শিশুশিক্ষা হুমকিতে ফেলে সটকে পড়ল তারা by শরিফুল হাসান
প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে বিদ্যালয়প্রতি পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়ে ‘উধাও’ হয়ে গেছে ৪৬টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। ফলে দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকার শিশুদের বিদ্যালয়ে আনার সরকারি উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৪৬টি এনজিওর মধ্যে ঘরণী (গ্রাসরুট হেলথ অ্যান্ড রুরাল অর্গানাইজেশন ফর নিউট্রেশন ইনিশিয়েটিভ) নামে একটি এনজিও একাই নেত্রকোনা জেলায় ২০টি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ও শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর কাজ পেয়েছিল। এ জন্য ১৪ বছর আগে তারা সরকারের কাছ থেকে এক কোটি টাকা নেয়। কিন্তু তারা কোনো বিদ্যালয় পরিচালনা করেনি। সম্প্রতি এই এনজিও জলবায়ু তহবিলের কাজও পেয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চুক্তিভঙ্গের কারণে এই ৪৬টি এনজিওকে ইতিমধ্যে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, এ এনজিওগুলোর নিবন্ধন বাতিলের কাজও শুরু করেছে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও সমাজসেবা অধিদপ্তর।
সরেজমিন: নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার সুবিধাবঞ্চিত একটি গ্রাম সুতিয়ারপাড়া। সরকার এ এলাকার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি স্কুল করার উদ্যোগ নেয়। বেসরকারি সংস্থা ঘরণীকে এ জন্য ১৪ বছর আগে পাঁচ লাখ টাকাও দেওয়া হয়। তাদের করা ভবনে শিক্ষার্থীদের বদলে এখন গরু পালন করা হয়। শ্রেণীকক্ষ ব্যবহূত হয় এলাকার আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে। ঘরণীর মূল কার্যালয় ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে।
নেত্রকোনা জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোক্তার হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এনজিওগুলোর লোভের কারণে সব শেষ হয়ে গেল। তারা স্কুলগুলো না চালিয়ে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আমার নেত্রকোনা জেলায় ৩২টি স্কুলের সব কটিরই একই অবস্থা। বছরের পর বছর ধরে স্কুলগুলো ভেঙেচুরে পড়ে ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমি এনজিওর লোকজনকে অনেকবারই এসব নিয়ে প্রশ্ন করেছি। তারা পালিয়ে পালিয়ে থাকে। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় আমরা কিছু স্কুল চালু করেছি। সেগুলোর নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে সুপারিশও করেছি। কিন্তু অনেকগুলো স্কুল এখনো চালু করা যায়নি।’
দায়িত্ব নেওয়ার পরও স্কুলগুলো কেন চালালেন না, জানতে চাইলে ঘরণীর নির্বাহী পরিচালক রওশন আরা বলেন, ‘এককভাবে আমাদের দোষারোপ করলে তো চলবে না। আমরা যত দিন পেরেছি স্কুলগুলো চালিয়েছি। ভেবেছিলাম, দুই বছরের মধ্যে স্কুলগুলোর রেজিস্ট্রেশন হবে। কিন্তু যথাসময়ে এগুলোকে সরকারীকরণ করা হয়নি। তার পরও আমরা পাঁচ-ছয় বছর স্কুলগুলো চালিয়েছি। পরে এলাকাবাসীর চাপে আমাদের স্কুলগুলোর দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়।’ তিনি দাবি করেন, তাঁদের কোনো ধরনের নোটিশ না দিয়েই কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
গনিপুর এনজিও প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে জামালপুর জেলায় একটি বিদ্যালয়ের কাজ পেয়েছিল বেসরকারি সংস্থা ক্যাটালিস্ট। কিন্তু জেলায় এই নামে কোনো বিদ্যালয় নেই। ঢাকার ১৬ ইন্দিরা রোডে ক্যাটালিস্টের কার্যালয়।
সৈয়দপুর এনজিও প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে আরেকটি বিদ্যালয়ের জন্য সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল আদর্শ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা। কিন্তু জেলায় এই নামেও কোনো বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদের দপ্তর জামালপুরের মাদারগঞ্জে।
শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে ভারুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরির জন্য পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছিল সোনালী কল্যাণ সংঘ (এসকেএস)। কিন্তু সেখানে এই নামে কোনো বিদ্যালয় চালু নেই। তবে একটি ঘর আছে। সেটি এখন গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার করছে স্থানীয় তিনটি পরিবার। শেরপুরের দক্ষিণ গান্ধীগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মাণের কাজটিও পেয়েছিল এই এনজিও। সেখানেও একই অবস্থা। শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে এদের মূল কার্যালয়।
কেন এই উদ্যোগ: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে ২০৩টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকারের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে ২০০৩-০৪ অর্থবছরের মধ্যে স্কুলগুলো করার কথা ছিল। একেকটি স্কুল নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা। এই স্কুল নির্মাণ ও পরিচালনার কথা ছিল নির্বাচিত এনজিওগুলোর। কিন্তু অধিকাংশ এনজিও স্কুল নির্মাণ না করে অথবা শিক্ষা কার্যক্রম না চালিয়ে টাকা নিয়ে গেছে। কয়েকটি এনজিও স্কুল নির্মাণ করলেও সেগুলো চালাচ্ছে না। ফলে ভবনগুলো আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা: মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য চুক্তি হলেও ১১৮টি স্কুলের কার্যক্রম এখন বন্ধ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১১০টি স্কুলের মধ্যে ৬০টি, রাজশাহী বিভাগের ৩৯টির মধ্যে ২২টি, বরিশাল বিভাগে ২৬টির মধ্যে ১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২টির মধ্যে পাঁচটি, সিলেটের পাঁচটির মধ্যে তিনটি এবং খুলনার ১১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে আটটি এখন বন্ধ। বাকিগুলো এলাকাবাসীর উদ্যোগে ও সরকারের সহায়তায় নতুন করে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এগুলোর নিবন্ধন-প্রক্রিয়া চলছে।
প্রশাসন যা বলে: বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের টাকা নিয়ে স্কুল না করা দুঃখজনক। উপজেলা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। সর্বশেষ তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করছি। এরপর এ বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাবে।’
এখন পর্যন্ত যে চিত্র পেয়েছেন, সে সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাইলে মুহাম্মদ আবদুল হালিম বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা অনেক স্কুল খুঁজে পায়নি। ইতিমধ্যেই আমরা ৪৬টি এনজিওকে চিহ্নিত করেছি। গত আগস্ট মাসেই এই এনজিওগুলোর নিবন্ধন বাতিলের জন্য এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে আরও কাজ করছি।’
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক নূরন্নবী তালুকদার বলেন, ‘ব্যুরোর এনজিওগুলোর নিবন্ধন আমরা ইতিমধ্যেই বাতিল করেছি। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে যারা নিবন্ধন নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সমাজসেবা অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে।’
সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে টাকা নিয়েও এনজিওগুলো কেন কাজ করছে না—জানতে চাইলে ফেডারেশন অব এনজিওস ইন বাংলাদেশের (এফএনবি) পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবারই দেখা যায়, সরকারিভাবে যখন কোনো কাজে টাকা দেওয়া হয়, তখন রাতারাতি কিছু এনজিও নিবন্ধন নিয়ে নেয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ এনজিওগুলো কাজ পায়। পরে টাকা নিয়ে রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। আর বদনাম হয় পুরো এনজিও খাতের।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে বলেছি, অনেকবার যেকোনো এনজিওকে কাজ দেওয়ার আগে তাদের অতীতের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা বিবেচনা করুন। কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে তো মানা হয় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যত দূর মনে পড়ে, এই এনজিওগুলোকে কাজ দেওয়ার সময়েই আমরা আপত্তি করেছিলাম। আসলে যে কাউকে যেকোনো কাজ দেওয়ার আগে একটু যাচাই-বাছাই করে নেওয়া উচিত।’
কালো তালিকাভুক্ত ৪৬ এনজিও: সরকারের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে ৪৬টি এনজিওকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এই এনজিওগুলো হলো ঘরণী, গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, জাগরণী সমাজকল্যাণ সমিতি, শ্যাডো, উইমেন ডেভেলপমেন্ট অর্গাইনাইজেশন, সার্ভিয়ার এনভায়রনমেন্ট অব বাংলাদেশ, ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, সোনালী কল্যাণ সংঘ, দারিদ্র্য নিরোধ কার্যক্রম, সিরাক, মহিলা ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা, দিশারী সমাজ ও মানবকল্যাণ সংস্থা, সহায়তা, ক্যাটালিস্ট (ইন্দিরা রোডে দপ্তর), আদর্শ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা, সমাজ পরিবর্তন কেন্দ্র, দিলরুল সোশ্যাল অ্যাসোসিয়েশন্স ফর অ্যাডভান্সডমেন্ট, সাইন, ফোড, ছিন্নমূল মহিলা সমিতি, বেঙ্গল স্টার এরিয়া ওয়ার্ক সোসাইটি, দেশশ্রী উন্নয়ন সংস্থা (বগুড়া), রূপসী বাংলা, আল ফালাহ গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, বৈচি সমাজসেবা ক্লাব ও পাঠাগার, বাকেরগঞ্জ থানা কল্যাণ সমিতি, রামপুরা দুই তারা সংসদ, গণউন্নয়ন সংস্থা, ইনডিজেন্ট সোশ্যাল অ্যাডভান্সডমেন্ট ফাউন্ডেশন, বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থা, সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র, দেশশ্রী উন্নয়ন সংস্থা (ভোলা), বড় রঘুনাথপুর শেরেবাংলা ক্লাব, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা, বরিশাল পটুয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, চানপুর সমাজকল্যাণ পরিষদ, এনাবল ডেভেলপমেন্ট ফর দি পুওর, নিড বাংলাদেশ, সুহূদ সংঘ, সামাজিক প্রগতি ও সংস্কার প্রকল্প, অভীষ্টগণ উন্নয়ন প্রক্রিয়া, জনকল্যাণ সমিতি, আর্তমানবতা উন্নয়ন সংস্থা, ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ও শাপলা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা।
এনজিওবিষয়ক বু্যুরোর মহাপরিচালক নূরন্নবী তালুকদার জানান, ঘরণী, গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, জাগরণী, শ্যাডো, ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, আদর্শ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা, সমাজ পরিবর্তন কেন্দ্র, সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র, অভীষ্টগণ উন্নয়ন প্রক্রিয়া, আর্তমানবতা উন্নয়ন সংস্থা ও শাপলা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা এনজিও ব্যুরো থেকে নিবন্ধন নেওয়া। এর মধ্যে শ্যাডো ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। বাকিগুলোর নিবন্ধনও বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চুক্তিভঙ্গের কারণে এই ৪৬টি এনজিওকে ইতিমধ্যে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, এ এনজিওগুলোর নিবন্ধন বাতিলের কাজও শুরু করেছে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও সমাজসেবা অধিদপ্তর।
সরেজমিন: নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার সুবিধাবঞ্চিত একটি গ্রাম সুতিয়ারপাড়া। সরকার এ এলাকার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি স্কুল করার উদ্যোগ নেয়। বেসরকারি সংস্থা ঘরণীকে এ জন্য ১৪ বছর আগে পাঁচ লাখ টাকাও দেওয়া হয়। তাদের করা ভবনে শিক্ষার্থীদের বদলে এখন গরু পালন করা হয়। শ্রেণীকক্ষ ব্যবহূত হয় এলাকার আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে। ঘরণীর মূল কার্যালয় ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে।
নেত্রকোনা জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোক্তার হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এনজিওগুলোর লোভের কারণে সব শেষ হয়ে গেল। তারা স্কুলগুলো না চালিয়ে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আমার নেত্রকোনা জেলায় ৩২টি স্কুলের সব কটিরই একই অবস্থা। বছরের পর বছর ধরে স্কুলগুলো ভেঙেচুরে পড়ে ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমি এনজিওর লোকজনকে অনেকবারই এসব নিয়ে প্রশ্ন করেছি। তারা পালিয়ে পালিয়ে থাকে। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় আমরা কিছু স্কুল চালু করেছি। সেগুলোর নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে সুপারিশও করেছি। কিন্তু অনেকগুলো স্কুল এখনো চালু করা যায়নি।’
