স্থানীয় সরকার-ঢাকাকে ভাগ করবেন না by বদিউল আলম মজুমদার
গত ২৩ নভেম্বর সরকার স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর সংশোধনকল্পে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করেছে। বিলটির উদ্দেশ্য মূলত ঢাকা মহানগরকে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণে বিভক্ত করে দুজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা। প্রধান বিরোধী দল সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধী।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর বিরোধিতা করছেন। এমনকি নাগরিক সমাজও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। সংবাদপত্রের অনলাইন জরিপ ও নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা থেকে মনে হয়, যেন তারা কেউ এই উদ্যোগকে সমর্থন করছে না। তবু ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করতে সরকার যেন বদ্ধপরিকর।
ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তের সমর্থনে সরকারের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জনসংখ্যার চাপ ও দুর্নীতির কারণে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে করপোরেশনের সেবার পরিমাণ ও মান বৃদ্ধি পাবে। এ যুক্তিগুলো একটু গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।
জনসংখ্যার চাপের বিষয়ে আসা যাক। ঢাকা শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। আর এর ফলেই ঢাকা শহর মহানগরে পরিণত হয়েছে। জনগণের ঢাকামুখী হওয়ার দুটি কারণ। প্রথমত, আমাদের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা। কেন্দ্র তথা ঢাকা থেকেই সবকিছু পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় সব অফিস-আদালতই ঢাকায় অবস্থিত। তাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরাট অংশকেই ঢাকায় বসবাস করতে হয়। এ ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় যেসব কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে কর্মরত, তাঁদের পরিবার পরিজনও ঢাকায় বসবাস করে। দ্বিতীয়ত, পল্লি অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, তাই জীবন-জীবিকার সন্ধানেও মানুষকে ঢাকামুখী হতে হয়।
অতএব, ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করে রাজধানীর ওপর জনসংখ্যার চাপ কমানো যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন একটি বলিষ্ঠ গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি। আরও প্রয়োজন কৃষি ও পল্লি জীবনে সত্যিকারের গতিশীলতা আনয়ন, যা করতে বতর্মান সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। পল্লি এলাকার জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বেগবান করতে হলে অবশ্য প্রয়োজন হবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা, যা করতে বর্তমান সরকারসহ অতীতের সব সরকারই ব্যর্থ হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি একের পর এক সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণেই পল্লি এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে বাড়তি জনসংখ্যার সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা পেট ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার সমতুল্য হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে পদ্ধতি ও কাঠামোর পরিবর্তন এবং দলনির্বিশেষে দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তির বিধান ব্যতীত ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করে কীভাবে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা যাবে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তাই ঢাকাকে বিভক্ত করার পক্ষে এ যুক্তিও ধোপে টেকে না।
ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করে কীভাবে সেবার মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করা যাবে? এর জন্য প্রয়োজন হবে দুর্নীতির মূলোৎপাটন, সেবা প্রদানে দক্ষতা বৃদ্ধি, ট্যাক্স আদায়ে কার্যকর কর্মসূচি, করপোরেশনের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও এর পরিচালনায় পেশাদারি মনোভাব ইত্যাদি। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে করপোরেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সরকারের অযাচিত খবরদারির অবসান। আর ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করলেই এগুলো অর্জিত হবে না। এ ছাড়া বিভক্তির ফলে ঢাকা দক্ষিণের আয় কমে যাবে বলে অনেকের ধারণা। ফলে ওই এলাকার জনগণের সেবার পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই দেখা দেবে। বিভক্তির কারণে সেবা প্রদানের ব্যয়ও বাড়বে। কারণ, এর ফলে দুটি সিটি করপোরেশন চালাতে হবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যাবে।
ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করার বিরুদ্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবেগী ও আইনি যুক্তিও রয়েছে। যেমন—অবিভক্ত ঢাকার একটি গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ঢাকাকে বিভক্ত করলে ওই ঐতিহ্য ধ্বংস হবে। আর সংবিধানের ৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঢাকা আমাদের রাজধানী। ঢাকাকে বিভক্ত করলে প্রশ্ন দেখা দেবে, কোন ঢাকা আমাদের রাজধানী—উত্তর, না দক্ষিণ ঢাকা?
অনেকে মনে করেন, ঢাকাকে বিভক্ত করা হচ্ছে একটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। সরকারের উদ্দেশ্য নির্বাচন না দিয়ে, নির্বাচন কমিশনের সব আয়োজন সত্ত্বেও অতীতে সরকার নির্বাচন দিতে রাজি হয়নি, মেয়াদোত্তীর্ণ মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে অপসারণ করা, যা বিদ্যমান আইনের অধীনে করা যায় না। কারণ, বর্তমান সিটি করপোরেশন আইনে বিরাজমান করপোরেশনের জন্য প্রশাসক নিয়োগের কোনো বিধান নেই। তাই সরকার যা সরাসরি করতে পারে না, তা-ই আইন সংশোধনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে করার চেষ্টা হচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। এ ধরনের আইনকে রঙিন বা বিকৃত আইন বলা হয়।
এ ছাড়া উপজেলা পদ্ধতি বাতিলের পর বিখ্যাত কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ [৪৪ ডিএলআর (এডি)(১৯৯২] মামলার সর্বসম্মত রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেন, যদি সরকারি কর্মকর্তা বা তাদের তল্পিবহদের কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় জড়িত করা হয়, তাহলে সেগুলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অর্থাৎ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিরুদ্ধে আদালতের সুস্পষ্ট অবস্থান।
প্রস্তাবিত সংশোধনটি রঙিন আইন এবং অবৈধ এ যুক্তি ছাড়া আরেক কারণেও সিদ্ধান্তটি প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করে রায় প্রদানের পর ভারতীয় আইনসভা নির্বাচনী আইন সংশোধন করে আদালতের রায় ভণ্ডুল করার উদ্যোগ নেয়। সেই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে মামলার রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্টভাবে বলেন, আইনসভার আদালতের রায় পর্যালোচনা এবং তা ভণ্ডুল করার কোনো অধিকার নেই। আইনসভা আদালতের রায় বাধ্যতামূলক নয়, বাতিল ও অকার্যকর বলতে পারে না [পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) ৪ এসসিসি]।
আমরা মনে করি, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ রায় আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ ছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সরকারি কর্মকর্তার বাইরে যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগের বিধান করা হয়েছে, যার ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ মেয়রকে বাদ দিয়ে দলীয় ব্যক্তিদের ফায়দা হিসেবে প্রশাসকের পদ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীটির পেছনে এটি আরও একটি দুরভিসন্ধি বলে অনেকের ধারণা।
পরিশেষে, আমরা সরকারকে প্রস্তাবিত সংশোধনী পাস করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করব। একই সঙ্গে অনুরোধ করব, সরকার যেন মেয়াদোত্তীর্ণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দ্রুততার সঙ্গে আয়োজন করে, একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং নগর সরকার স্থাপনের যে ধারণা আমাদের সংবিধানের ৫৯(২)(গ) অনুচ্ছেদের মধ্যে নিহিত, উদ্যোগ নেয়। এসব উদ্যোগ একদিকে যেমন স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে, অন্যদিকে জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
সর্বোপরি, জনমত উপেক্ষা করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করা হবে একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত, যা সরকারকে আরও জনবিচ্ছিন্ন করে তুলবে এবং এর মাশুল অবশ্যই সরকারকে দিতে হবে। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও শিক্ষিত ভোটাররাই গত জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটকে মহাবিজয় উপহার দিয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, এসব ভোটার ইতিমধ্যেই ক্ষমতাসীনদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারকে সাবধান হতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তের সমর্থনে সরকারের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জনসংখ্যার চাপ ও দুর্নীতির কারণে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে করপোরেশনের সেবার পরিমাণ ও মান বৃদ্ধি পাবে। এ যুক্তিগুলো একটু গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।
জনসংখ্যার চাপের বিষয়ে আসা যাক। ঢাকা শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। আর এর ফলেই ঢাকা শহর মহানগরে পরিণত হয়েছে। জনগণের ঢাকামুখী হওয়ার দুটি কারণ। প্রথমত, আমাদের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা। কেন্দ্র তথা ঢাকা থেকেই সবকিছু পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় সব অফিস-আদালতই ঢাকায় অবস্থিত। তাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরাট অংশকেই ঢাকায় বসবাস করতে হয়। এ ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় যেসব কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে কর্মরত, তাঁদের পরিবার পরিজনও ঢাকায় বসবাস করে। দ্বিতীয়ত, পল্লি অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, তাই জীবন-জীবিকার সন্ধানেও মানুষকে ঢাকামুখী হতে হয়।
অতএব, ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করে রাজধানীর ওপর জনসংখ্যার চাপ কমানো যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন একটি বলিষ্ঠ গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি। আরও প্রয়োজন কৃষি ও পল্লি জীবনে সত্যিকারের গতিশীলতা আনয়ন, যা করতে বতর্মান সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। পল্লি এলাকার জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বেগবান করতে হলে অবশ্য প্রয়োজন হবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা, যা করতে বর্তমান সরকারসহ অতীতের সব সরকারই ব্যর্থ হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি একের পর এক সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণেই পল্লি এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে বাড়তি জনসংখ্যার সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা পেট ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার সমতুল্য হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে পদ্ধতি ও কাঠামোর পরিবর্তন এবং দলনির্বিশেষে দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তির বিধান ব্যতীত ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করে কীভাবে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা যাবে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তাই ঢাকাকে বিভক্ত করার পক্ষে এ যুক্তিও ধোপে টেকে না।
ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করে কীভাবে সেবার মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করা যাবে? এর জন্য প্রয়োজন হবে দুর্নীতির মূলোৎপাটন, সেবা প্রদানে দক্ষতা বৃদ্ধি, ট্যাক্স আদায়ে কার্যকর কর্মসূচি, করপোরেশনের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও এর পরিচালনায় পেশাদারি মনোভাব ইত্যাদি। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে করপোরেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সরকারের অযাচিত খবরদারির অবসান। আর ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করলেই এগুলো অর্জিত হবে না। এ ছাড়া বিভক্তির ফলে ঢাকা দক্ষিণের আয় কমে যাবে বলে অনেকের ধারণা। ফলে ওই এলাকার জনগণের সেবার পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই দেখা দেবে। বিভক্তির কারণে সেবা প্রদানের ব্যয়ও বাড়বে। কারণ, এর ফলে দুটি সিটি করপোরেশন চালাতে হবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যাবে।
ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করার বিরুদ্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবেগী ও আইনি যুক্তিও রয়েছে। যেমন—অবিভক্ত ঢাকার একটি গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ঢাকাকে বিভক্ত করলে ওই ঐতিহ্য ধ্বংস হবে। আর সংবিধানের ৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঢাকা আমাদের রাজধানী। ঢাকাকে বিভক্ত করলে প্রশ্ন দেখা দেবে, কোন ঢাকা আমাদের রাজধানী—উত্তর, না দক্ষিণ ঢাকা?
