কল্পকথার গল্প-'ঊন ভাতে দুনো বল, বেশি খেলে...' by আলী হাবিব
না, এই পাবলিককে নিয়ে আর কোনো আশা নেই। এই পাবলিককে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এই পাবলিকের আছেটা কী? অতীত নেই, বর্তমান নেই। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পাবলিকের ভালো করতে গেলে উল্টো ফল হয়। 'উল্টো বুঝলি রাম'-এর মতো পাবলিক উল্টো বুঝে বসে থাকে।
পাবলিক এমন এক চিজ, যে নাকি আগে থেকেই একটা প্রি-কনসেপশন নিয়ে বসে থাকে! পাবলিক এটার ওপর করে খায়। বিষয় একটা ছেড়ে দিন। পাবলিক অমনি সেটাকে চটকে দেবে। এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয় নিয়ে এই পাবলিক পাবলিকলি পাবলিক-ওপিনিয়ন দিতে পিছপা হবে! পাবলিককে ভালো কিছু বলুন, মন্দ হবে। ওই যে বললাম, 'উল্টো বুঝলি রাম'! পাবলিক উল্টো বুঝে বসে থাকবে। আগেই ভালোমন্দ হিসাব করবে। আমরা কিন্তু সবসময় পাবলিকের ভালো করতে চাই। কারণ, 'পাবলিকের মার, দুনিয়ার বার'। বাংলায় যাকে বলে 'আড়ং ধোলাই'। কিংবা 'হাটুরে মার'। পাবলিকের সে মার আমরা খেতে চাই না। মারটা যে প্রকাশ্যে দিতে হবে-এমন কোনো কথা নেই। পাবলিকের হাতে পাঁচ বছর পর পর গোপন মার দেওয়ার একটা মোক্ষম অস্ত্র আসে। পাবলিক সেই অস্ত্র দিয়ে মারে। এমন সে মারের ধার, পাঁচ বছর ক্ষমতার বার। ক্ষমতার বাইরে থাকার কী যে জ্বালা, 'বুঝিবে সে কিসে-কভু ক্ষমতার বাইরে থাকেনি যে?' ক্ষমতার বাইরে থাকলে, ক্ষমতা জিনিসটা কী, সেটা উপলব্ধি করা যায়। এই ক্ষমতার জন্য আবার পাবলিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
কাজেই যত ঝামেলা এই পাবলিককে নিয়ে। পাবলিক আমাদের চিনল না। একটু চেনার চেষ্টা করতে পারে, করল না। অনেক আগে এক মন্ত্রীর নামের সঙ্গে 'চিনি' শব্দটি খাপে খাপ বসিয়ে দিয়েছিল এই পাবলিক। ভদ্রলোকের বাপ-ঠাকুর্দার আমলের একটা বংশীয় পদবি ছিল। সেই পদবির জায়গা নিয়ে নিল 'চিনি' শব্দটি। এবারও কোথায় চিনি নিয়ে কী যেন হয়েছে, কী হয়নি-পাবলিক অমনি আমাদের নিয়ে গান বেঁধেছে, 'চিনি গো চিনি তোমারে...'। ঠাকুরের গানের কী দুর্গতি আজ ভেবে দেখুন! আরে বাবা, আমাদের তো চিনে রাখতেই হবে। চিনে না রাখলে অসুবিধা হতে পারে। এই যে আমরা এক-একজন এক-একটা পদে বসে আছি, আমাদের পদের একটা ভার আছে না! আমাদের পদভারে যদি একটু মাটি না কাঁপল, তাহলে সে পদে বসে লাভ কি? আমাদের পদ আছে বলেই না কেউ কেউ আমাদের পাদুকাতলে শান্তি খুঁজে হয়রান। আর সেই পদের বাহার নিয়ে এক কবি তো কবিতাও লিখেছেন, 'আমাদেরও পদের বাহার আছে।' আছেই তো। পদ আছে বলে আমরা যখন-তখন যাকে-তাকে ধরে এনে ধমক দিতে পারি। পদ আছে বলে আমরা সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা বলতে পারি। পদ আছে বলে আমরা পদতলে কুসুম দলে যেতে পারি। পদ আছে বলে আমাদের মাথায় বর্ষিত হয় পুষ্পবৃষ্টি। পদ না থাকলে আমাদের মূল্য কী? কেউ আমাদের দাম দেবে?
পদ আছে বলেই সমাজে আমাদের কদর আছে। যেখানে যাই, লোকজন আদাব-সালাম দেয়। কিন্তু সবাই আবার সবসময় এটা মানতে চায় না। যেমন মানে না ব্যবসায়ীরা। তাদের ডেকে এনে ধমক দিলাম। কারণ ধমক দেওয়ার এখতিয়ার আমাদের আছে। পদ থাকার এই এক সুবিধা। পদ থাকলে ধমক দেওয়া যায়, পদ থাকলে ধারে না কাটলেও পদভারে কাটা যায়। কেবল পদটা থাকতে হবে। সেই ধমকের গমক আবার সহ্য করা গেল না। ধমক দিয়েছিলাম পাবলিকের স্বার্থে। পাবলিক সেটা বুঝতে চায় না। বাজারে একটা সক্রিয় সিন্ডিকেট আছে, এটা সবাই জানেন। এই সিন্ডিকেট আবার অদৃশ্য ভূতের মতো। চেহারা দেখা যায় না, অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। ভূত যেমন দূর থেকে টিনের চালে ঢিল মারে, বাজারের অদৃশ্য সিন্ডিকেট তেমনি দূর থেকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। এই সিন্ডিকেটকে আমরা কোনোভাবেই বাগে আনতে পারিনি। ফলে বাজারকেও বাগে আনতে পারিনি আমরা। ছিঁড়তে পরিনি ভেজালের জাল। চারদিকে ভেজাল। চালে কাঁকর, ডালে রং। তেলে ভেজাল, গুড়ে ভেজাল। ফল খেলে বল-বুদ্ধি, সেই ফলেও কার্বাইড। দুধে, মাছে ফরমালিন। রোজার মাসে ইফতারিতে ভেজাল। বাজারে যে ফ্রুট জুস পাওয়া যায়, সেটা নাকি কুমড়োর ঘ্যাঁট। কোথায়, কিসে ভেজাল নেই? বাজারে এমন কিছু কি পাওয়া যাবে, যাতে ভেজাল নেই! এটা কি আমাদের ব্যর্থতা? না, এটা আমাদের ব্যর্থতা নয়। আমরা যে কাজ করে যাচ্ছি, এটা তারই প্রমাণ। আমরা এক দিন বাজার সিন্ডিকেটের টুঁটি চেপে ধরবই ধরব। ভেজাল দূর করবই করবো। কিন্তু ততদিন তো পাবলিককে বাঁচতে হবে? কেমন করে? সেটা নিয়েই আমাদের কিছু উপদেশ বিতরণের চেষ্টা। আমরা আমাদের পদভারে অনেক কিছুই করতে পেরেছি, পারিনি সিন্ডিকেটকে জব্দ করতে। পদভারে ভেজাল দূর করতে পারিনি। মবিল নামে একটা জিনিস আছে, যেটা গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেটা নাকি ব্যবহার করা হচ্ছে ইফতারিতে। ইফতারিতে মানুষ একটু বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ, ফুলুরি খায়-ভাজাভুজি একটু বেশি পছন্দ করে; ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটা নিচ্ছে। ভেজাল দিচ্ছে। যেমন ইচ্ছে তেমন ভেজাল মিশিয়ে জিনিসপত্র বাজারে ছাড়ছে। ভেজাল সেমাই কারখানা পাওয়া যাচ্ছে। ভেজাল ওষুধের কারখানা আবিষ্কার হচ্ছে। জীবনরক্ষাকারী স্যালাইনেও নাকি ভেজাল! যাব কোথায়? পাবলিককে কী জবাব দেব? এখানে একটু-আধটু পদের সুবিধা নিলে ক্ষতি কি? কোনো ক্ষতি নেই। পদের সুবিধাটা কি, সেটা একটু পাবলিকের জানা দরকার।
