জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন by সালাম সাকলাইন ও আহমেদ সুমন

আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন। সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. জিল্লুর রহমান ভাষণ দেবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের সনদপত্র প্রদান করবেন। সমাবর্তন বক্তার ভাষণ দেবেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী।
চার হাজারেরও বেশি গ্র্যাজুয়েট, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী ইতিমধ্যে সমাবর্তনে অংশগ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছেন। সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল রূপে। উৎসবের অপেক্ষায় সব কিছুতেই যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। গ্র্যাজুয়েটদের পদচারণে ক্যাম্পাস এখন মুখরিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বিশাল এলাকাজুড়ে সমাবর্তন প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান একটা উৎসবও বটে। ১৯৯৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন উপলক্ষে স্যুভেনিরে প্রকাশিত খোন্দকার মউদুদ ইলাহী ও মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমানের লেখা প্রবন্ধ 'সমাবর্তন' থেকে জানা যায় যে 'ইংরেজি Convocation-এর বাংলা আভিধানিক অর্থ সমাবর্তন বা সমাবর্তন সভা। তবে সমাবর্তনকে বাঙালির প্রাচীন উৎসব হিসেবে গণ্য করা হতো সম্ভবত বৈদিক যুগে। সেই প্রাচীন প্রথাসিদ্ধ বিষয় এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপাধিদানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। ইংল্যান্ডে কনভোকেশন বা সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উৎপত্তি ধর্মীয় আচারের মধ্য দিয়ে আনুমানিক সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে। ওই সময় অ্যাংলো-স্যাঙ্ন আমলে ইংল্যান্ডের গির্জার পুরোহিত-পাদ্রিদের ধর্মীয় শিক্ষা শেষে বিশেষ ধরনের কনভোকেশনের আয়োজন করা হতো। প্রধানত ক্যান্টারব্যারি ও ইয়র্কে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা জানা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সমাবর্তনের আচার বা সংস্কৃতি অঙ্ফোর্ড বা ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবপ্রসূত হলেও মূলত ভারতের বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েও যে সপ্তম শতাব্দীতে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হতো, তার তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত প্রাচীন পুন্ড্র, পাহাড়পুর ও ময়নামতি বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতেও সপ্তম শতাব্দীর আগে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা শুরুতে দীক্ষা গ্রহণ এবং সমাপনীতে সমাবর্তন আয়োজনের সংবাদ পাওয়া যায়।' সুতরাং সমাবর্তন যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ অনুষ্ঠান, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে। প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তখন চ্যান্সেলর ছিলেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এবং উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম চৌধুরী। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. মফিজউদ্দিন আহমদ 'বাংলাদেশে উচ্চতর বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি শিক্ষা, গবেষণা ও প্রয়োগ' শীর্ষক ভাষণ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। চ্যান্সেলর ছিলেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এবং উপাচার্য ছিলেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও কলামিস্ট অধ্যাপক আবদুল বায়েস। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (১৯৯৬) প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান। তৃতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। চ্যান্সেলর ছিলেন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এবং উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল। চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি। চ্যান্সেলর ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল হোসেন। পঞ্চম সমাবর্তন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয় ৪১ বছরে পদার্পণ করেছে। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসান আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন। তবে এর আগে ৪ জানুয়ারি অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে ক্লাস শুরু হয়। প্রথম ব্যাচে ছাত্রসংখ্যা ছিল ১৫০। ইতিহাসের এ পথপরিক্রমায় ৪১ বছর একেবারে কম সময় নয়; আবার অনেক দীর্ঘসময়ও নয়। চারটি বিভাগ ও ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, প্রতিষ্ঠার ৪১ বছরে সেই বিশ্ববিদ্যালয় আজ মহীরুহ ধারণ করেছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৩টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটে ১৫ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী এখন লেখাপড়া করছে। ছাত্রহলের সংখ্যা সাত এবং ছাত্রীহলের সংখ্যা ছয়। বর্তমানে শিক্ষকসংখ্যা ৬১৭, অফিসার ২৪৩, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ৫৯৭ এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ৭৭০ জন। ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৭ হাজার আটজন গ্র্যাজুয়েট ও ১৪ হাজার ২৫ জন স্নাতকোত্তর, ১৫৪ জন এমফিল গবেষক ও ২০০ জন পিএইচডি গবেষক তাঁদের গবেষণা সম্পন্ন করে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। প্রথম সমাবর্তনে নিবন্ধনকৃত গ্র্যাজুয়েটসংখ্যা ছিল চার হাজার ৪৮৪, দ্বিতীয় সমাবর্তনে পাঁচ হাজার ১২, তৃতীয় সমাবর্তনে চার হাজার ৩৮৩, চতুর্থ সমাবর্তনে তিন হাজার ৮৭৪, ২২ জন এমফিল এবং ৫৩ জন পিএইচডি। বিভিন্ন ট্রাস্ট ফান্ডের বৃত্তিপ্রাপ্ত ১৬ ছাত্রছাত্রীকে পঞ্চম সমাবর্তনে স্বর্ণপদক দেওয়া হবে। ৪১ বছরের পথপরিক্রমায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণাসহ অন্যান্য শিক্ষাবিষয়ক কর্মকাণ্ডে গৌরব রচনা করেছে। একটি উচ্চতর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিক যাত্রার প্রাক্কালে দেশের খ্যাতনামা শিক্ষকদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।
সরকার পরিচালনার পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক দেশ-বিদেশে সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন। অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আমির হোসেন খান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ খান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক খোন্দকার মউদুদ ইলাহী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এবং উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শিক্ষা ও সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পর জাপানের সাগা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শিক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অমর একুশ, সংশপ্তক ও দেশের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও গৌরব বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য সংশপ্তক ও ভাষা আন্দোলনের ভাস্কর্য অমর একুশ নির্মিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংশপ্তক ভাস্কর্যের ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করেছেন শিল্পী হামিদুজ্জামান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় চেতনাকে অমর একুশ ভাস্কর্যটি কংক্রিটের শরীরে জীবন্ত করেছেন শিল্পী জাহানারা পারভীন। প্রতিষ্ঠার ৪১ বছরের অগ্রযাত্রায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই তার প্রত্যাশা পূরণে ধাবমান। যে একটি মাত্র আবাসিক হল দিয়ে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানে নির্মীয়মাণ ছাত্রীদের জন্য 'শেখ হাসিনা হল' নিয়ে আবাসিক হলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩টিতে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং, আবাসিক হল, আবাসিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, গ্রন্থাগার সম্প্রসারণে কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার সম্মিলন ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের অগ্রযাত্রায় বহুমাত্রিকতা যুক্ত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে দেশ-বিদেশে, তা বলা যায়।
লেখকদ্বয় : উপ-পরিচালক, জনসংযোগ অফিস ও সহকারী পরিচালক, জনসংযোগ অফিস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
prjunews@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.