দায়িত্ব নেওয়ার পরও স্কুলগুলো কেন চালালেন না, জানতে চাইলে ঘরণীর নির্বাহী পরিচালক রওশন আরা বলেন, ‘এককভাবে আমাদের দোষারোপ করলে তো চলবে না। আমরা যত দিন পেরেছি স্কুলগুলো চালিয়েছি। ভেবেছিলাম, দুই বছরের মধ্যে স্কুলগুলোর রেজিস্ট্রেশন হবে। কিন্তু যথাসময়ে এগুলোকে সরকারীকরণ করা হয়নি। তার পরও আমরা পাঁচ-ছয় বছর স্কুলগুলো চালিয়েছি। পরে এলাকাবাসীর চাপে আমাদের স্কুলগুলোর দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়।’ তিনি দাবি করেন, তাঁদের কোনো ধরনের নোটিশ না দিয়েই কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
গনিপুর এনজিও প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে জামালপুর জেলায় একটি বিদ্যালয়ের কাজ পেয়েছিল বেসরকারি সংস্থা ক্যাটালিস্ট। কিন্তু জেলায় এই নামে কোনো বিদ্যালয় নেই। ঢাকার ১৬ ইন্দিরা রোডে ক্যাটালিস্টের কার্যালয়।
সৈয়দপুর এনজিও প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে আরেকটি বিদ্যালয়ের জন্য সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল আদর্শ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা। কিন্তু জেলায় এই নামেও কোনো বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদের দপ্তর জামালপুরের মাদারগঞ্জে।
শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে ভারুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরির জন্য পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছিল সোনালী কল্যাণ সংঘ (এসকেএস)। কিন্তু সেখানে এই নামে কোনো বিদ্যালয় চালু নেই। তবে একটি ঘর আছে। সেটি এখন গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার করছে স্থানীয় তিনটি পরিবার। শেরপুরের দক্ষিণ গান্ধীগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মাণের কাজটিও পেয়েছিল এই এনজিও। সেখানেও একই অবস্থা। শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে এদের মূল কার্যালয়।
কেন এই উদ্যোগ: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে ২০৩টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকারের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে ২০০৩-০৪ অর্থবছরের মধ্যে স্কুলগুলো করার কথা ছিল। একেকটি স্কুল নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা। এই স্কুল নির্মাণ ও পরিচালনার কথা ছিল নির্বাচিত এনজিওগুলোর। কিন্তু অধিকাংশ এনজিও স্কুল নির্মাণ না করে অথবা শিক্ষা কার্যক্রম না চালিয়ে টাকা নিয়ে গেছে। কয়েকটি এনজিও স্কুল নির্মাণ করলেও সেগুলো চালাচ্ছে না। ফলে ভবনগুলো আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা: মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য চুক্তি হলেও ১১৮টি স্কুলের কার্যক্রম এখন বন্ধ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১১০টি স্কুলের মধ্যে ৬০টি, রাজশাহী বিভাগের ৩৯টির মধ্যে ২২টি, বরিশাল বিভাগে ২৬টির মধ্যে ১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২টির মধ্যে পাঁচটি, সিলেটের পাঁচটির মধ্যে তিনটি এবং খুলনার ১১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে আটটি এখন বন্ধ। বাকিগুলো এলাকাবাসীর উদ্যোগে ও সরকারের সহায়তায় নতুন করে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এগুলোর নিবন্ধন-প্রক্রিয়া চলছে।
প্রশাসন যা বলে: বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের টাকা নিয়ে স্কুল না করা দুঃখজনক। উপজেলা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। সর্বশেষ তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করছি। এরপর এ বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাবে।’
এখন পর্যন্ত যে চিত্র পেয়েছেন, সে সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাইলে মুহাম্মদ আবদুল হালিম বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা অনেক স্কুল খুঁজে পায়নি। ইতিমধ্যেই আমরা ৪৬টি এনজিওকে চিহ্নিত করেছি। গত আগস্ট মাসেই এই এনজিওগুলোর নিবন্ধন বাতিলের জন্য এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে আরও কাজ করছি।’
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক নূরন্নবী তালুকদার বলেন, ‘ব্যুরোর এনজিওগুলোর নিবন্ধন আমরা ইতিমধ্যেই বাতিল করেছি। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে যারা নিবন্ধন নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সমাজসেবা অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে।’
সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে টাকা নিয়েও এনজিওগুলো কেন কাজ করছে না—জানতে চাইলে ফেডারেশন অব এনজিওস ইন বাংলাদেশের (এফএনবি) পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবারই দেখা যায়, সরকারিভাবে যখন কোনো কাজে টাকা দেওয়া হয়, তখন রাতারাতি কিছু এনজিও নিবন্ধন নিয়ে নেয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ এনজিওগুলো কাজ পায়। পরে টাকা নিয়ে রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। আর বদনাম হয় পুরো এনজিও খাতের।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে বলেছি, অনেকবার যেকোনো এনজিওকে কাজ দেওয়ার আগে তাদের অতীতের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা বিবেচনা করুন। কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে তো মানা হয় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যত দূর মনে পড়ে, এই এনজিওগুলোকে কাজ দেওয়ার সময়েই আমরা আপত্তি করেছিলাম। আসলে যে কাউকে যেকোনো কাজ দেওয়ার আগে একটু যাচাই-বাছাই করে নেওয়া উচিত।’
কালো তালিকাভুক্ত ৪৬ এনজিও: সরকারের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে ৪৬টি এনজিওকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এই এনজিওগুলো হলো ঘরণী, গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, জাগরণী সমাজকল্যাণ সমিতি, শ্যাডো, উইমেন ডেভেলপমেন্ট অর্গাইনাইজেশন, সার্ভিয়ার এনভায়রনমেন্ট অব বাংলাদেশ, ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, সোনালী কল্যাণ সংঘ, দারিদ্র্য নিরোধ কার্যক্রম, সিরাক, মহিলা ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা, দিশারী সমাজ ও মানবকল্যাণ সংস্থা, সহায়তা, ক্যাটালিস্ট (ইন্দিরা রোডে দপ্তর), আদর্শ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা, সমাজ পরিবর্তন কেন্দ্র, দিলরুল সোশ্যাল অ্যাসোসিয়েশন্স ফর অ্যাডভান্সডমেন্ট, সাইন, ফোড, ছিন্নমূল মহিলা সমিতি, বেঙ্গল স্টার এরিয়া ওয়ার্ক সোসাইটি, দেশশ্রী উন্নয়ন সংস্থা (বগুড়া), রূপসী বাংলা, আল ফালাহ গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, বৈচি সমাজসেবা ক্লাব ও পাঠাগার, বাকেরগঞ্জ থানা কল্যাণ সমিতি, রামপুরা দুই তারা সংসদ, গণউন্নয়ন সংস্থা, ইনডিজেন্ট সোশ্যাল অ্যাডভান্সডমেন্ট ফাউন্ডেশন, বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থা, সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র, দেশশ্রী উন্নয়ন সংস্থা (ভোলা), বড় রঘুনাথপুর শেরেবাংলা ক্লাব, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা, বরিশাল পটুয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, চানপুর সমাজকল্যাণ পরিষদ, এনাবল ডেভেলপমেন্ট ফর দি পুওর, নিড বাংলাদেশ, সুহূদ সংঘ, সামাজিক প্রগতি ও সংস্কার প্রকল্প, অভীষ্টগণ উন্নয়ন প্রক্রিয়া, জনকল্যাণ সমিতি, আর্তমানবতা উন্নয়ন সংস্থা, ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ও শাপলা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা।
এনজিওবিষয়ক বু্যুরোর মহাপরিচালক নূরন্নবী তালুকদার জানান, ঘরণী, গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, জাগরণী, শ্যাডো, ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, আদর্শ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা, সমাজ পরিবর্তন কেন্দ্র, সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র, অভীষ্টগণ উন্নয়ন প্রক্রিয়া, আর্তমানবতা উন্নয়ন সংস্থা ও শাপলা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা এনজিও ব্যুরো থেকে নিবন্ধন নেওয়া। এর মধ্যে শ্যাডো ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। বাকিগুলোর নিবন্ধনও বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে।
No comments