আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় বড় আঘাত-রব্বানি হত্যাকাণ্ড by আলিশা জে. রুবিন
আফগান শান্তি প্রক্রিয়ার প্রধান বোরহানউদ্দিন রব্বানির সঙ্গে কোলাকুলির সময় এক গুপ্তঘাতক তার কাছে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রব্বানিকে হত্যা করার ঘটনাটি তালেবানদের সঙ্গে পুনঃমিত্রতা গড়ে তোলা এবং ১০ বছরের আফগান যুদ্ধ অবসানের প্রচেষ্টাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করল।
এ হত্যাকাণ্ড ও এক সপ্তাহ আগে মার্কিন দূতাবাসে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দেশটির দুর্বল স্থিতিশীলতাকে যারা চুরমার করে দিতে চায় এবং যারা শান্তির পক্ষে আপাতত স্থিরীকৃত প্রচেষ্টাকে ভণ্ডুল করে দিতে চায়, তাদের প্রচণ্ড বিরোধিতাই প্রকট করে।
এটা আরও একবার প্রমাণ করেছে যে, সরকারের শত্রুদের রাজধানীর অত্যন্ত নিরাপদ বলে বিবেচিত জায়গাতেও হামলা চালানোর সামর্থ্য রয়েছে; সেটা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হোক বা সম্মুখ হামলার মাধ্যমেই হোক। বোরহানউদ্দিন রব্বানির হত্যাকাণ্ডটি এই লড়াইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
৭১ বছর বয়স্ক বোরহানউদ্দিন রব্বানির অনুপস্থিতিতে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া কঠিন হতে পারে। এই ব্যক্তি ছিলেন জটিল চরিত্রের। তালেবানদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার জন্য যে গুটি কয়েক ব্যক্তি রয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরাঞ্চলীয় জোটের নেতা ও এক সময় আফগান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকারী রব্বানি তালেবানদের সঙ্গে আপস আলোচনায় রত ছিলেন।
পশ্চিমা কূটনীতিকরা বলেছেন, সম্প্রতি রব্বানি তালেবানদের মধ্যে যাদের প্রকৃত আপস-আলোচনা চালানোর মতো ক্ষমতা ছিল তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিলেন। এতদিন যাদের সঙ্গে আলোচনা চলেছে তারা হয় ছিল প্রতারক অথবা তাদের অনেকেরই তালেবানদের ওপর কর্তৃত্ব ছিল না।
আফগান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, বোরহানউদ্দিন রব্বানির ওপর হামলার ঘটনায় আরও চার ব্যক্তি আহত হন। তাদের মধ্যে আফগান শান্তি প্রক্রিয়া সচিবালয়ের প্রধান মাসুম স্তানেকজাই রয়েছেন। আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিও এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের ভাষ্যমতে, যারাই এ হামলা চালিয়ে থাকুক না কেন, তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল শান্তি আলোচনাকে ভণ্ডুল করে দেওয়া। এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টেলিভিশনে জাতিগত তাজিক, হাজেরা, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পশতুন বিশিষ্ট নেতারা শান্তি প্রক্রিয়ার নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, তালেবানদের বিশ্বাস করা যায় না। তালেবানরা প্রধানত পশতুন জাতিগোষ্ঠীর।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও উত্তরাঞ্চলীয় জোটের নেতা ড. আবদুল্লা আবদুল্ল্না এই হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সেন্টিমেন্ট তুলে ধরে বলেন, যারা আফগান জনগণের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত অসংখ্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছে, তারা এখন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়_ এটা বোকাও বিশ্বাস করবে না।
ড. আবদুল্ল্না আবদুুল্লার মতে, আমাদের বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। যাদের মানবতায় আস্থা নেই তাদের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। তারা কাবুলের রাস্তায় লোকজনকে হত্যা করছে, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের হত্যা করছে। বিগত বসন্তে তারা শান্তি পরিষদ সদস্যদের হত্যার ঘোষণা দিয়েছিল।
