নতুন সরকারের শাসনে পশ্চিমবঙ্গ-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর
তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা ব্যানার্জি দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে যতই ব্যর্থ হবে ততই সংসদীয় রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও বিজেপির থেকে সিপিএমের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
পরবর্তী নির্বাচনে তাদের জয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়, যদিও দলগতভাবে তারা আর আগের জায়গায় ফিরে যেতে সক্ষম হবে এমন কোনো সম্ভাবনা আছে বলেও
মনে হয় না
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেসের জোট সরকারের আট মাস হলো। আট মাস কোনো সরকারের কার্যকলাপ মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট না হলেও এই সময়সীমার মধ্যে কিছুই বোঝা যায় না, এমন নয়। এ ক্ষেত্রে আসলে দেখার বিষয় হলো, কোন দিকে মুখ করে বা লক্ষ্য স্থাপন করে একটা সরকার অগ্রসর হচ্ছে। এদিক দিয়ে বলা যায় যে, বিগত আট মাসে নতুন সরকারের কার্যকলাপের মধ্যে এমন কিছু নেই যাতে মনে করা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের আমলের থেকে কোনো গুরুতর বা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।
ক্ষমতায় এসে চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যেসব কাজ করেছেন বা করে চলেছেন তার মধ্যে পরিবর্তনের কোনো প্রকৃত সম্ভাবনা নেই। যদিও পরিবর্তনের আওয়াজ তুলেই তারা ৩৪ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সিপিএস সরকারকে পরাজিত করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। নির্বাচনের সময় সব থেকে বহুল প্রচারিত আওয়াজ ছিল, 'পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন'। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ঠিক পরই আমি এখানকার সমকালসহ অন্য দুটি পত্রিকায় পরপর একই সপ্তাহে তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তার মধ্যে একটির নাম ছিল 'পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তন'। সাংবিধানিকভাবে স্বতন্ত্র হলেও আসলে তৃণমূল কংগ্রেস তো কংগ্রেস থেকে কোনো ভিন্ন চরিত্রের সংগঠন নয়। আদর্শগতভাবে এ দুই দলের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। মমতা ব্যানার্জি এবং তার বিপুল অধিকাংশ অনুসারী ও সাঙ্গপাঙ্গরা এর আগে কংগ্রেসেই ছিলেন। কংগ্রেসের মাতৃক্রোড়েই মমতা ব্যানার্জি রাজনীতিতে সাবালক হয়েছেন। কাজেই কংগ্রেসের থেকে মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র কোনো চিন্তা তার নেই। এদিক দিয়ে পার্থক্য না থাকলেও কংগ্রেসের সঙ্গে তার একটা দ্বন্দ্বের সম্পর্কও আছে ক্ষমতার ক্ষেত্রে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করলেও কংগ্রেসের সঙ্গে নানা বিষয়ে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব চলছে। বিভিন্ন এলাকায় একই সরকারভুক্ত এ দুই দলের মধ্যে মারপিট-হাঙ্গামাও হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়েছিলেন। তবে ভোটাররা শুধু তার এই প্রতিশ্রুতির দিকে তাকিয়ে তাকে ভোট দিয়েছিলেন, এমন নয়। মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতি বা তার নিজের কোনো বড় এবং উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য যে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন এটা ঠিক নয়। তাকে জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা ছিল সিপিএমের নানা ধরনের অপকর্ম।
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে টাটা ও ইন্দোনেশিয়ার সালেম গ্রুপকে কৃষকদের জমি দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই মমতা তার জনপ্রিয়তা বড় আকারে অর্জন করেন। এ দুই ক্ষেত্রে ভারতীয় বড় পুঁজি ও বিদেশি পুঁজিকে জমি দেওয়ার জন্য কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করতে গিয়েই সিপিএমের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দ্বিতীয় দফায় বিপুলভাবে জয়লাভ করা সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এ দুই ক্ষেত্রে যে গণবিরোধী নীতি গ্রহণ করেন তাতে তাদের নির্বাচনকালীন জনপ্রিয়তা প্রায় কর্পূরের মতো উবে যায়। এ দুই ক্ষেত্রে পুঁজির স্বার্থে কাজ না করলে সিপিএমের এ ধরনের বিপর্যয় নির্বাচনের সময় হতো না, যদি নির্বাচনে তাদের হারার সম্ভাবনা অন্য কারণেও সৃষ্টি হয়েছিল।
সিঙ্গুরে তিন ফসলি জমি টাটাকে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে টাটা কর্তৃক অধিকৃত জমি কৃষকদের আবার ফেরত পাইয়ে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটা পূরণ করা মমতার পক্ষে এখনও সম্ভব হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এ নিয়ে কিছু তোড়জোড় করলেও নানা আইনি জটিলতায় সে কাজ যে সহজ নয় এবং আদৌ সম্ভব কি-না সেটা এখনও নিশ্চিতভাবে বলা চলে না। কিন্তু জমি ফেরত না পাওয়া কৃষকদের মধ্যে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে কৃষকরা বিক্ষুব্ধ হতে শুরু করেছেন।
মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম ও জঙ্গলমহালে তৃণমূলের যে অবস্থান ছিল সেটাও আর আগের মতো নেই। বিশেষ করে মাওবাদীদের সঙ্গে আপস করে তিনি সেখানে নিজেদের যে অবস্থান তৈরি করেছিলেন সেটা এখন মাওবাদীদের সঙ্গে তার শুধু মতবিরোধই নয়, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের কারণেও ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ভারতীয় সরকারের সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স (সিআরপি) এবং সামরিক বাহিনী মাওবাদীদের প্রভাবিত অঞ্চল জঙ্গলমহালে যে নির্যাতন চালাত সিপিএম সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মমতা ওই অঞ্চল থেকে সিআরপি সরিয়ে নেওয়ার জন্য দাবি করেছিলেন। কিন্তু তিনি এখন সিপিএমের মতোই তাদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে ওই অঞ্চলে সিআরপি রক্ষার পক্ষেই অবস্থা গ্রহণ করেছেন। এদিক দিয়ে যেমন সিপিএম সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মতপার্থক্য বা বিরোধ ছিল না, তেমনি এখন তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা ব্যানার্জিরও কোনো মতবিরোধ বা পার্থক্য নেই। এটা না থাকার জন্য জঙ্গলমহালে মমতা ব্যানার্জির জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে এসেছে এবং সেখানে মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও সংঘর্ষ হচ্ছে। যেমন তা হতো সিপিএমের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। এর ফলে মাওবাদীদের হাতে তৃণমূলের লোকজন মারা পড়ছে। যেমন মারা পড়ত সিপিএমের লোকজন। সমগ্র মেদিনীপুর এলাকা ও জঙ্গলমহালে সিপিএমের আমলে যে পরিস্থিতি বিরাজ করত সেই পরিস্থিতিই এখন আবার নতুন করে দেখা যাচ্ছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেই কোনো সরকার তার পূর্ববর্তী সরকারের থেকে পরিস্থিতির এমন উন্নতি করতে পারে না যাতে তাদের বাহবা দেওয়া চলে।
