গতিতেই। প্রথম আলোকে (আলোকিত চট্টগ্রাম) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অলি বলেছেন, ‘কোনো ভদ্রমহিলা বা ভদ্রলোক সম্পর্কে আমি কখনো খারাপ মন্তব্য করিনি।’ তাহলে সেই পত্রিকায় প্রতিবাদপত্র পাঠাননি কেন?—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রয়োজন মনে করিনি।’ আসলে জনসভায় উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকের কাছেই তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করা আছে। ফলে এর দায় এড়ানোর উপায় তাঁর নেই।
আসলে সময়-সুযোগমতো একেক রকম কথা বলার কর্নেল অলির স্বভাবসিদ্ধ। যেমন গত নির্বাচনের আগে জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে অনেক বিষোদগার করেছিলেন তিনি। তখন অনেকেই ধারণা করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী সংগঠনটির ওপর একজন মুক্তিযোদ্ধার এই রাগ-ক্ষোভ স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল, তাঁর লক্ষ্য জামায়াত নয়, বরং সাতকানিয়ার নির্বাচনী আসনটি। এখানে জামায়াতের সংগঠন শক্তিশালী। ফলে চারদলীয় জোটের অংশীদার হিসেবে জামায়াত এ আসনটির দাবি ছাড়তে নারাজ। ২০০১ সালে বিএনপি চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াতকে এ আসনটি ছেড়ে দিলেও অলি হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে এখানে নির্বাচন করেন। মূলত বিএনপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েনের শুরু তখন থেকেই।
বিএনপিতে গুরুত্ব হারানোর পর কিছুদিন মাঠের রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন কর্নেল অলি। তখন রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, গবেষণা-অভিসন্দর্ভ তৈরি করেছেন এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল রাজনীতির এই উচ্চতর পাঠ তাঁর মধ্যে নতুন বোধোদয় ঘটাবে, নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা ঘটবে তাঁর নেতৃত্বে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তা হয়নি। এরশাদ সরকার আমলে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন দুই নেত্রীকে ইঙ্গিত করে নানা অশ্লীল মন্তব্য করতেন। এখন আবার তিনি সেই নারীর নেতৃত্বে আস্থা রেখে বিএনপি করছেন। এতকাল পর নারী নেতৃত্ব নিয়ে কর্নেল অলির দৃষ্টিভঙ্গি, মত ও মন্তব্য সেই পুরোনো কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। সময় বদলে যায়, আমাদের রাজনীতিকেরা বদলান না।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments