বদলে যাওয়ার তাগিদ-রাজনীতি by সিরাজউদদীন আহমেদ
বিরোধী দলকে সংসদে গিয়ে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পেশ করতে হবে। হরতাল বাদ দিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। মহাজোট সরকারকে অবিলম্বে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতির ঝুঁকি দূর করা, মন্ত্রিসভা থেকে অযোগ্য মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া, মহাজোট সহযোগী দল থেকে মন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। দলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে, আগামী দুই বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত করতে হবে
দৈনিক সমকাল পত্রিকা ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি মহাজোট সরকারের তিন বছরের সফলতা ও ব্যর্থতা-সরকার ও বিরোধী দলের করণীয় সম্পর্কে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এ জরিপ ছিল সময়োপযোগী, তথ্যবহুল এবং উভয় দলের প্রতি সতর্কবার্তা। সমকাল স্বল্প সময় ও স্বল্পপরিসরে তারা সরকারের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে_ তারা জনগণের কথা বলছে, তারা হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, 'তীর থেকে দূরের প্রত্যাশার তরী।' সরকারের মাত্র দুই বছর অবশিষ্ট আছে। এই দু'বছরে কয়েকটি করণীয় নির্ধারণ করেছে জনগণ। জরিপের যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা সঠিক হবে না। ৬৪ জেলা ও ৩৫১টি উপজেলায় জরিপ চালানো হয়। জরিপের সময়কাল ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস। দৈনিক সমকাল সমগ্র জাতিমনের কথা, প্রাণের কথা প্রকাশ করেছে। জাতি সমকালের প্রতি কৃতজ্ঞ। পত্রিকার পেশা ঊধর্ে্ব উঠে দেশের কল্যাণে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। আমার মনে হয়, বিরোধী দলের চেয়ে সরকারি দলকে জরিপ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। জরিপকে টক শো হিসেবে গণ্য না করে তাদের প্রতি হুশিয়ারি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ৬৫ জন বলেছেন, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র চর্চা নেই। আওয়ামী লীগ ৬০ বছরের পুরনো দল। দলের গণতন্ত্র নেই। দলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দল ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই। দলের মুখপাত্র হিসেবে যুগ্ম সচিব কথা বলছেন, কিন্তু তার পরিচিতি নেই। দলের ত্যাগী নেতাদের সুকৌশলে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। এক বুক ভরা ব্যথা নিয়ে বিদায় নিয়েছেন জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক। দলের জেলা ও উপজেলা কমিটি নেই, বছরের পর বছর একই কমিটি চলছে।
জরিপের সুপারিশ অনুসারে অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করা উচিত।
সংসদ কার্যকর করার জন্য সরকারি দল দায়িত্ব পালন করছে না। কোনো আলোচনার সুযোগ না দিয়ে তারা কণ্ঠভোটে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ও ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগের বিল কণ্ঠভোটে পাস করেছে। বিরোধী দল সংসদে আসছে না। তাদের অব্যাহত অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।
মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভাকে নিয়ে গত দুই বছরে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। বাণিজ্যমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর দফতর বদল হয়েছে। কিন্তু তাদের বাদ দেওয়া হয়নি। ফলে যে দল ও দেশের ক্ষতি হয়েছে তা সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। জরিপের ৫১ ভাগ মন্ত্রিসভার রদবদল চেয়েছে, ৩৪ ভাগ আংশিক পরিবর্তন চেয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৮৬ ভাগ উত্তরদাতা মন্ত্রিসভা রদবদল চেয়েছে। জরিপের ফলে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান মন্ত্রিসভার ওপর অনাস্থা দিয়েছে জনগণ। জনগণের বিশাল বিজয়কে অদক্ষ মন্ত্রিসভা ধ্বংস করতে পারে না। বাণিজ্যমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে, যোগাযোগমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণে ও অর্থমন্ত্রী অর্থনীতির ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য অর্থমন্ত্রী অনেকটা দায়ী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনেকেই সমালোচনা করছে। তিনি ক্রসফায়ার, গুম-হত্যা বন্ধ করতে পারেননি। মন্ত্রিসভার কয়েকজন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী। আগামী নির্বাচনে যদি মহাজোট সরকার জয়লাভ করতে চায় তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে অবিলম্বে মন্ত্রিসভার অযোগ্য মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে দলের সিনিয়র ও জোটের নেতাদের নিয়ে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। শরিক দলকে মন্ত্রিসভায় যথাযথ মর্যাদায় রাখতে হবে। জাপার সভাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। তার দলকে মর্যাদা দিতে হবে।
জরিপে সরকারের বিদ্যুৎ ও শিক্ষা খাতে সফলতার চিত্র ফুটে উঠেছে। এই দুটি খাতে সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা সব সফলতা ম্লান করেছে। দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছে ৮৩ ভাগ উত্তরদাতা। তবে আশার কথা, দেশের মানুষ এখনও শেখ হাসিনার ওপর আস্থা আছে। ৮ ভাগ লোক বলছে, তিনি খুব ভালো করছেন, ৪২ ভাগ বলছে, ভালো করছেন, ৫০ ভাগ লোক বলছে, তিনি ভালো করছেন, ৩৬ ভাগ লোক বলছে, তিনি ভালো করছেন না। প্রধানমন্ত্রী কাজের মূল্যায়নের পক্ষে ৫০ ভাগ লোকের আস্থা আছে। অনেক ব্যর্থতার মধ্যে ৫০ ভাগ লোক বলছে, তিনি ভালো করছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি মানুষের এখনও আস্থা আছে, এখনও সময় দুই বছর। এই সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
সরকারি দলের করণীয় :মানুষ একটু ভালো থাকতে চায়। কিন্তু প্রধান সমস্যা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। দরিদ্র লোকের জন্য বিনামূল্যে, অর্ধেক স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। কাজের বিনিময়ে খাদ্যের কর্মসূচিতে তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ে দলের কর্মীরা দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি করছে, নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
বিদ্যুৎ খাতে আঁধার দূর হচ্ছে। সরকারকে ধন্যবাদ। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আগাম বলেছেন, আরও তিনবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হবে। অর্থমন্ত্রীর লাগামহীন কথায় জাতি ক্ষুব্ধ। তিনি যে অর্থনীতিবিদ না, তা তিনি বারবার প্রমাণ করছেন। তাকে অবশ্য বিদায় দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারের সাফল্যে ধ্বংস করছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কালো হাত প্রত্যেক দফতরে থাবা দিচ্ছে। ৪৪ ভাগ উত্তরদাতা বলছে, দুর্নীতি বেড়েছে, তেমন বাড়েনি ৩৪ ভাগ। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর একডজন উপদেষ্টা রয়েছেন। তারা কী করছেন তা কেউ জানেন না। উপদেষ্টা এইচটি ইমামকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। তিনি জনপ্রশাসনকে দুর্বল করে রেখেছেন। জনপ্রশাসনের অনেকের পদোন্নতি হয়েছে, অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারের নির্বাচনী ই্যশতেহার বাস্তবায়নে প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পদোন্নতি, বিদেশ গমন ও বাড়িঘর নির্মাণ ছাড়া আমলাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই। উপদেষ্টা গহর রিজভীকে কেউ চেনে না, দেশের সঙ্গে সম্পর্কহীন উপদেষ্টাকে দিয়ে তিস্তা নদীর পানির সমস্যা সমাধান হবে না। জনপ্রতিনিধি এবং জনপ্রিয় নেতারা একমাত্র টিপাইমুখ বাঁধসহ তিস্তা নদীর সমস্যা সমাধান করতে পারবে বলে মনে করি। তিন বছরের উপদেষ্টাদের কাজের মূল্যায়ন করে বিদায় দেওয়া উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে অগ্রগতি প্রশংসনীয় ৫৬ ভাগ উত্তরদাতা অগ্রগতিতে হ্যাঁ বলেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু তাকে মিথ্যা অভিমানের ঊধর্ে্ব উঠে নতুন মন্ত্রিসভা, জনমুখী প্রশাসন ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনপ্রশাসন স্থবির, সরকারি প্রশাসনে গতি আনতে পারেনি। জনপ্রশাসন উপদেষ্টা প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে অযোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রশাসন চালাচ্ছেন। সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রশাসন আন্তরিক নয়। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দিয়ে সুবিধাবাদীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য একদল দক্ষ নিবেদিত কর্মকর্তা প্রয়োজন। সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা। শিক্ষানীতি প্রশংসিত হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য স্থায়ী শিক্ষা, শিক্ষক কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়নের জন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
সমকালের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত জরিপের ভিত্তিতে বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্তের বাস্তবমুখী বিশেল্গষণের আলোকে সরকার ও বিরোধী দলের তাদের করণীয় সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা বাঞ্ছনীয়। বিরোধী দলকে সংসদে গিয়ে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পেশ করতে হবে। হরতাল বাদ দিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। মহাজোট সরকারকে অবিলম্বে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতির ঝুঁকি দূর করা, মন্ত্রিসভা থেকে অযোগ্য মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া, মহাজোট সহযোগী দল থেকে মন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। দলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে, আগামী দুই বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত করতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট মুক্তিযুদ্ধের শক্তি নয়, কাজেই মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে ক্ষমতায় পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাকে সকল সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে নিজ দলের ঐক্য সুদূর করতে হবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করে জনগণের হারানো আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এসব কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে করতে হবে। কারণ তিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী, তিনি দলের নেতা, সংসদ নেতা, তিনি প্রধানমন্ত্রী।
সিরাজউদদীন আহমেদ :সাবেক সচিব
দৈনিক সমকাল পত্রিকা ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি মহাজোট সরকারের তিন বছরের সফলতা ও ব্যর্থতা-সরকার ও বিরোধী দলের করণীয় সম্পর্কে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এ জরিপ ছিল সময়োপযোগী, তথ্যবহুল এবং উভয় দলের প্রতি সতর্কবার্তা। সমকাল স্বল্প সময় ও স্বল্পপরিসরে তারা সরকারের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে_ তারা জনগণের কথা বলছে, তারা হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, 'তীর থেকে দূরের প্রত্যাশার তরী।' সরকারের মাত্র দুই বছর অবশিষ্ট আছে। এই দু'বছরে কয়েকটি করণীয় নির্ধারণ করেছে জনগণ। জরিপের যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা সঠিক হবে না। ৬৪ জেলা ও ৩৫১টি উপজেলায় জরিপ চালানো হয়। জরিপের সময়কাল ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস। দৈনিক সমকাল সমগ্র জাতিমনের কথা, প্রাণের কথা প্রকাশ করেছে। জাতি সমকালের প্রতি কৃতজ্ঞ। পত্রিকার পেশা ঊধর্ে্ব উঠে দেশের কল্যাণে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। আমার মনে হয়, বিরোধী দলের চেয়ে সরকারি দলকে জরিপ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। জরিপকে টক শো হিসেবে গণ্য না করে তাদের প্রতি হুশিয়ারি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ৬৫ জন বলেছেন, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র চর্চা নেই। আওয়ামী লীগ ৬০ বছরের পুরনো দল। দলের গণতন্ত্র নেই। দলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দল ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই। দলের মুখপাত্র হিসেবে যুগ্ম সচিব কথা বলছেন, কিন্তু তার পরিচিতি নেই। দলের ত্যাগী নেতাদের সুকৌশলে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। এক বুক ভরা ব্যথা নিয়ে বিদায় নিয়েছেন জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক। দলের জেলা ও উপজেলা কমিটি নেই, বছরের পর বছর একই কমিটি চলছে।
জরিপের সুপারিশ অনুসারে অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করা উচিত।
সংসদ কার্যকর করার জন্য সরকারি দল দায়িত্ব পালন করছে না। কোনো আলোচনার সুযোগ না দিয়ে তারা কণ্ঠভোটে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ও ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগের বিল কণ্ঠভোটে পাস করেছে। বিরোধী দল সংসদে আসছে না। তাদের অব্যাহত অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।
মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভাকে নিয়ে গত দুই বছরে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। বাণিজ্যমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর দফতর বদল হয়েছে। কিন্তু তাদের বাদ দেওয়া হয়নি। ফলে যে দল ও দেশের ক্ষতি হয়েছে তা সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। জরিপের ৫১ ভাগ মন্ত্রিসভার রদবদল চেয়েছে, ৩৪ ভাগ আংশিক পরিবর্তন চেয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৮৬ ভাগ উত্তরদাতা মন্ত্রিসভা রদবদল চেয়েছে। জরিপের ফলে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান মন্ত্রিসভার ওপর অনাস্থা দিয়েছে জনগণ। জনগণের বিশাল বিজয়কে অদক্ষ মন্ত্রিসভা ধ্বংস করতে পারে না। বাণিজ্যমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে, যোগাযোগমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণে ও অর্থমন্ত্রী অর্থনীতির ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য অর্থমন্ত্রী অনেকটা দায়ী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনেকেই সমালোচনা করছে। তিনি ক্রসফায়ার, গুম-হত্যা বন্ধ করতে পারেননি। মন্ত্রিসভার কয়েকজন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী। আগামী নির্বাচনে যদি মহাজোট সরকার জয়লাভ করতে চায় তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে অবিলম্বে মন্ত্রিসভার অযোগ্য মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে দলের সিনিয়র ও জোটের নেতাদের নিয়ে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। শরিক দলকে মন্ত্রিসভায় যথাযথ মর্যাদায় রাখতে হবে। জাপার সভাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। তার দলকে মর্যাদা দিতে হবে।
জরিপে সরকারের বিদ্যুৎ ও শিক্ষা খাতে সফলতার চিত্র ফুটে উঠেছে। এই দুটি খাতে সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা সব সফলতা ম্লান করেছে। দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছে ৮৩ ভাগ উত্তরদাতা। তবে আশার কথা, দেশের মানুষ এখনও শেখ হাসিনার ওপর আস্থা আছে। ৮ ভাগ লোক বলছে, তিনি খুব ভালো করছেন, ৪২ ভাগ বলছে, ভালো করছেন, ৫০ ভাগ লোক বলছে, তিনি ভালো করছেন, ৩৬ ভাগ লোক বলছে, তিনি ভালো করছেন না। প্রধানমন্ত্রী কাজের মূল্যায়নের পক্ষে ৫০ ভাগ লোকের আস্থা আছে। অনেক ব্যর্থতার মধ্যে ৫০ ভাগ লোক বলছে, তিনি ভালো করছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি মানুষের এখনও আস্থা আছে, এখনও সময় দুই বছর। এই সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
সরকারি দলের করণীয় :মানুষ একটু ভালো থাকতে চায়। কিন্তু প্রধান সমস্যা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। দরিদ্র লোকের জন্য বিনামূল্যে, অর্ধেক স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। কাজের বিনিময়ে খাদ্যের কর্মসূচিতে তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ে দলের কর্মীরা দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি করছে, নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
বিদ্যুৎ খাতে আঁধার দূর হচ্ছে। সরকারকে ধন্যবাদ। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আগাম বলেছেন, আরও তিনবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হবে। অর্থমন্ত্রীর লাগামহীন কথায় জাতি ক্ষুব্ধ। তিনি যে অর্থনীতিবিদ না, তা তিনি বারবার প্রমাণ করছেন। তাকে অবশ্য বিদায় দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারের সাফল্যে ধ্বংস করছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কালো হাত প্রত্যেক দফতরে থাবা দিচ্ছে। ৪৪ ভাগ উত্তরদাতা বলছে, দুর্নীতি বেড়েছে, তেমন বাড়েনি ৩৪ ভাগ। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর একডজন উপদেষ্টা রয়েছেন। তারা কী করছেন তা কেউ জানেন না। উপদেষ্টা এইচটি ইমামকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। তিনি জনপ্রশাসনকে দুর্বল করে রেখেছেন। জনপ্রশাসনের অনেকের পদোন্নতি হয়েছে, অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারের নির্বাচনী ই্যশতেহার বাস্তবায়নে প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পদোন্নতি, বিদেশ গমন ও বাড়িঘর নির্মাণ ছাড়া আমলাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই। উপদেষ্টা গহর রিজভীকে কেউ চেনে না, দেশের সঙ্গে সম্পর্কহীন উপদেষ্টাকে দিয়ে তিস্তা নদীর পানির সমস্যা সমাধান হবে না। জনপ্রতিনিধি এবং জনপ্রিয় নেতারা একমাত্র টিপাইমুখ বাঁধসহ তিস্তা নদীর সমস্যা সমাধান করতে পারবে বলে মনে করি। তিন বছরের উপদেষ্টাদের কাজের মূল্যায়ন করে বিদায় দেওয়া উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে অগ্রগতি প্রশংসনীয় ৫৬ ভাগ উত্তরদাতা অগ্রগতিতে হ্যাঁ বলেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু তাকে মিথ্যা অভিমানের ঊধর্ে্ব উঠে নতুন মন্ত্রিসভা, জনমুখী প্রশাসন ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনপ্রশাসন স্থবির, সরকারি প্রশাসনে গতি আনতে পারেনি। জনপ্রশাসন উপদেষ্টা প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে অযোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রশাসন চালাচ্ছেন। সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রশাসন আন্তরিক নয়। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দিয়ে সুবিধাবাদীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য একদল দক্ষ নিবেদিত কর্মকর্তা প্রয়োজন। সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা। শিক্ষানীতি প্রশংসিত হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য স্থায়ী শিক্ষা, শিক্ষক কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়নের জন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
সমকালের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত জরিপের ভিত্তিতে বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্তের বাস্তবমুখী বিশেল্গষণের আলোকে সরকার ও বিরোধী দলের তাদের করণীয় সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা বাঞ্ছনীয়। বিরোধী দলকে সংসদে গিয়ে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পেশ করতে হবে। হরতাল বাদ দিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। মহাজোট সরকারকে অবিলম্বে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতির ঝুঁকি দূর করা, মন্ত্রিসভা থেকে অযোগ্য মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া, মহাজোট সহযোগী দল থেকে মন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। দলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে, আগামী দুই বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত করতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট মুক্তিযুদ্ধের শক্তি নয়, কাজেই মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে ক্ষমতায় পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাকে সকল সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে নিজ দলের ঐক্য সুদূর করতে হবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করে জনগণের হারানো আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এসব কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে করতে হবে। কারণ তিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী, তিনি দলের নেতা, সংসদ নেতা, তিনি প্রধানমন্ত্রী।
সিরাজউদদীন আহমেদ :সাবেক সচিব
No comments