হরতাল-অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মসূচি
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে হরতাল শুধু যে গুরুত্ব হারিয়েছে তা নয়, নাগরিকরা নানাভাবে এ কর্মসূচির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আসছেন। এই অনাস্থার পেছনের কারণগুলো সবার জানা। কর্মতৎপরতার স্বাভাবিক গতি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে ব্যাহত হোক তা কারও কাছেই প্রত্যাশিত নয়।
অথচ হরতালে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, স্বাভাবিক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে, অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কাজ বিঘি্নত হয়। হরতাল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াওসহ নানা ধরনের সহিংসতার বিস্তার ঘটে। সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বলে হরতাল দেওয়া হলেও আখেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষই। কাজে না নামলে যাদের আহার জোগাড় হয় না, তাদের জন্য হরতাল বিভীষিকার নাম। তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবারের হরতাল ডেকেছে বিএনপি। তাতে সমমনা দলগুলো সমর্থন দিয়েছে। এ কথা সত্য যে, তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব বাজারে পড়েছে। যানবাহনে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে চিন্তিত করে তুলেছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। সংসদে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। সংসদের বাইরেও আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু তা না করে মূল্যবৃদ্ধি যাদের জীবনকে অস্থির করে তুলেছে তাদের ওপর হরতাল চাপানোর যৌক্তিকতা কী? বিশ্লেষকরা মনে করেন, হরতাল রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সবচেয়ে সহজ কর্মসূচি। হরতাল ডেকে দিলেই পালিত হয় বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঝোঁক থাকে হরতালের প্রতি। অবশ্য শুধু হরতাল ডেকে নিরস্ত্র থাকার রেওয়াজ এখানে নেই। হরতালের আগের সন্ধ্যায় বাস-গাড়ি পোড়ানোর অসুস্থ সংস্কৃতি চালু হয়েছে। নাগরিক জীবনে ভীতি সঞ্চারের এ পদ্ধতি অবশ্যই বর্জিত হওয়া উচিত। মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করে, তাদের পথ চলতে বাধা দেয় এমন কর্মসূচিতে রাজনৈতিক ফললাভ কঠিন। বরং মানুষের কাছে গিয়ে তাদের প্রকৃত সমস্যার কথা শুনে সংসদে উপস্থাপন করলে তা যথাযথ বলে বিবেচিত হতো। সংসদ ছাড়াও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির উপায় আছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনমত গঠন করে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো যায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেখা মিলছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল ক্ষমতায় থাকাকালে হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও বিরোধী দলে গিয়ে সে প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করেনি। সম্প্রতি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। তা না করে সহসা হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দেওয়ায় অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনার প্রতিবাদই আসল উদ্দেশ্য, তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নয়। সংকীর্ণ দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থের বদলে বিরোধী দল জনজীবনের সমস্যার কথা অন্তত মুখে বলেছে, এটি নাগরিকদের খুশির কারণ হতে পারে। কিন্তু এ আনন্দ আরও অর্থপূর্ণ হতো যদি হরতাল না ডেকে শান্তিপূর্ণ কোনো কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হতো। বিরোধী দলের মধ্যে হরতালবিরোধী উপলব্ধি আসবে; রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচিটি বর্জিত হলে সেটি হবে খুবই আশাপ্রদ ঘটনা।
No comments