পদের আরেক সুবিধা হচ্ছে, যাকে যখন ইচ্ছে উপদেশ বিতরণ করা যায়। অনেকটা বিনা মূল্যে বিতরণের মতো উপদেশ বিতরণ। উপদেশ খয়রাতের আর একটা সুবিধা আছে। উপদেশ বর্ষণ করলে কমে না। বরং এই উপদেশ বর্ষণের মধ্য দিয়ে নিজের পদের গুরুত্ব পাবলিককে বোঝানো যায়। পাবলিক বুঝতে পারে, আমার বা আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। আমরা সব দায়িত্ব সবসময় পালন করতে না পারলেও পাবলিককে সময় ও সুবিধামতো উপদেশ তো দিতে পারি। পাবলিককে বলতে তো পারি, 'ভাই পাবলিক, এটা করা ঠিক হবে না। ওটা করা ঠিক হবে না।' এটা যে আমাদের জাতীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সেটা কোনোভাবেই পাবলিককে বোঝানো যায় না।
কথা হচ্ছিল ভেজাল নিয়ে। পাবলিক সব খাবে। খেয়ে হজম করে ফেলবে, কিন্তু উপদেশ খাবে না। কেন? আরে বাবা, খাওয়ার কী আর কম ঝামেলা! অনেকদিন আগে বিটিভিতে একটা নাটক দেখানো হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের নাটক। সে নাটকে ছিল এক খাদকের চরিত্র। খাদক একটি গরু খাবে। আগের দিন সে সেই গরুটি নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরল। পরদিন সেই গরু জবাই হলো। খাদক খেতে বসল। গরু খেয়ে সে কি হাঁসফাঁস অবস্থা তার। এমন গল্প আরো আছে। ঝিনাইদহ এলাকার গল্প। এক গ্রামে ছিল এক খাদক। গ্রামের যেকোনো বড় ধরনের খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ করা হতো। খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকত সে। যখন আর খেতে পারত না, তখন সে আফসোস করে বলত, 'চোখ তুই তো বলিস খা, পোড়কপালে পেটে যে ধরে না।' এমন খাওয়া-দাওয়ার গল্প খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। ওই যে একটা গল্প আছে, হর্ষবর্ধনের হজম হয় না। সেখানে খাওয়ার যে ফিরিস্তি আছে, সেটা পড়ে তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হবে অনেকেরই। অমন খাওয়া খেলে কেমন করে চলবে! কিংবা ভোজন দক্ষিণার কথাই ধরা যাক। সেই গল্পকে সারবস্তু মেনেই তো আজকের দিনে নানা ধরনের পিল তৈরি হচ্ছে। মানুষ এক দিন পিলপিল করে সেসব খাদ্যের জন্য কিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা যে তাদের ভালো চাই, এটা পাবলিক বুঝতেই চায় না। বুঝলে কি আর এভাবে রি-অ্যাক্ট করে! কী বলেছিলাম? না, একটু কম খেতে বলেছিলাম। কম খেলে তো পাবলিকেরই লাভ। বেশি খেলে তো সবসময়ই ঝামেলা। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সেই ছড়াটির কথাই ধরা যাক, 'হারাধনের আটটি ছেলে/বসলো খেতে ভাত।/ একটির পেট ফেটে গেল/রইল বাকি সাত।' এই যে পুরনো একটি ছড়া এখান থেকেও তো পাবলিক বুঝতে চায় না। পাবলিকের দশা হয়েছে অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের সেই নিবারণ দাসের মতো। ব্যারামে ভুগে বেজায় অরুচি ধরে যায় তার। গণ্ডা বারো লুচি, এক হাঁড়ি দই, দুই কুড়ি সন্দেশ খাওয়ার পরও মুখটা কেমন করে থাকে সে। পাশে বসে যে খাচ্ছিল সে অরুচির এমন খাওয়া দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল। পাছে নিবারণ দাস তাকেও খেয়ে ফেলে, এই ভয়ে! হ্যাঁ এমন লোকের দেখা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, 'দারুণ এক খিদের তাড়ায়/লোকটা ঘোরে পাড়ায় পাড়ায়।/যা কিছু পাচ্ছে খাবার/ চেটেপুটে করছে সাবাড়।/মাংস, পোলাও, কোপ্তা কবাব/কাবার করে দিচ্ছে জবাব।/ লোকটা বটে পেটের নবাব।' খাওয়া নিয়ে গোলাম সারওয়ার লিখেছেন, 'চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়/যখন খুশি তখন খেয়ো/ ভয় কি খেতে ভয় কি!/গব্য ঘৃতে নব্য আদা/একটু মেখে খাও না দাদা/ পেটখানি সদয় কি?' আর হীরক রাজার দেশের রাজকবি তো রাজধর্ম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে, 'ভরপেট না-ও খাই/রাজকর দেওয়া চাই।'
এই কথাটিই আমরা বলতে চেয়েছিলাম। আমাদের উপদেশের মূল বিষয় ছিল এটাই। চারদিকে ভেজালের এত জাল, এই জাল ছিন্ন করতে পারছি না আমরা। কোনোভাবেই পারছি না। সেখানে পাবলিক যদি একটু কম কম খায়, তো বেশিদিন বাঁচার আশা করতে পারে। সে কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম। কী কথার কী অর্থ করে বসল সবাই! একেই বলে কপাল! কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। আমরাও খণ্ডাতে পারিনি। পাবলিক ধরে বসল। আমরা নাকি মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্দশা নিয়ে মস্করা করছি। সেই পুরনো প্রবাদ কেউ মনে রাখে না-'ঊন ভাতে দুনো বল/বেশি খেলে রসাতল'! যাক, পাবলিক খেয়ে খেয়ে তবে রসাতলেই যাক। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব। উপদেশ যখন কেউ শুনবে না, তখন কী আর করা?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
কাজেই যত ঝামেলা এই পাবলিককে নিয়ে। পাবলিক আমাদের চিনল না। একটু চেনার চেষ্টা করতে পারে, করল না। অনেক আগে এক মন্ত্রীর নামের সঙ্গে 'চিনি' শব্দটি খাপে খাপ বসিয়ে দিয়েছিল এই পাবলিক। ভদ্রলোকের বাপ-ঠাকুর্দার আমলের একটা বংশীয় পদবি ছিল। সেই পদবির জায়গা নিয়ে নিল 'চিনি' শব্দটি। এবারও কোথায় চিনি নিয়ে কী যেন হয়েছে, কী হয়নি-পাবলিক অমনি আমাদের নিয়ে গান বেঁধেছে, 'চিনি গো চিনি তোমারে...'। ঠাকুরের গানের কী দুর্গতি আজ ভেবে দেখুন! আরে বাবা, আমাদের তো চিনে রাখতেই হবে। চিনে না রাখলে অসুবিধা হতে পারে। এই যে আমরা এক-একজন এক-একটা পদে বসে আছি, আমাদের পদের একটা ভার আছে না! আমাদের পদভারে যদি একটু মাটি না কাঁপল, তাহলে সে পদে বসে লাভ কি? আমাদের পদ আছে বলেই না কেউ কেউ আমাদের পাদুকাতলে শান্তি খুঁজে হয়রান। আর সেই পদের বাহার নিয়ে এক কবি তো কবিতাও লিখেছেন, 'আমাদেরও পদের বাহার আছে।' আছেই তো। পদ আছে বলে আমরা যখন-তখন যাকে-তাকে ধরে এনে ধমক দিতে পারি। পদ আছে বলে আমরা সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা বলতে পারি। পদ আছে বলে আমরা পদতলে কুসুম দলে যেতে পারি। পদ আছে বলে আমাদের মাথায় বর্ষিত হয় পুষ্পবৃষ্টি। পদ না থাকলে আমাদের মূল্য কী? কেউ আমাদের দাম দেবে?
পদ আছে বলেই সমাজে আমাদের কদর আছে। যেখানে যাই, লোকজন আদাব-সালাম দেয়। কিন্তু সবাই আবার সবসময় এটা মানতে চায় না। যেমন মানে না ব্যবসায়ীরা। তাদের ডেকে এনে ধমক দিলাম। কারণ ধমক দেওয়ার এখতিয়ার আমাদের আছে। পদ থাকার এই এক সুবিধা। পদ থাকলে ধমক দেওয়া যায়, পদ থাকলে ধারে না কাটলেও পদভারে কাটা যায়। কেবল পদটা থাকতে হবে। সেই ধমকের গমক আবার সহ্য করা গেল না। ধমক দিয়েছিলাম পাবলিকের স্বার্থে। পাবলিক সেটা বুঝতে চায় না। বাজারে একটা সক্রিয় সিন্ডিকেট আছে, এটা সবাই জানেন। এই সিন্ডিকেট আবার অদৃশ্য ভূতের মতো। চেহারা দেখা যায় না, অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। ভূত যেমন দূর থেকে টিনের চালে ঢিল মারে, বাজারের অদৃশ্য সিন্ডিকেট তেমনি দূর থেকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। এই সিন্ডিকেটকে আমরা কোনোভাবেই বাগে আনতে পারিনি। ফলে বাজারকেও বাগে আনতে পারিনি আমরা। ছিঁড়তে পরিনি ভেজালের জাল। চারদিকে ভেজাল। চালে কাঁকর, ডালে রং। তেলে ভেজাল, গুড়ে ভেজাল। ফল খেলে বল-বুদ্ধি, সেই ফলেও কার্বাইড। দুধে, মাছে ফরমালিন। রোজার মাসে ইফতারিতে ভেজাল। বাজারে যে ফ্রুট জুস পাওয়া যায়, সেটা নাকি কুমড়োর ঘ্যাঁট। কোথায়, কিসে ভেজাল নেই? বাজারে এমন কিছু কি পাওয়া যাবে, যাতে ভেজাল নেই! এটা কি আমাদের ব্যর্থতা? না, এটা আমাদের ব্যর্থতা নয়। আমরা যে কাজ করে যাচ্ছি, এটা তারই প্রমাণ। আমরা এক দিন বাজার সিন্ডিকেটের টুঁটি চেপে ধরবই ধরব। ভেজাল দূর করবই করবো। কিন্তু ততদিন তো পাবলিককে বাঁচতে হবে? কেমন করে? সেটা নিয়েই আমাদের কিছু উপদেশ বিতরণের চেষ্টা। আমরা আমাদের পদভারে অনেক কিছুই করতে পেরেছি, পারিনি সিন্ডিকেটকে জব্দ করতে। পদভারে ভেজাল দূর করতে পারিনি। মবিল নামে একটা জিনিস আছে, যেটা গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেটা নাকি ব্যবহার করা হচ্ছে ইফতারিতে। ইফতারিতে মানুষ একটু বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ, ফুলুরি খায়-ভাজাভুজি একটু বেশি পছন্দ করে; ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটা নিচ্ছে। ভেজাল দিচ্ছে। যেমন ইচ্ছে তেমন ভেজাল মিশিয়ে জিনিসপত্র বাজারে ছাড়ছে। ভেজাল সেমাই কারখানা পাওয়া যাচ্ছে। ভেজাল ওষুধের কারখানা আবিষ্কার হচ্ছে। জীবনরক্ষাকারী স্যালাইনেও নাকি ভেজাল! যাব কোথায়? পাবলিককে কী জবাব দেব? এখানে একটু-আধটু পদের সুবিধা নিলে ক্ষতি কি? কোনো ক্ষতি নেই। পদের সুবিধাটা কি, সেটা একটু পাবলিকের জানা দরকার।
পদের আরেক সুবিধা হচ্ছে, যাকে যখন ইচ্ছে উপদেশ বিতরণ করা যায়। অনেকটা বিনা মূল্যে বিতরণের মতো উপদেশ বিতরণ। উপদেশ খয়রাতের আর একটা সুবিধা আছে। উপদেশ বর্ষণ করলে কমে না। বরং এই উপদেশ বর্ষণের মধ্য দিয়ে নিজের পদের গুরুত্ব পাবলিককে বোঝানো যায়। পাবলিক বুঝতে পারে, আমার বা আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। আমরা সব দায়িত্ব সবসময় পালন করতে না পারলেও পাবলিককে সময় ও সুবিধামতো উপদেশ তো দিতে পারি। পাবলিককে বলতে তো পারি, 'ভাই পাবলিক, এটা করা ঠিক হবে না। ওটা করা ঠিক হবে না।' এটা যে আমাদের জাতীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সেটা কোনোভাবেই পাবলিককে বোঝানো যায় না।
কথা হচ্ছিল ভেজাল নিয়ে। পাবলিক সব খাবে। খেয়ে হজম করে ফেলবে, কিন্তু উপদেশ খাবে না। কেন? আরে বাবা, খাওয়ার কী আর কম ঝামেলা! অনেকদিন আগে বিটিভিতে একটা নাটক দেখানো হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের নাটক। সে নাটকে ছিল এক খাদকের চরিত্র। খাদক একটি গরু খাবে। আগের দিন সে সেই গরুটি নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরল। পরদিন সেই গরু জবাই হলো। খাদক খেতে বসল। গরু খেয়ে সে কি হাঁসফাঁস অবস্থা তার। এমন গল্প আরো আছে। ঝিনাইদহ এলাকার গল্প। এক গ্রামে ছিল এক খাদক। গ্রামের যেকোনো বড় ধরনের খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ করা হতো। খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকত সে। যখন আর খেতে পারত না, তখন সে আফসোস করে বলত, 'চোখ তুই তো বলিস খা, পোড়কপালে পেটে যে ধরে না।' এমন খাওয়া-দাওয়ার গল্প খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। ওই যে একটা গল্প আছে, হর্ষবর্ধনের হজম হয় না। সেখানে খাওয়ার যে ফিরিস্তি আছে, সেটা পড়ে তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হবে অনেকেরই। অমন খাওয়া খেলে কেমন করে চলবে! কিংবা ভোজন দক্ষিণার কথাই ধরা যাক। সেই গল্পকে সারবস্তু মেনেই তো আজকের দিনে নানা ধরনের পিল তৈরি হচ্ছে। মানুষ এক দিন পিলপিল করে সেসব খাদ্যের জন্য কিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা যে তাদের ভালো চাই, এটা পাবলিক বুঝতেই চায় না। বুঝলে কি আর এভাবে রি-অ্যাক্ট করে! কী বলেছিলাম? না, একটু কম খেতে বলেছিলাম। কম খেলে তো পাবলিকেরই লাভ। বেশি খেলে তো সবসময়ই ঝামেলা। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সেই ছড়াটির কথাই ধরা যাক, 'হারাধনের আটটি ছেলে/বসলো খেতে ভাত।/ একটির পেট ফেটে গেল/রইল বাকি সাত।' এই যে পুরনো একটি ছড়া এখান থেকেও তো পাবলিক বুঝতে চায় না। পাবলিকের দশা হয়েছে অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের সেই নিবারণ দাসের মতো। ব্যারামে ভুগে বেজায় অরুচি ধরে যায় তার। গণ্ডা বারো লুচি, এক হাঁড়ি দই, দুই কুড়ি সন্দেশ খাওয়ার পরও মুখটা কেমন করে থাকে সে। পাশে বসে যে খাচ্ছিল সে অরুচির এমন খাওয়া দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল। পাছে নিবারণ দাস তাকেও খেয়ে ফেলে, এই ভয়ে! হ্যাঁ এমন লোকের দেখা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, 'দারুণ এক খিদের তাড়ায়/লোকটা ঘোরে পাড়ায় পাড়ায়।/যা কিছু পাচ্ছে খাবার/ চেটেপুটে করছে সাবাড়।/মাংস, পোলাও, কোপ্তা কবাব/কাবার করে দিচ্ছে জবাব।/ লোকটা বটে পেটের নবাব।' খাওয়া নিয়ে গোলাম সারওয়ার লিখেছেন, 'চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়/যখন খুশি তখন খেয়ো/ ভয় কি খেতে ভয় কি!/গব্য ঘৃতে নব্য আদা/একটু মেখে খাও না দাদা/ পেটখানি সদয় কি?' আর হীরক রাজার দেশের রাজকবি তো রাজধর্ম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে, 'ভরপেট না-ও খাই/রাজকর দেওয়া চাই।'
এই কথাটিই আমরা বলতে চেয়েছিলাম। আমাদের উপদেশের মূল বিষয় ছিল এটাই। চারদিকে ভেজালের এত জাল, এই জাল ছিন্ন করতে পারছি না আমরা। কোনোভাবেই পারছি না। সেখানে পাবলিক যদি একটু কম কম খায়, তো বেশিদিন বাঁচার আশা করতে পারে। সে কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম। কী কথার কী অর্থ করে বসল সবাই! একেই বলে কপাল! কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। আমরাও খণ্ডাতে পারিনি। পাবলিক ধরে বসল। আমরা নাকি মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্দশা নিয়ে মস্করা করছি। সেই পুরনো প্রবাদ কেউ মনে রাখে না-'ঊন ভাতে দুনো বল/বেশি খেলে রসাতল'! যাক, পাবলিক খেয়ে খেয়ে তবে রসাতলেই যাক। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব। উপদেশ যখন কেউ শুনবে না, তখন কী আর করা?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments