নাট্যজনের নাট্যকর্ম by মান্নান হীরা
এসএম সোলায়মানকে নিয়ে উচ্চারিত বাক্যগুলোর মধ্যে দেখা যায়, প্রায় সবাই বলেছেন তিনি অর্থাৎ সোলায়মান ছিলেন খ্যাপা এবং অভিমানী। একথা আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ নয়। আমরা এও জানি যে, এসএম সোলায়মান তার প্রায় সব নাটকে মৌলবাদ, সাল্ফপ্রদায়িকতা, সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ভীষণ তির্যক কটূক্তি করেছেন।
এসবের বিরুদ্ধে নাট্য নির্মাণে সোলায়মানের একটি নিজস্ব ঢং বা রীতি ছিল, যা অন্য সবার থেকে ভিন্ন। সোলায়মান যতদিন নাট্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ততদিনই অর্থাৎ আমৃত্যু দেশটি কুশাসনে ছিল। মৌলবাদ ও সাল্ফপ্রদায়িকতাকে সোলায়মান কেবলই রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন সামগ্রিক পশ্চাৎপদতার আধার হিসেবে। তাই এর বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল আমরণ। সোলায়মান ধর্মান্ধতা নিয়ে অনেক নাটক নির্মাণ করেছেন, তার উপস্থাপনার ঢং ছিল ভিন্নধারার। অত্যন্ত প্রহসন, হাস্যরস-কৌতুকমাখা তির্যক সংলাপ ও সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতি ও শিল্পের জটিল সব চরিত্র নির্মাণ করতেন। চরিত্রগুলোকে নানা স্তরে বুনে বুনে দর্শকদের জন্য করে তুলতেন স্বচ্ছ, সহজ ও বোধগম্য। চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে মঞ্চের ওপর যা কিছু ক্রিয়া করে তা বিনোদনমুখী ও হাস্য রসাত্মক হলেও দর্শকের স্মৃতিতে দীর্ঘস্থায়ী আসন করে নিতে পারত। এসএম সোলায়মান দেশ ও বিশ্বে মৌলবাদ ও সাল্ফপ্রদায়িকতার উত্থান দেখেছিলেন, তারই আলোকে তিনি নাটকের মাধ্যমে ও প্রগতিশীল রাজনীতির লড়াইয়ের মাধ্যমে এর অবসান চেয়েছেন। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদসহ সব স্বৈরশাসনের প্রতি সোলায়মানের ছিল ঘৃণা, ক্ষোভ এবং প্রতিহিংসা। প্রতিহিংসাকে তিনি শিল্প ও রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করতে চেয়েছিলেন। শত্রুর প্রতি তার কোনো অভিমান ছিল না। ছিল লড়াই করার প্রস্তুতি ও প্রতিজ্ঞা।
এসএম সোলায়মান মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। মার্কসবাদী শিল্পের ধারাও তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং তারই আলোকে তিনি জীবন, শিল্প ও রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করতেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ধারা ও ব্যবস্থার যে বিপর্যয় দেখা দেয় তাতে সোলায়মানও অনেকের মতো বিচলিত হয়েছিলেন। বলা যায় বিপর্যস্ত হয়েছিলেন_ এ শঙ্কা তার মধ্যে আরও আগ থেকেই কাজ করছিল। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক নানা সংকটে যখন সোলায়মান দোদুল্যমান তখন এ বিশ্ব সংকট তাকে দিশেহারা করে তোলে। রাজনৈতিক তত্ত্ব, তারই পথ ধরে শিল্পের ধারা_ এসব খুঁজে ফিরতে তিনি ভীষণ তাড়িত হন। তার এত দিনের বিশ্বাস যা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত, সেটায় ফাটল ধরায় তার মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব তৈরি হয়। এ অসহায়ত্বের সময় তার রাজনৈতিক ও শিল্পের বন্ধুদের কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা খুঁজে পাননি সোলায়মান। সোলায়মানের মার্কসবাদের প্রতি এত প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল, যা থেকে সরে আসা বা নিজের রূপান্তর ঘটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অসম্ভবতাকে অনেকে বলেন মূর্খতা, গোঁড়ামি বা হেঁয়ালি। মনে হয়, সোলায়মান হয়তো তাদেরই দলভুক্ত ছিলেন। পূর্ব ইউরোপসহ নানা দেশে যখন পুঁজিবাদ নতুন করে সিংহাসন দখল করে তখন আমাদের দেশেও তার ঢেউ লেগেছিল। জন্ম থেকে লালন করা বৈজ্ঞানিক দর্শনে বিশ্বাসী মানুষ তখন কেমন ছিল, কেউ তার খবর রাখেনি। না কোনো সংগঠন, না কোনো ব্যক্তি মানুষ। তাই এদের অনেকেই হারিয়ে যায়, অনেকে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলে, অনেকে আজও মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে আছে। সোলায়মান নিঃসঙ্গতায় পতিত হয়। আর নিঃসঙ্গতা হলো সামাজিক ব্যাধি। কেউ কেউ তাকে শিক্ষা, মেধা, ধৈর্য ও কৌশল দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। তারা টিকে থাকে, বেঁচে থাকে।
এসএম সোলায়মানের মৃত্যুর ১০ বছর পর আমাদের তাকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি করণীয় হলো সোলায়মানের সৃষ্ট নাট্যধারাকে সচল রাখা। সোলায়মানের নাটক দেশব্যাপী অনেক পরিমাণে অভিনীত হওয়া দরকার। সে সঙ্গে প্রয়োজন সোলায়মানের নাট্যভাবনা, শিল্পভাবনা, নাট্য নির্মাণ রীতিকে টিকিয়ে রাখতে বেশি করে তার ধারার নাটক নির্মাণের। এটি কেবল এসএম সোলায়মানকে ইতিহাসে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে নয়, প্রয়োজন বাংলা নাটকের অস্তিত্বের কারণে। কারণ সোলায়মানের নাট্য প্রচেষ্টার ধারা মূলত জনপ্রিয় ধারা। আর সে জনপ্রিয় ধারাটি তৈরি হয়েছে মানুষের সংগ্রাম, সংহতি, প্রেম ও বিজ্ঞান থেকে। এসএম সোলায়মান জীবিত অবস্থায় যে বিশ্ব পরিস্থিতি দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, আগুন জ্বেলেছিলেন মঞ্চে ও পথে, সে পরিস্থিতি আজ আরও ভয়াবহ, সংকটাপন্ন ও বিপদগ্রস্ত। সোলায়মান আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে দর্শককে জাগ্রত করে তাদের সঙ্গে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হয়।
No comments