আবদুল্ল্না আবদুুল্লা বলেন, তাদের এই হুমকিকে কেউই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি এবং এখন সময় এসেছে প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সম্বিত ফেরার। তিনি যাদের প্রিয় ভাই বলে সম্বোধন করতে অভ্যস্ত তারাই এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে।
হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ার সময় কারজাই যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। সেখানে তার এক সপ্তাহের কর্মসূচি ছিল। এসবের মধ্যে জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়া ছাড়াও ওবামা ও তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার আলোচনা নির্ধারিত ছিল। এখন ওবামার সঙ্গে কথা সেরেই কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে গতকালই তার দেশে ফিরে আসার কথা।
রব্বানিকে একজন আফগান দেশপ্রেমিক হিসেবে অভিহিত করে কারজাই শান্তিপূর্ণ পথে লড়াই অবসানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আমরা যে পথ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছি তার থেকে সরে আসব না বলে কারজাই ঘোষণা করেন। রব্বানির হত্যাকাণ্ডকে তিনি বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন।
শান্তি প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো তালেবান ও পুরনো তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল। তবে পশ্চিমা কর্মকর্তারা মনে করেন, এ আলোচনায় আফগানরা যুক্ত না হলে এটা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে না। কারণ আফগানদের পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি না হলে কাঙ্ক্ষিত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নয়। তবে বোরহানউদ্দিন রব্বানির হত্যাকাণ্ডের পর মঙ্গলবার মনে হয়েছে, সে আশায় গুড়ে বালি।
হামলার ধরন ও এর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বিবেচনা করে এর সঙ্গে কয়েকটি গ্রুপের জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে তালেবান, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার পালিত ও সে দেশের উপজাতির এলাকায় যাদের ঘাঁটি রয়েছে সেই হাক্কানী গ্রুপ ও আল কায়দা।
মার্কিন দূতাবাস থেকে আধা মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত রব্বানির বাড়িতে তার ওপর চালানো এই হামলা থেকে মনে হয়, শান্তি প্রক্রিয়ার এই নেতা স্থানটিকে বৈঠক অনুষ্ঠানের পক্ষে নিরাপদ ভেবে থাকবেন। শান্তি পরিষদের ড. আবদুল্লা আবদুল্ল্না ও অন্য সদস্যরা বলেন, বোমা হামলা পরিচালনাকারী ইসমতউল্লাহ গত পাঁচ মাস থেকে শান্তি পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এবং সে কাবুলেরই গেস্ট হাউসে অবস্থান করছিল।
কাউন্সিলের সঙ্গে তার যোগাযোগটা এর সদস্য রহমতউল্লাহ ওয়াহিদিয়ারের মাধ্যমে বজায় ছিল। এই ওয়াদিয়ার তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় থাকার সময় শরণার্থী ও শহীদদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ছিলেন। গত কয়েক বছর থেকেই ওয়াহিদিয়ার কাবুলে বসবাস করে আসছেন। এই গ্রীষ্মেই তার নাম জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। কূটনীতিকরা জানান, এই ব্যক্তিটি আটক ব্যক্তিদের মুক্ত করার লক্ষ্যে গঠিত শান্তি পরিষদ কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
ড. আবদুুল্লা আবদুল্ল্না বলেন, মঙ্গলবার ওয়াহিদিয়ার ইসমতউল্লাহ জানান যে, রব্বানিকে দেওয়ার জন্য কোয়েটা শুরা থেকে তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক মেসেজ রয়েছে। কোয়েটা শুরা হচ্ছে তালেবান নেতৃত্ব গ্রুপের।
রব্বানি সবে মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ইরান সফর থেকে ফিরেছেন। সে অবস্থায় তাকে বিষয়টি ব্রিফ করেন শান্তি পরিষদের কর্মকর্তা স্তানেকজাই। রব্বানির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন। আর তখনই আসেন ইসমতউল্লাহ। মুহূর্তের মধ্যেই নিহত হন রব্বানি এবং আহত হন ওয়াহিদিয়ার। স্তানেকজাইও গুরুতর আহত হন। বুধবার সকালের দিকে ওয়াহিদিয়ারকে আফগান গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে অনেকেই মনে করেন, এ হামলার ঘটনা সম্পর্কে ওয়াহিদিয়ার আগাম জানতেন বলে মনে হয় না।
রব্বানির ছিল ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবন। তিনি উত্তরাঞ্চলের বাদাখস্তানের বাসিন্দা। ১৯৮০'র দশকে তিনি সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রাথমিকভাবে তাজিকদের নিয়ে গঠিত জামাত-ই-ইসলামীর তিনি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আফগান দুর্বল প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি তার ক্ষমতায় থাকাকালে দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের যবনিকাপাত ঘটাতে পারেননি। যার পরিণামে আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে। ২০০২ সালে যখন তালেবানরা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়, তখন তিনি পুনরায় রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তার নিহত হওয়ার ঘটনাকে আফগানিস্তানের জন্য বিরাট ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি শুধু উত্তরাঞ্চলীয় মানুষদের কাছেই পরিচিত ছিলেন না; দক্ষিণাঞ্চলের পশতুন জাতিগোষ্ঠীর কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তবে পশতুনদের কারও কারও মধ্যে তার আন্তরিকতা প্রশ্নে সন্দেহ থেকে থাকলে গত এক বছর ধরে তার নিরলস শান্তি প্রচেষ্টার কারণে সন্দেহবাদীদের আস্থাও তিনি অর্জন করতে সমর্থ হন।
৭০ সদস্যের শান্তি পরিষদে দেশের সব গোত্রেরই প্রতিনিধি ছিলেন। তাদের মধ্যে আবার ছোট একটি কোর কমিটি ছিল। এই কোর কমিটি পাকিস্তানে অবস্থানকারী সিনিয়র তালেবান কমান্ডার ও নিম্ন পর্যায়ে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে নিরন্তর সংলাপে রত ছিল। রব্বানি দেশের প্রতিটি প্রদেশে ঐক্য পরিষদ গঠনের জন্য সফর করেছেন এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিবেশী সব ক'টি দেশ সফর করেছেন। এভাবে তিনি তার শান্তির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান দিয়ে সবার মধ্যে একটা অনুকূল ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তার মৃত্যুর খবর কান্দাহারে পেঁৗছার পর এখানকার লোকজনের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। সবাই মনে করে, যারা চায় না আফগানিস্তানে শান্তি আসুক এবং যারা আফগানিস্তানের উন্নতি চায় না, এই হত্যাকাণ্ড তাদেরই পরিকল্পনার ফসল।
আলিশা জে. রুবিন :নিউইয়র্ক টাইমসে কর্মরত
ভাষান্তর সুভাষ সাহা
এটা আরও একবার প্রমাণ করেছে যে, সরকারের শত্রুদের রাজধানীর অত্যন্ত নিরাপদ বলে বিবেচিত জায়গাতেও হামলা চালানোর সামর্থ্য রয়েছে; সেটা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হোক বা সম্মুখ হামলার মাধ্যমেই হোক। বোরহানউদ্দিন রব্বানির হত্যাকাণ্ডটি এই লড়াইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
৭১ বছর বয়স্ক বোরহানউদ্দিন রব্বানির অনুপস্থিতিতে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া কঠিন হতে পারে। এই ব্যক্তি ছিলেন জটিল চরিত্রের। তালেবানদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার জন্য যে গুটি কয়েক ব্যক্তি রয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরাঞ্চলীয় জোটের নেতা ও এক সময় আফগান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকারী রব্বানি তালেবানদের সঙ্গে আপস আলোচনায় রত ছিলেন।
পশ্চিমা কূটনীতিকরা বলেছেন, সম্প্রতি রব্বানি তালেবানদের মধ্যে যাদের প্রকৃত আপস-আলোচনা চালানোর মতো ক্ষমতা ছিল তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিলেন। এতদিন যাদের সঙ্গে আলোচনা চলেছে তারা হয় ছিল প্রতারক অথবা তাদের অনেকেরই তালেবানদের ওপর কর্তৃত্ব ছিল না।
আফগান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, বোরহানউদ্দিন রব্বানির ওপর হামলার ঘটনায় আরও চার ব্যক্তি আহত হন। তাদের মধ্যে আফগান শান্তি প্রক্রিয়া সচিবালয়ের প্রধান মাসুম স্তানেকজাই রয়েছেন। আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিও এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের ভাষ্যমতে, যারাই এ হামলা চালিয়ে থাকুক না কেন, তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল শান্তি আলোচনাকে ভণ্ডুল করে দেওয়া। এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টেলিভিশনে জাতিগত তাজিক, হাজেরা, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পশতুন বিশিষ্ট নেতারা শান্তি প্রক্রিয়ার নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, তালেবানদের বিশ্বাস করা যায় না। তালেবানরা প্রধানত পশতুন জাতিগোষ্ঠীর।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও উত্তরাঞ্চলীয় জোটের নেতা ড. আবদুল্লা আবদুল্ল্না এই হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সেন্টিমেন্ট তুলে ধরে বলেন, যারা আফগান জনগণের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত অসংখ্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছে, তারা এখন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়_ এটা বোকাও বিশ্বাস করবে না।
ড. আবদুল্ল্না আবদুুল্লার মতে, আমাদের বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। যাদের মানবতায় আস্থা নেই তাদের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। তারা কাবুলের রাস্তায় লোকজনকে হত্যা করছে, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের হত্যা করছে। বিগত বসন্তে তারা শান্তি পরিষদ সদস্যদের হত্যার ঘোষণা দিয়েছিল।
আবদুল্ল্না আবদুুল্লা বলেন, তাদের এই হুমকিকে কেউই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি এবং এখন সময় এসেছে প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সম্বিত ফেরার। তিনি যাদের প্রিয় ভাই বলে সম্বোধন করতে অভ্যস্ত তারাই এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে।
হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ার সময় কারজাই যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। সেখানে তার এক সপ্তাহের কর্মসূচি ছিল। এসবের মধ্যে জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়া ছাড়াও ওবামা ও তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার আলোচনা নির্ধারিত ছিল। এখন ওবামার সঙ্গে কথা সেরেই কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে গতকালই তার দেশে ফিরে আসার কথা।
রব্বানিকে একজন আফগান দেশপ্রেমিক হিসেবে অভিহিত করে কারজাই শান্তিপূর্ণ পথে লড়াই অবসানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আমরা যে পথ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছি তার থেকে সরে আসব না বলে কারজাই ঘোষণা করেন। রব্বানির হত্যাকাণ্ডকে তিনি বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন।
শান্তি প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো তালেবান ও পুরনো তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল। তবে পশ্চিমা কর্মকর্তারা মনে করেন, এ আলোচনায় আফগানরা যুক্ত না হলে এটা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে না। কারণ আফগানদের পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি না হলে কাঙ্ক্ষিত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নয়। তবে বোরহানউদ্দিন রব্বানির হত্যাকাণ্ডের পর মঙ্গলবার মনে হয়েছে, সে আশায় গুড়ে বালি।
হামলার ধরন ও এর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বিবেচনা করে এর সঙ্গে কয়েকটি গ্রুপের জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে তালেবান, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার পালিত ও সে দেশের উপজাতির এলাকায় যাদের ঘাঁটি রয়েছে সেই হাক্কানী গ্রুপ ও আল কায়দা।
মার্কিন দূতাবাস থেকে আধা মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত রব্বানির বাড়িতে তার ওপর চালানো এই হামলা থেকে মনে হয়, শান্তি প্রক্রিয়ার এই নেতা স্থানটিকে বৈঠক অনুষ্ঠানের পক্ষে নিরাপদ ভেবে থাকবেন। শান্তি পরিষদের ড. আবদুল্লা আবদুল্ল্না ও অন্য সদস্যরা বলেন, বোমা হামলা পরিচালনাকারী ইসমতউল্লাহ গত পাঁচ মাস থেকে শান্তি পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এবং সে কাবুলেরই গেস্ট হাউসে অবস্থান করছিল।
কাউন্সিলের সঙ্গে তার যোগাযোগটা এর সদস্য রহমতউল্লাহ ওয়াহিদিয়ারের মাধ্যমে বজায় ছিল। এই ওয়াদিয়ার তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় থাকার সময় শরণার্থী ও শহীদদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ছিলেন। গত কয়েক বছর থেকেই ওয়াহিদিয়ার কাবুলে বসবাস করে আসছেন। এই গ্রীষ্মেই তার নাম জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। কূটনীতিকরা জানান, এই ব্যক্তিটি আটক ব্যক্তিদের মুক্ত করার লক্ষ্যে গঠিত শান্তি পরিষদ কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
ড. আবদুুল্লা আবদুল্ল্না বলেন, মঙ্গলবার ওয়াহিদিয়ার ইসমতউল্লাহ জানান যে, রব্বানিকে দেওয়ার জন্য কোয়েটা শুরা থেকে তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক মেসেজ রয়েছে। কোয়েটা শুরা হচ্ছে তালেবান নেতৃত্ব গ্রুপের।
রব্বানি সবে মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ইরান সফর থেকে ফিরেছেন। সে অবস্থায় তাকে বিষয়টি ব্রিফ করেন শান্তি পরিষদের কর্মকর্তা স্তানেকজাই। রব্বানির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন। আর তখনই আসেন ইসমতউল্লাহ। মুহূর্তের মধ্যেই নিহত হন রব্বানি এবং আহত হন ওয়াহিদিয়ার। স্তানেকজাইও গুরুতর আহত হন। বুধবার সকালের দিকে ওয়াহিদিয়ারকে আফগান গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে অনেকেই মনে করেন, এ হামলার ঘটনা সম্পর্কে ওয়াহিদিয়ার আগাম জানতেন বলে মনে হয় না।
রব্বানির ছিল ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবন। তিনি উত্তরাঞ্চলের বাদাখস্তানের বাসিন্দা। ১৯৮০'র দশকে তিনি সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রাথমিকভাবে তাজিকদের নিয়ে গঠিত জামাত-ই-ইসলামীর তিনি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আফগান দুর্বল প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি তার ক্ষমতায় থাকাকালে দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের যবনিকাপাত ঘটাতে পারেননি। যার পরিণামে আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে। ২০০২ সালে যখন তালেবানরা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়, তখন তিনি পুনরায় রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তার নিহত হওয়ার ঘটনাকে আফগানিস্তানের জন্য বিরাট ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি শুধু উত্তরাঞ্চলীয় মানুষদের কাছেই পরিচিত ছিলেন না; দক্ষিণাঞ্চলের পশতুন জাতিগোষ্ঠীর কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তবে পশতুনদের কারও কারও মধ্যে তার আন্তরিকতা প্রশ্নে সন্দেহ থেকে থাকলে গত এক বছর ধরে তার নিরলস শান্তি প্রচেষ্টার কারণে সন্দেহবাদীদের আস্থাও তিনি অর্জন করতে সমর্থ হন।
৭০ সদস্যের শান্তি পরিষদে দেশের সব গোত্রেরই প্রতিনিধি ছিলেন। তাদের মধ্যে আবার ছোট একটি কোর কমিটি ছিল। এই কোর কমিটি পাকিস্তানে অবস্থানকারী সিনিয়র তালেবান কমান্ডার ও নিম্ন পর্যায়ে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে নিরন্তর সংলাপে রত ছিল। রব্বানি দেশের প্রতিটি প্রদেশে ঐক্য পরিষদ গঠনের জন্য সফর করেছেন এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিবেশী সব ক'টি দেশ সফর করেছেন। এভাবে তিনি তার শান্তির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান দিয়ে সবার মধ্যে একটা অনুকূল ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তার মৃত্যুর খবর কান্দাহারে পেঁৗছার পর এখানকার লোকজনের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। সবাই মনে করে, যারা চায় না আফগানিস্তানে শান্তি আসুক এবং যারা আফগানিস্তানের উন্নতি চায় না, এই হত্যাকাণ্ড তাদেরই পরিকল্পনার ফসল।
আলিশা জে. রুবিন :নিউইয়র্ক টাইমসে কর্মরত
ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments