পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এক শিক্ষকের দিনে ১০ ক্লাস! by নিজাম সিদ্দিকী

২০০৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে দ্বিতীয় পালায় পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। কিন্তু এ জন্য বাড়তি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আগের শিক্ষকেরাই দ্বিতীয় পালার ক্লাস নিচ্ছেন। এমনিতেই ইনস্টিটিউটগুলোতে চলছে শিক্ষকসংকট, তার ওপর দ্বিতীয় পালার ক্লাস নিতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকেরা।


সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, একজন শিক্ষককে দিনে সর্বোচ্চ ১০টি পর্যন্ত ক্লাস নিতে হচ্ছে। টানা ক্লাস নিতে গিয়ে তাঁরা মানসম্মত পাঠদান করতে পারছেন না।
এদিকে আট দফা দাবিতে গত ৮ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি (বাপশিস) ও বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক পরিষদ (বাপশিপ) নামে শিক্ষকদের দুটি সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করেছে। শিক্ষকদের অন্যতম দাবি হচ্ছে: শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদবি পরিবর্তন।
সূত্র জানায়, দেশে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৪৯। এর মধ্যে পুরোনো ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ২০, যেগুলো পুরোপুরি সরকারি। নতুন রাজস্বভুক্ত ইনস্টিটিউটের সংখ্যা পাঁচ, মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট তিন, প্রকল্পভুক্ত ১৮ ও মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা তিন।
সূত্রমতে, ২০০৪ সালের ২৪ অক্টোবর ২০টি পুরোনো ইনস্টিটিউট ও তিনটি মনোটেকনিকে দ্বিতীয় পালা চালু করা হয়। ২০১০ সাল থেকে বাকি সব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে দ্বিতীয় পালার কাজ শুরু করা হয়। এতে শিক্ষার্থী বাড়লেও শিক্ষক না বাড়ায় ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষকে দ্বিতীয় পালা চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রথম পালার ক্লাস হয় সকাল আটটা থেকে বেলা একটা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পালার ক্লাস হয় বেলা একটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। সূত্রমতে, শিক্ষকসংকটের কারণে একজন শিক্ষককে প্রতি সপ্তাহে ২০-২৪টি ক্লাসের পরিবর্তে ৪৫-৬৫টি পর্যন্ত ক্লাস নিতে হয়। এতে শিক্ষকদের পক্ষে ক্লাস নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এর আগে ২০০৪ সালে শিক্ষকদের বাড়তি পরিশ্রমের কথা বিবেচনা করে সরকার মূল বেতনের ৪০ শতাংশ সম্মানী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ৩০ শতাংশ হারে সম্মানী নির্ধারণ করে। তবে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সম্মানী দেওয়া বন্ধ বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক পরিষদের (বাপশিপ) কেন্দ্রীয় সভাপতি ফকির মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষকদের পক্ষে দ্বিতীয় পালার কাজ চালানোর বিষয়টি সত্যিই অমানবিক। একজন শিক্ষককে সপ্তাহে ৬৫টি পর্যন্ত ক্লাস নিতে হচ্ছে। দিনে ১০টিরও বেশি।’ তিনি বলেন, পরিশ্রম করলেও ১৪ মাস ধরে তাঁরা ৩০ শতাংশ সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন না। তিনি শিক্ষকদের সম্মানী ১০০ শতাংশে উন্নীত করার দাবি জানান।
শিক্ষকসংকট: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, ২০টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এক হাজার ২৪৬ জন শিক্ষক পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৫৬০ জন। অন্যদিকে প্রকল্পভুক্ত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে শতকরা ৭০-৮০ শতাংশ পদ খালি বলে জানা গেছে।
২০টি পুরোনো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মধ্যে আটটিতেই অধ্যক্ষের পদ খালি। এগুলো হলো: কুমিল্লা, কাপ্তাই, ফেনী, পটুয়াখালী, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া ও যশোর। প্রকল্পভুক্ত পলিটেকনিকগুলোর বেশির ভাগেরই অধ্যক্ষ নেই।
পাঁচটি রাজস্বভুক্ত পলিটেকনিকের মধ্যে শুধু ফেনী কম্পিউটার ইনস্টিটিউট ছাড়া বাকি চারটিতে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। প্রেষণে শিক্ষক পাঠিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এগুলো হলো: মৌলভীবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও মাগুরা।
এদিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে নির্মাণ কৌশল ও মেডিকেল টেকনোলজি বিভাগ চালু হলেও কোনো শিক্ষক নিয়োগ না থাকায় এর কোনো কার্যক্রম নেই।
প্রকল্পভুক্ত পলিটেকনিকগুলো রাজস্ব খাতে না যাওয়ায় এখানে পদ পূরণের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না।
জানা গেছে, ২০টি পুরোনো ইনস্টিটিউটে সর্বশেষ ২০০৬ সালে ১১০ জন ও ২০০৯ সালে ৩৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পর আর কোনো নিয়োগ হয়নি।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২০টি পলিটেকনিকের আধুনিকায়ন, ১৮টি নতুন ও তিন বিভাগে তিনটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয়। পরবর্তী সরকার প্রকল্পের কাজ শেষ করলেও নিয়োগ করা জনবল রাজস্ব খাতভুক্ত করেনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি (বাপশিস) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘বর্তমান সরকার বিশেষ বাংলাদেশ গেজেট (এসআরও) জারির মাধ্যমে প্রকল্পভুক্ত পলিটেকনিকগুলো রাজস্ব খাতে নেওয়ার নির্দেশনা দিলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা পিছিয়ে আছে।’
শিক্ষক আন্দোলন: দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গত ৮ জানুয়ারি থেকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকেরা মাঠে নেমেছেন। শিক্ষকদের আট দফা দাবির মধ্যে আরও রয়েছে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের চাকরি স্থায়ী করা, প্রকল্পভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর পদ জনবলসহ রাজস্ব খাতে স্থানান্তর, শিক্ষার্থীদের বৃত্তির কোটা ১০০ ভাগে উন্নীত করা।
বাপশিস কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, এসব দাবি মানা না হলে কারিগরি শিক্ষার অগ্রগতি পিছিয়ে যাবে।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১৯৫৫ সাল থেকে শিক্ষকদের পদবি জুনিয়র ইনস্ট্রাকক্টর, ইনস্ট্রাক্টর, চিফ ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে বিন্যাস করা আছে। কিন্তু উচ্চতর পদের সংখ্যা কম হওয়ায় পদোন্নতির সুযোগ কম থাকে। তাই এই কাঠামো পরিবর্তন করে জুনিয়র প্রভাষক, প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, অধ্যাপক হিসেবে পদ বিন্যাসের দাবি করা হয়।
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আনুষঙ্গিক বিভাগের (নন টেকনিক্যাল) জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর মাঈনুল হক সিরাজী বলেন, ‘আমাদের বর্তমান চাকরিকাঠামোর কারণে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর থেকে চিফ ইনস্ট্রাক্টর হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। কারণ পদের সংখ্যা সীমিত। কিন্তু পদ পরিবর্তন করা হলে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কাসেম বলেন, ‘শিক্ষকদের এসব দাবি যুক্তিসংগত, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি-দাওয়ার কথা বলে আসছেন। সরকার এসব বিষয় অবহিত আছে।’

No comments

Powered by Blogger.