আদর্শের সঙ্গে মেলানো জীবনাচরণ by বৃত্বা রায় দীপা
আজ প্রসাদ রায়ের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াকু যোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শ্রমিক-মেহনতি মানুষের বন্ধু, কমিউনিস্ট নেতা এদিন সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। জন্মেছিলেন ৫ আগস্ট, ১৯২৮ সালে পাবনার প্রতাপ ভবনে। সে সময়ে পাবনা শহরে এই পরিবারটির স্বপরিচিতি ছিল তার অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃৃতিক আবহের কারণে। এ চিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন তার মা শবাসনা দেবী।
প্রসাদ রায়ের সর্বমোট ১৯ বছর ৬ মাস কেটেছে জেলে। ১৯৪৮ সালের নিকষ কালো অন্ধকার যুগে জীবন বাজি রেখে কালের বরফ ভাঙার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বেরিয়েছিলেন ঘর থেকে। আমৃত্যু দমন-পীড়ন আর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে অবিচল রেখেছিলেন কমিউনিস্ট আদর্শে। প্রথম কারাবরণ ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার হন। ১৯৫৩ পর্যন্ত টানা জেলে ছিলেন। ১৯৫৪ সালে দু'বার গ্রেফতার হন। '৫৫ সালের শুরুর দিকে পুলিশ স্ট্রাইকের মামলায় পূনর্বার কারাবরণ। আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসন জারির পর আবারও কারাবরণ, ১৯৬২ সালে মুক্তিলাভের পর পাক-ভারত যুদ্ধের শুরুতে জেলে গিয়ে ১৯৬৮ সালে মুক্তি পান। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলা। তার ঢেউ আছড়ে পড়ে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার পাবনায়। মিছিল থেকে গ্রেফতার হন প্রসাদ রায়। এরপর মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কারারুদ্ধ হন ১৯৭৫-এ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। ১৯৭৮-এ কারামুক্ত হয়ে ১৯৮৪ সালে আবারও গ্রেফতার হন স্বৈরশাসকের শাসনামলে। দীর্ঘ জেল জীবনের ফাঁকে ফাঁকে যুক্ত থেকেছেন পার্টি গড়ার কাজে, শ্রমিক আন্দোলনে।
১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দিদের অমানুষিক কারাশাস্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল কমিউনিস্টরা। দেশ বিভাগের পর এটিই ছিল কমিউনিস্টদের প্রথম প্রকাশ্য বিদ্রোহ। আর এ বিদ্রোহকে দমন করতে রাজশাহী জেলের সব বন্দিকে খাপড়া ওয়ার্ডে নিয়ে নির্বিচারে গুলি করা হয়। বেপরোয়া গুলির পর ২ ঘণ্টা ধরে চলেছিল বিরামহীন লাঠিচার্জ। সে বিদ্রোহে সাতজন শহীদ হন। প্রসাদ রায়ের বাম ঊরুতে গুলি লেগেছিল সাতটি, লাঠিচার্জে উপড়ে গিয়েছিল সামনের পাটির দাঁত, মাথা ফেটে অস্বাভাবিক রক্তপাত হয়েছিল। যতবার তার কাছে খাপড়া ওয়াডের্র গল্প শুনেছি, প্রতিবারই বলতেন_ বেঁচে আছি এটাই তো বোনাস। ২২ বছর বয়সে যেমন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গুলির মুখে, আমৃত্যু দেখেছি তেমনই বিরুদ্ধ বাতাসে রুখে দাঁড়াতে।
ব্যক্তিজীবনে তার সন্তান হিসেবে তাকে দু'ভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। প্রথমত, বাবা হিসেবে; দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। খুব ছোটবেলায় যখন বানান করে 'সবুজসাথী' পড়া চলছে আমার, তখন পার্টির নানা কর্মকাণ্ডে ঢাকায় এলে দু'হাত ভরে নিয়ে যেতেন বই। কৈশোরেই নিকোলাই অস্ত্রভস্কি তার হাত ধরে ঢুকে পড়েছিলেন আমাদের পড়ার ঘরে। আশৈশব আমাদের সাথি ছিল পিতার জেলজীবন। আমি ঠিক মনে করতে পারি না কবে প্রথম পুলিশ এলো আমাদের বাড়িতে। কবে প্রথম মায়ের হাত ধরে আমরা দাঁড়ালাম সেন্ট্রাল জেলের শিক ছুঁয়ে! কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি তখন প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ ছিল। হয় জেল, নয় আত্মগোপনে থেকে পার্টির কাজ। মনে পড়ছে, আমরা দুই ভাইবোন মায়ের সঙ্গে সন্ধ্যার পর অনেক দূরের রাস্তা পাড়ি দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। অদ্ভুতরকম গা ছমছমে ছিল সেসব রিকশাযাত্রা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে শেষে যখন পেঁৗছাতাম অচেনা কোনো কৃষকের বাড়িতে, কুপির টিমটিমে আলোয় বাবার কোলে বসে তামাকের ঘন গন্ধ নিতে নিতে আমরা ভুলে যেতাম সব অনিশ্চয়তা। আর যখন প্রসাদ রায়ের মুক্তি চেয়ে রাজপথে ঝাঁঝালো মিছিল নামত, আমরা দুই ভাইবোন জানালা দিয়ে দেখতাম আর ঠিক করে ফেলতাম_ বড় হয়ে আমরাও রাজবন্দি হবো।
প্রসাদ রায় জানতেন জীবন হলো সংগ্রামের। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংগ্রাম ছিল তার। আদর্শের সঙ্গে জীবনাচরণকে মেলানোর আশ্চর্য শক্তি ছিল তার। যা বলেছেন তা বিশ্বাস করেছেন এবং জীবনে তার চর্চা করেছেন। যাপন করেছেন অতি সাধারণ জীবন, ধারণ করেছেন বহুমাত্রিক গুণ। এ এক জটিল সংগ্রামেরই নাম। এ লড়াই সবাই পারে না, তিনি পেরেছিলেন। বাড়িতে যখন দিনব্যাপী মিটিং চলত তখন দেখেছি, শুনতেন খুব মনোযোগ দিয়ে, যেন প্রথমবার শুনছেন। বোঝাতেন আরও মনোযোগ দিয়ে, আরও সরল করে। বহু মত ধারণ করতে পারতেন। প্রভাবিত করতে পারতেন আরও বেশি। শ্রমিক থেকে শুরু করে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, প্রসাদ রায় সবার বোধগম্য করে বলতে পারতেন। পাহাড়ের গায়ে জন্ম নেওয়া গুল্ম যেমন বুঝতে পারে না পাহাড়ের বিশালতা, তেমনই এই বিশাল মানুষটির খুব কাছে থেকেও তাকে জানা হয়নি ভালো করে। সেই না জানার বেদনা আজ বড় বেশি আচ্ছন্ন করে।
বৃত্বা রায় দীপা : কমরেড প্রসাদ রায়ের কন্যা, চিত্রনির্মাতা
b.roydipa@yahoo.com
১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দিদের অমানুষিক কারাশাস্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল কমিউনিস্টরা। দেশ বিভাগের পর এটিই ছিল কমিউনিস্টদের প্রথম প্রকাশ্য বিদ্রোহ। আর এ বিদ্রোহকে দমন করতে রাজশাহী জেলের সব বন্দিকে খাপড়া ওয়ার্ডে নিয়ে নির্বিচারে গুলি করা হয়। বেপরোয়া গুলির পর ২ ঘণ্টা ধরে চলেছিল বিরামহীন লাঠিচার্জ। সে বিদ্রোহে সাতজন শহীদ হন। প্রসাদ রায়ের বাম ঊরুতে গুলি লেগেছিল সাতটি, লাঠিচার্জে উপড়ে গিয়েছিল সামনের পাটির দাঁত, মাথা ফেটে অস্বাভাবিক রক্তপাত হয়েছিল। যতবার তার কাছে খাপড়া ওয়াডের্র গল্প শুনেছি, প্রতিবারই বলতেন_ বেঁচে আছি এটাই তো বোনাস। ২২ বছর বয়সে যেমন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গুলির মুখে, আমৃত্যু দেখেছি তেমনই বিরুদ্ধ বাতাসে রুখে দাঁড়াতে।
ব্যক্তিজীবনে তার সন্তান হিসেবে তাকে দু'ভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। প্রথমত, বাবা হিসেবে; দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। খুব ছোটবেলায় যখন বানান করে 'সবুজসাথী' পড়া চলছে আমার, তখন পার্টির নানা কর্মকাণ্ডে ঢাকায় এলে দু'হাত ভরে নিয়ে যেতেন বই। কৈশোরেই নিকোলাই অস্ত্রভস্কি তার হাত ধরে ঢুকে পড়েছিলেন আমাদের পড়ার ঘরে। আশৈশব আমাদের সাথি ছিল পিতার জেলজীবন। আমি ঠিক মনে করতে পারি না কবে প্রথম পুলিশ এলো আমাদের বাড়িতে। কবে প্রথম মায়ের হাত ধরে আমরা দাঁড়ালাম সেন্ট্রাল জেলের শিক ছুঁয়ে! কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি তখন প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ ছিল। হয় জেল, নয় আত্মগোপনে থেকে পার্টির কাজ। মনে পড়ছে, আমরা দুই ভাইবোন মায়ের সঙ্গে সন্ধ্যার পর অনেক দূরের রাস্তা পাড়ি দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। অদ্ভুতরকম গা ছমছমে ছিল সেসব রিকশাযাত্রা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে শেষে যখন পেঁৗছাতাম অচেনা কোনো কৃষকের বাড়িতে, কুপির টিমটিমে আলোয় বাবার কোলে বসে তামাকের ঘন গন্ধ নিতে নিতে আমরা ভুলে যেতাম সব অনিশ্চয়তা। আর যখন প্রসাদ রায়ের মুক্তি চেয়ে রাজপথে ঝাঁঝালো মিছিল নামত, আমরা দুই ভাইবোন জানালা দিয়ে দেখতাম আর ঠিক করে ফেলতাম_ বড় হয়ে আমরাও রাজবন্দি হবো।
প্রসাদ রায় জানতেন জীবন হলো সংগ্রামের। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংগ্রাম ছিল তার। আদর্শের সঙ্গে জীবনাচরণকে মেলানোর আশ্চর্য শক্তি ছিল তার। যা বলেছেন তা বিশ্বাস করেছেন এবং জীবনে তার চর্চা করেছেন। যাপন করেছেন অতি সাধারণ জীবন, ধারণ করেছেন বহুমাত্রিক গুণ। এ এক জটিল সংগ্রামেরই নাম। এ লড়াই সবাই পারে না, তিনি পেরেছিলেন। বাড়িতে যখন দিনব্যাপী মিটিং চলত তখন দেখেছি, শুনতেন খুব মনোযোগ দিয়ে, যেন প্রথমবার শুনছেন। বোঝাতেন আরও মনোযোগ দিয়ে, আরও সরল করে। বহু মত ধারণ করতে পারতেন। প্রভাবিত করতে পারতেন আরও বেশি। শ্রমিক থেকে শুরু করে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, প্রসাদ রায় সবার বোধগম্য করে বলতে পারতেন। পাহাড়ের গায়ে জন্ম নেওয়া গুল্ম যেমন বুঝতে পারে না পাহাড়ের বিশালতা, তেমনই এই বিশাল মানুষটির খুব কাছে থেকেও তাকে জানা হয়নি ভালো করে। সেই না জানার বেদনা আজ বড় বেশি আচ্ছন্ন করে।
বৃত্বা রায় দীপা : কমরেড প্রসাদ রায়ের কন্যা, চিত্রনির্মাতা
b.roydipa@yahoo.com
No comments