অনেকে মনে করেন, ঢাকাকে বিভক্ত করা হচ্ছে একটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। সরকারের উদ্দেশ্য নির্বাচন না দিয়ে, নির্বাচন কমিশনের সব আয়োজন সত্ত্বেও অতীতে সরকার নির্বাচন দিতে রাজি হয়নি, মেয়াদোত্তীর্ণ মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে অপসারণ করা, যা বিদ্যমান আইনের অধীনে করা যায় না। কারণ, বর্তমান সিটি করপোরেশন আইনে বিরাজমান করপোরেশনের জন্য প্রশাসক নিয়োগের কোনো বিধান নেই। তাই সরকার যা সরাসরি করতে পারে না, তা-ই আইন সংশোধনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে করার চেষ্টা হচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। এ ধরনের আইনকে রঙিন বা বিকৃত আইন বলা হয়।
এ ছাড়া উপজেলা পদ্ধতি বাতিলের পর বিখ্যাত কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ [৪৪ ডিএলআর (এডি)(১৯৯২] মামলার সর্বসম্মত রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেন, যদি সরকারি কর্মকর্তা বা তাদের তল্পিবহদের কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় জড়িত করা হয়, তাহলে সেগুলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অর্থাৎ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিরুদ্ধে আদালতের সুস্পষ্ট অবস্থান।
প্রস্তাবিত সংশোধনটি রঙিন আইন এবং অবৈধ এ যুক্তি ছাড়া আরেক কারণেও সিদ্ধান্তটি প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করে রায় প্রদানের পর ভারতীয় আইনসভা নির্বাচনী আইন সংশোধন করে আদালতের রায় ভণ্ডুল করার উদ্যোগ নেয়। সেই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে মামলার রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্টভাবে বলেন, আইনসভার আদালতের রায় পর্যালোচনা এবং তা ভণ্ডুল করার কোনো অধিকার নেই। আইনসভা আদালতের রায় বাধ্যতামূলক নয়, বাতিল ও অকার্যকর বলতে পারে না [পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) ৪ এসসিসি]।
আমরা মনে করি, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ রায় আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ ছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সরকারি কর্মকর্তার বাইরে যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগের বিধান করা হয়েছে, যার ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ মেয়রকে বাদ দিয়ে দলীয় ব্যক্তিদের ফায়দা হিসেবে প্রশাসকের পদ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীটির পেছনে এটি আরও একটি দুরভিসন্ধি বলে অনেকের ধারণা।
পরিশেষে, আমরা সরকারকে প্রস্তাবিত সংশোধনী পাস করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করব। একই সঙ্গে অনুরোধ করব, সরকার যেন মেয়াদোত্তীর্ণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দ্রুততার সঙ্গে আয়োজন করে, একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং নগর সরকার স্থাপনের যে ধারণা আমাদের সংবিধানের ৫৯(২)(গ) অনুচ্ছেদের মধ্যে নিহিত, উদ্যোগ নেয়। এসব উদ্যোগ একদিকে যেমন স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে, অন্যদিকে জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
সর্বোপরি, জনমত উপেক্ষা করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ঢাকা মহানগরকে বিভক্ত করা হবে একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত, যা সরকারকে আরও জনবিচ্ছিন্ন করে তুলবে এবং এর মাশুল অবশ্যই সরকারকে দিতে হবে। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও শিক্ষিত ভোটাররাই গত জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটকে মহাবিজয় উপহার দিয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, এসব ভোটার ইতিমধ্যেই ক্ষমতাসীনদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারকে সাবধান হতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments