সিঙ্গাপুরের দুই ডানা চীন ও ভারত-সাক্ষাৎকার by লি সিয়েন লুং

সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে যোগদানের সময় সিএনএনের সাংবাদিক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ফরিদ জাকারিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে চীন সম্পর্কে তার উপলব্ধি তুলে ধরেন।


লি গত সপ্তাহে পারমাণবিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এলে তিনি চার্লি রোজের সঙ্গে এক ঘণ্টার এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। সেখানেও তিনি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে চীন ও ভারত সম্পর্কে আলোকপাত করেন। সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে পত্রস্থ করা হলো। ওয়েব থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা

ফরিদ জাকারিয়া : চীন পরিবর্তিত হচ্ছে, তাই তার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, এ ধরনের একটা কথা আপনি বলেছিলেন। এটা বলতে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
লি সিয়েন লুং : চীনের গত ২০ বছরের অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে উলি্লখিত সময়ের মধ্যে সেখানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আপনি হয়তো মনে করতে পারেন যে, সেখানে যেহেতু এখনও কমিউনিস্ট পার্টিই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে, তাই এটা একটা চলমানতা মাত্র। কিন্তু মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বিশ্ব সম্পর্কে জানা, বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিভিন্ন স্বার্থগ্রুপকে অকমোডেট করা, কী ঘটছে তা জানা_ এসব বিষয়ে পরিবর্তন ঘটেছে। ২০ বছর আগের চীনের চেয়ে বর্তমানের চীন অনেকটাই আলাদা।
১০ বছর আগেকার সিঙ্গাপুরের চেয়ে এখনকার সিঙ্গাপুর অনেকটাই ভিন্ন। আরও ১০ বছর পর সিঙ্গাপুরের অবস্থায় আরও ভিন্নতা আসবে।
জাকারিয়া : চীন কি এশিয়ায় প্রবল শক্তি হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে? প্রত্যেক পরাশক্তি বা বড় দেশকে একে অপরকে কিছুটা হলেও সতর্ক সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় এটা প্রযোজ্য। যুদ্ধের পর ৬০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রয়েছে, এখনও তাদের এখানে অভিনন্দন জানানো হয় এবং এখনও তাদের সহায়ক বলে বিবেচনা করা হয়। চীনকে পরাশক্তি হয়ে ওঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।
জাকারিয়া : চীনের ভেতরে সে ধরনের আপসমূলক অ্যাপ্রোচ বনাম আরও কট্টরপন্থি অ্যাপ্রোচ কি এ মুহূর্তে শক্তি অর্জন করছে নাকি দুর্বল হচ্ছে?
লি : আমি মনে করি, যে প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেছে, যারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তারা এর সীমাবদ্ধতা বুঝবে এবং চীন কী করে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভালো থাকবে সেটা উপলব্ধি করবে, তারা বিদেশের ব্যাপারে বেশি জড়িত হতে চাইবে না। যে প্রজন্ম চীনের সমৃদ্ধি ও উত্থানের মধ্যে বেড়ে উঠেছে, তারা অনেক কিছু নিয়েই গর্ব করতে পারে। দ্রুতগামী ট্রেন, অলিম্পিক গেমস আয়োজন, মহাশূন্যে হাঁটা_ আরও অনেক সাফল্য তাদের সামনে আছে।
চার্লি রোজ :চীন এবং ভবিষ্যৎ নেতারা বর্তমান নেতাদের থেকে কতটা ভিন্ন হবে?
লি :চীনের ভবিষ্যৎ নেতারা হয়তোবা সাংস্কৃতিক বিপ্লব-পরবর্তী প্রজন্মের হবেন।...
মানুষও অনেক বেশি খবরাখবর জানে। ভবিষ্যতে চীনের বিভিন্ন অংশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেবে। তখন তারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে যাবে না, বরং তারা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা রাজনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক খুঁজে নেবে। আর এটাই চীনের নেতৃত্বের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
রোজ : কী ধরনের ব্যবস্থার উদ্ভব হতে পারে? চীনে কি এ ধরনের রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী বলে আপনি মনে করেন?
লি :আমি মনে করি এটা স্বাভাবিকভাবে উদ্ভব ঘটবে। তবে আপনারা যেমনটা মনে করেন, সে রকম প্রতি চার বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ধরনের কিছু হবে না।
রোজ : অবশ্যই।
লি :তবে এটার উদ্ভব ঘটবেই। সেটা অবশ্য ঘটবে ধীরলয়ে, ধারণার চেয়েও অনেক বেশি দেরিতে হবে। তবে তারা এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক...
রোজ : তাদের এত ভয় কিসের?
লি : অস্থিতিশীলতার ভয়। চীনা ভাষায় একে 'লুয়ান' বলা হয়, যার অর্থ 'বিশৃঙ্খলা'। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অবস্থা দেখার পর তারা সে ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে চায় না।
রোজ : আর তখন তারা চোখের সামনে তিয়েন আনমেন দেখতে পায়।
লি : তারা তিয়েন আনমেন দেখেছে, তারা ফালুন গং দেখেছিল, তাদের সমাজের অভ্যন্তর থেকে হঠাৎ উদিত হওয়া মুভ হিসেবে এবং প্রথমবার তারা ফালুন গংয়ের কথা শুনেছিল। এসব দেখে তারা থ মেরে গিয়েছিল।
রোজ : তারা এতটাই ভড়কে গিয়েছিল?
লি : হ্যাঁ, এভাবেই হঠাৎ করে এসব তাদের দৃষ্টিগোচর হয়।
রোজ : ওটা তাদের জন্য হুমকি ছিল?
লি :তারা যখন ফালুনে কারা এবং কতজন সিনিয়র কর্মকর্তা এই গোপন গ্রুপে যোগ দিয়েছে, তখন তাদের...
রোজ : তাদের কী অবস্থা হয়েছিল?
লি :তারা হতচকিত হয়ে পড়ে।
রোজ : আর এ কারণেই তারা...
লি : সুতরাং তারা বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তবে আমি মনে করে, তাদের ব্যবস্থার মধ্যে মানুষকে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। যেখানে মানুষ ভাবতে পারবে যে, এই ব্যবস্থায় তাদের স্বার্থের প্রতিফলন ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছে।
আপনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার জন্য ভোট না দিতে পারেন কিন্তু ব্যবস্থার মধ্যে এমন সুযোগ থাকতে হবে যাতে মানুষের চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটে এবং নীতি, ফলাফলে তার ছাপ রয়েছে এমন অনুভব মানুষের থাকতে হবে। তারা সে সম্পর্কে অবগত বলেই আমার বিশ্বাস। তবে সে ধরনের একটা ব্যবস্থায় কীভাবে তারা যাবে সেটা তারা নির্ধারণ করেনি। তবে তারা সেদিকে ধীরলয়ে এগোচ্ছে।
রোজ : যেহেতু তারা সেটা এখনও ঠিক করেনি, তারা কি বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অংশ হতে চায়?
লি : হ্যাঁ, তবে তারা চায় তাদের এই শনৈঃশনৈ উন্নতি_ হিস্যা চায়।
রোজ : এটা কি যুক্তিযুক্ত?
লি : এটা যৌক্তিক। তবে তারা তাদের হিস্যা লাভের জন্য এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, কী ধরনের রূপান্তর হচ্ছে, সেটা দেখে ম্যানেজ করতে হবে।
রোজ : এক সময় আপনার পিতা আমাকে বলেছিলেন যে, দেং শিয়াও পিং সিঙ্গাপুরে কী হচ্ছে সেটা যথার্থভাবে বুঝতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি চীন থেকে সিঙ্গাপুরে লোক পাঠিয়েছিলেন।
লি : হ্যাঁ, অনেক মানুষ পাঠিয়েছিলেন।
রোজ : অনেকে,....
লি : তারা অনেক কিছুই দেখে। তারা আমাদের স্কুল, পানি সংরক্ষণ,... দেখে।
আমরা আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কীভাবে করি তারা তা পর্যবেক্ষণ করে, বাসস্থানের ব্যবস্থা কীভাবে করা হয় তা দেখে। তারা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। এমন অনেক কিছু আমরা করি যার প্রতি তাদের আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।
সর্বোপরি তারা আমাদের সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়। সরকারের বৈধতা অর্জন ও দীর্ঘকাল ধরে কন্টিনিউটি থাকা ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকার বিষয় তারা বুঝতে চায়। এমন একটি ব্যবস্থা যেটা দুর্নীতিমুক্ত এবং তার জবাবদিহিতা রয়েছে, সে সম্পর্কে তারা জানতে চায়। এটাকে তারা গোপনীয় বলে মনে করে। বস্তুত আমরা কীভাবে বিষয়টা সম্পন্ন করি সেটা তারা জানতে চায়। তবে কম আয়তন ও নগণ্যসংখ্যক লোকের আবাসস্থল সিঙ্গাপুরে যে ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে তাকে চীনের মতো বিশাল আয়তন ও জনবহুল একটি দেশে কার্যকর করা অতটা সহজ নয়। এটা তারা যে বোঝেননি তা নয়। তবে তাদের নিজ দেশের উপযোগী মডেল উদ্ভাবন করতে হবে।
রোজ : চীনকে আমরা যেমনটা মনে করি...
লি : তারা মোটেই তেমন নয়। আপনি সেখানে গেলেই দেখতে পাবেন চীন একটি ডাইভারস ও অত্যন্ত স্পন্দমান স্থান। স্বল্পসংখ্যক নিষিদ্ধ বিষয় ছাড়া আর সব ব্যাপারেই যুক্তিতর্ক চলে, অনেক বিষয় নিয়েই খোলামেলা ও প্রকাশ্য আলোচনা-সমালোচনা চলে।
রোজ : যেটা হলো রাজনীতি।
লি :কমিউনিস্ট পার্টি, তাইওয়ান, তিব্বত, মাও সে তুং।
রোজ : কিন্তু রাজনীতি...
লি : রাজনীতির অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা চলতে পারে।
রোজ : তবে কোনটা আলোচনা হতে পারে না?
লি :কমিউনিস্ট পার্টির চীন শাসনের বিষয়টি বিতকের্র ঊধর্ে্ব।
রোজ : সুতরাং এ ব্যাপারে কোনো বিরুদ্ধ মত অনুমোদনযোগ্য নয়?
লি : এর অনুমোদন নেই।
রোজ : ওটা একটা বড় নিরাপত্তাহীনতা, তাই না?
লি : হ্যাঁ।
রোজ : ভারতকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
লি :আমরা চাই, এই অঞ্চলে ভারত একটা বিরাট ভূমিকা পালন করুক। আমাদের দৃষ্টিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের মতো ভারতও রয়েছে। এই দুটি দেশ হলো আমাদের দুটি ডানার মতো, যার সাহায্যে আমরা উড়তে পারি। আর এটাই বড় পার্থক্য গড়ে দেয়।
রোজ :হ্যাঁ।
লি :এখন বাস্তবতা হলো, ভারতের জিডিপি চীনের এক-তৃতীয়াংশ। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ চীনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। আর ভারত দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। কিন্তু ভারতের রূপান্তরটা চীনের মতো এত গভীর ও ব্যাপক নয়। চীন যে পদ্ধতিতে তা অর্জন করেছে ভারতের বেলায় তা একই কায়দায় ঘটবে বলে আমি মনে করি না।

No comments

Powered by Blogger.