বর্তমানে সারা পশ্চিমবঙ্গে নানা ধরনের হাঙ্গামা ও খুন-খারাবির ঘটনা ঘটছে। প্রথম দিকে তৃণমূল কর্মীরা অনেক জায়গায় সিপিএম নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও তাদের অফিস ভাংচুর করছিল। এখন সেটা কমে এসেছে। কিন্তু তৃণমূলের নিজের মধ্যেই এমন পারস্পরিক হানাহানি চলছে যাকে তারা বলেছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব! এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মূলে যে আদর্শ বলে কিছু নেই এটা বোকাকেও বোঝাবার দরকার হয় না। কংগ্রেসী আমলের চুরি-দুর্নীতি শুরু হয়ে যাওয়াই যে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মূল কারণ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছাড়া কংগ্রেসের সঙ্গেও তৃণমূলের সংঘর্ষ অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে। কংগ্রেস নেতারা প্রকাশ্য জনসভায় তৃণমূল নেতৃত্ব বিশেষত মমতা ব্যানার্জির সমালোচনা করছে। এর পাল্টা আক্রমণ ও সমালোচনা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তৃণমূল থেকেও হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, মমতা ব্যানার্জি নানাভাবে যেসব চমক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য, তার কিছু হাস্যকর দিকও আছে। কলকাতা, বর্ধমানসহ বড় শহরগুলোতে রাস্তায় লাল ট্রাফিক লাইট জ্বললেই শুরু হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীত! রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষকে আনন্দ দেয়, কিন্তু ট্রাফিক লাইট ঘন ঘন রবীন্দ্রসঙ্গীত চারপাশের আওয়াজের সঙ্গে মিশে যা সৃষ্টি করছে সেটা এক ধরনের শব্দদূষণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এই পর্যায়ে নামিয়ে এনে মমতা ব্যানার্জি সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করলেও জনগণের মধ্যে এর বিরুদ্ধে সমালোচনা খুব ব্যাপক। এটাকে শুধু বিরক্তিকর নয়, হাস্যকর ব্যাপার হিসেবেই লোকজন দেখছে। এ ধরনের অন্য অনেক কিছুই মমতা ব্যানার্জি করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সল্ট লেকে পানির ট্যাঙ্কগুলো দিয়েই পুরো অঞ্চলের একটা ঠিকানা বোঝা লোকের জন্য সুবিধা হয়। এই ট্যাঙ্কগুলো ১/২/১০/১১ ইত্যাদি নম্বরের দ্বারাই চিহ্নিত। এখন মমতা ব্যানার্জি ট্যাঙ্কগুলোর নামকরণ করেছেন। ৯ নম্বর ট্যাঙ্কের নাম দিয়েছেন 'বিদ্যাসাগর জলাধার'! ৮ নম্বর ট্যাঙ্কের নাম দিয়েছেন 'রামকৃষ্ণ জলাধার'! পানির ট্যাঙ্কের এভাবে নামকরণ এক হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কী? জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য এসব কাজ করলেও এর ফল উল্টোই হচ্ছে। জনগণ এর থেকে বুঝতে পারছে যে, কতকগুলো খেলো কাজ করে চমক সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে মমতা ব্যানার্জি জনপ্রিয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া আরও অনেক বিষয় আছে যার বিস্তারিত আলোচনা বা উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। এসবের ফলে যে বামপন্থি লেখক-বুদ্ধিজীবীরা মমতা ব্যানার্জির পক্ষে গিয়েছিলেন তারাও একে একে পক্ষ ত্যাগ করে আবার সিপিএমের সমর্থক না হলেও তৃণমূল থেকে সরে যাচ্ছেন এবং তার সমালোচনা প্রকাশ্যেই করছেন।
কিন্তু এসব থেকে মনে করার কিছু নেই যে, সিপিএম নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কোনো প্রকৃত শিক্ষা লাভ করেছে অথবা যে মার্কসবাদ পরিত্যাগ করে তারা দেশ শাসন করেছে সেই মার্কসবাদের দিকে ফেরার কোনো চেষ্টা তারা করছে। উপরন্তু তারা সম্প্রতি তাদের এক সর্বভারতীয় বৈঠকে নতুন যে কর্মসূচি উপস্থিত করেছে তার মধ্যে পুঁজিবাদ ছাড়া আর কিছু নেই। তবে মার্কসবাদ বর্জন করলেও পুঁজিবাদী পথ অনুসরণকারী সিপিএম ধীরে ধীরে তার অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টায় নিযুক্ত আছে। তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা ব্যানার্জি দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে যতই ব্যর্থ হবে ততই সংসদীয় রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও বিজেপির থেকে সিপিএমের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। পরবর্তী নির্বাচনে তাদের জয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়, যদিও দলগতভাবে তারা আর আগের জায়গায় ফিরে যেতে সক্ষম হবে এমন কোনো সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না।
৬.২.২০১২
মনে হয় না
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেসের জোট সরকারের আট মাস হলো। আট মাস কোনো সরকারের কার্যকলাপ মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট না হলেও এই সময়সীমার মধ্যে কিছুই বোঝা যায় না, এমন নয়। এ ক্ষেত্রে আসলে দেখার বিষয় হলো, কোন দিকে মুখ করে বা লক্ষ্য স্থাপন করে একটা সরকার অগ্রসর হচ্ছে। এদিক দিয়ে বলা যায় যে, বিগত আট মাসে নতুন সরকারের কার্যকলাপের মধ্যে এমন কিছু নেই যাতে মনে করা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের আমলের থেকে কোনো গুরুতর বা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।
ক্ষমতায় এসে চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যেসব কাজ করেছেন বা করে চলেছেন তার মধ্যে পরিবর্তনের কোনো প্রকৃত সম্ভাবনা নেই। যদিও পরিবর্তনের আওয়াজ তুলেই তারা ৩৪ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সিপিএস সরকারকে পরাজিত করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। নির্বাচনের সময় সব থেকে বহুল প্রচারিত আওয়াজ ছিল, 'পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন'। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ঠিক পরই আমি এখানকার সমকালসহ অন্য দুটি পত্রিকায় পরপর একই সপ্তাহে তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তার মধ্যে একটির নাম ছিল 'পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তন'। সাংবিধানিকভাবে স্বতন্ত্র হলেও আসলে তৃণমূল কংগ্রেস তো কংগ্রেস থেকে কোনো ভিন্ন চরিত্রের সংগঠন নয়। আদর্শগতভাবে এ দুই দলের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। মমতা ব্যানার্জি এবং তার বিপুল অধিকাংশ অনুসারী ও সাঙ্গপাঙ্গরা এর আগে কংগ্রেসেই ছিলেন। কংগ্রেসের মাতৃক্রোড়েই মমতা ব্যানার্জি রাজনীতিতে সাবালক হয়েছেন। কাজেই কংগ্রেসের থেকে মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র কোনো চিন্তা তার নেই। এদিক দিয়ে পার্থক্য না থাকলেও কংগ্রেসের সঙ্গে তার একটা দ্বন্দ্বের সম্পর্কও আছে ক্ষমতার ক্ষেত্রে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করলেও কংগ্রেসের সঙ্গে নানা বিষয়ে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব চলছে। বিভিন্ন এলাকায় একই সরকারভুক্ত এ দুই দলের মধ্যে মারপিট-হাঙ্গামাও হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়েছিলেন। তবে ভোটাররা শুধু তার এই প্রতিশ্রুতির দিকে তাকিয়ে তাকে ভোট দিয়েছিলেন, এমন নয়। মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতি বা তার নিজের কোনো বড় এবং উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য যে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন এটা ঠিক নয়। তাকে জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা ছিল সিপিএমের নানা ধরনের অপকর্ম।
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে টাটা ও ইন্দোনেশিয়ার সালেম গ্রুপকে কৃষকদের জমি দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই মমতা তার জনপ্রিয়তা বড় আকারে অর্জন করেন। এ দুই ক্ষেত্রে ভারতীয় বড় পুঁজি ও বিদেশি পুঁজিকে জমি দেওয়ার জন্য কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করতে গিয়েই সিপিএমের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দ্বিতীয় দফায় বিপুলভাবে জয়লাভ করা সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এ দুই ক্ষেত্রে যে গণবিরোধী নীতি গ্রহণ করেন তাতে তাদের নির্বাচনকালীন জনপ্রিয়তা প্রায় কর্পূরের মতো উবে যায়। এ দুই ক্ষেত্রে পুঁজির স্বার্থে কাজ না করলে সিপিএমের এ ধরনের বিপর্যয় নির্বাচনের সময় হতো না, যদি নির্বাচনে তাদের হারার সম্ভাবনা অন্য কারণেও সৃষ্টি হয়েছিল।
সিঙ্গুরে তিন ফসলি জমি টাটাকে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে টাটা কর্তৃক অধিকৃত জমি কৃষকদের আবার ফেরত পাইয়ে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটা পূরণ করা মমতার পক্ষে এখনও সম্ভব হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এ নিয়ে কিছু তোড়জোড় করলেও নানা আইনি জটিলতায় সে কাজ যে সহজ নয় এবং আদৌ সম্ভব কি-না সেটা এখনও নিশ্চিতভাবে বলা চলে না। কিন্তু জমি ফেরত না পাওয়া কৃষকদের মধ্যে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে কৃষকরা বিক্ষুব্ধ হতে শুরু করেছেন।
মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম ও জঙ্গলমহালে তৃণমূলের যে অবস্থান ছিল সেটাও আর আগের মতো নেই। বিশেষ করে মাওবাদীদের সঙ্গে আপস করে তিনি সেখানে নিজেদের যে অবস্থান তৈরি করেছিলেন সেটা এখন মাওবাদীদের সঙ্গে তার শুধু মতবিরোধই নয়, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের কারণেও ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ভারতীয় সরকারের সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স (সিআরপি) এবং সামরিক বাহিনী মাওবাদীদের প্রভাবিত অঞ্চল জঙ্গলমহালে যে নির্যাতন চালাত সিপিএম সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মমতা ওই অঞ্চল থেকে সিআরপি সরিয়ে নেওয়ার জন্য দাবি করেছিলেন। কিন্তু তিনি এখন সিপিএমের মতোই তাদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে ওই অঞ্চলে সিআরপি রক্ষার পক্ষেই অবস্থা গ্রহণ করেছেন। এদিক দিয়ে যেমন সিপিএম সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মতপার্থক্য বা বিরোধ ছিল না, তেমনি এখন তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা ব্যানার্জিরও কোনো মতবিরোধ বা পার্থক্য নেই। এটা না থাকার জন্য জঙ্গলমহালে মমতা ব্যানার্জির জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে এসেছে এবং সেখানে মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও সংঘর্ষ হচ্ছে। যেমন তা হতো সিপিএমের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। এর ফলে মাওবাদীদের হাতে তৃণমূলের লোকজন মারা পড়ছে। যেমন মারা পড়ত সিপিএমের লোকজন। সমগ্র মেদিনীপুর এলাকা ও জঙ্গলমহালে সিপিএমের আমলে যে পরিস্থিতি বিরাজ করত সেই পরিস্থিতিই এখন আবার নতুন করে দেখা যাচ্ছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেই কোনো সরকার তার পূর্ববর্তী সরকারের থেকে পরিস্থিতির এমন উন্নতি করতে পারে না যাতে তাদের বাহবা দেওয়া চলে।
বর্তমানে সারা পশ্চিমবঙ্গে নানা ধরনের হাঙ্গামা ও খুন-খারাবির ঘটনা ঘটছে। প্রথম দিকে তৃণমূল কর্মীরা অনেক জায়গায় সিপিএম নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও তাদের অফিস ভাংচুর করছিল। এখন সেটা কমে এসেছে। কিন্তু তৃণমূলের নিজের মধ্যেই এমন পারস্পরিক হানাহানি চলছে যাকে তারা বলেছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব! এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মূলে যে আদর্শ বলে কিছু নেই এটা বোকাকেও বোঝাবার দরকার হয় না। কংগ্রেসী আমলের চুরি-দুর্নীতি শুরু হয়ে যাওয়াই যে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মূল কারণ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছাড়া কংগ্রেসের সঙ্গেও তৃণমূলের সংঘর্ষ অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে। কংগ্রেস নেতারা প্রকাশ্য জনসভায় তৃণমূল নেতৃত্ব বিশেষত মমতা ব্যানার্জির সমালোচনা করছে। এর পাল্টা আক্রমণ ও সমালোচনা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তৃণমূল থেকেও হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, মমতা ব্যানার্জি নানাভাবে যেসব চমক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য, তার কিছু হাস্যকর দিকও আছে। কলকাতা, বর্ধমানসহ বড় শহরগুলোতে রাস্তায় লাল ট্রাফিক লাইট জ্বললেই শুরু হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীত! রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষকে আনন্দ দেয়, কিন্তু ট্রাফিক লাইট ঘন ঘন রবীন্দ্রসঙ্গীত চারপাশের আওয়াজের সঙ্গে মিশে যা সৃষ্টি করছে সেটা এক ধরনের শব্দদূষণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এই পর্যায়ে নামিয়ে এনে মমতা ব্যানার্জি সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করলেও জনগণের মধ্যে এর বিরুদ্ধে সমালোচনা খুব ব্যাপক। এটাকে শুধু বিরক্তিকর নয়, হাস্যকর ব্যাপার হিসেবেই লোকজন দেখছে। এ ধরনের অন্য অনেক কিছুই মমতা ব্যানার্জি করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সল্ট লেকে পানির ট্যাঙ্কগুলো দিয়েই পুরো অঞ্চলের একটা ঠিকানা বোঝা লোকের জন্য সুবিধা হয়। এই ট্যাঙ্কগুলো ১/২/১০/১১ ইত্যাদি নম্বরের দ্বারাই চিহ্নিত। এখন মমতা ব্যানার্জি ট্যাঙ্কগুলোর নামকরণ করেছেন। ৯ নম্বর ট্যাঙ্কের নাম দিয়েছেন 'বিদ্যাসাগর জলাধার'! ৮ নম্বর ট্যাঙ্কের নাম দিয়েছেন 'রামকৃষ্ণ জলাধার'! পানির ট্যাঙ্কের এভাবে নামকরণ এক হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কী? জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য এসব কাজ করলেও এর ফল উল্টোই হচ্ছে। জনগণ এর থেকে বুঝতে পারছে যে, কতকগুলো খেলো কাজ করে চমক সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে মমতা ব্যানার্জি জনপ্রিয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া আরও অনেক বিষয় আছে যার বিস্তারিত আলোচনা বা উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। এসবের ফলে যে বামপন্থি লেখক-বুদ্ধিজীবীরা মমতা ব্যানার্জির পক্ষে গিয়েছিলেন তারাও একে একে পক্ষ ত্যাগ করে আবার সিপিএমের সমর্থক না হলেও তৃণমূল থেকে সরে যাচ্ছেন এবং তার সমালোচনা প্রকাশ্যেই করছেন।
কিন্তু এসব থেকে মনে করার কিছু নেই যে, সিপিএম নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কোনো প্রকৃত শিক্ষা লাভ করেছে অথবা যে মার্কসবাদ পরিত্যাগ করে তারা দেশ শাসন করেছে সেই মার্কসবাদের দিকে ফেরার কোনো চেষ্টা তারা করছে। উপরন্তু তারা সম্প্রতি তাদের এক সর্বভারতীয় বৈঠকে নতুন যে কর্মসূচি উপস্থিত করেছে তার মধ্যে পুঁজিবাদ ছাড়া আর কিছু নেই। তবে মার্কসবাদ বর্জন করলেও পুঁজিবাদী পথ অনুসরণকারী সিপিএম ধীরে ধীরে তার অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টায় নিযুক্ত আছে। তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা ব্যানার্জি দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে যতই ব্যর্থ হবে ততই সংসদীয় রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও বিজেপির থেকে সিপিএমের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। পরবর্তী নির্বাচনে তাদের জয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়, যদিও দলগতভাবে তারা আর আগের জায়গায় ফিরে যেতে সক্ষম হবে এমন কোনো সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না।
৬.২.২০১২
No comments