বর্ষায় জলাবদ্ধতাই ঢাকার নিয়তি by ধরিত্রী সরকার সবুজ
দুই দিনের বৃষ্টিতেই রাজধানীর বেশ কিছু অংশের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেল। জলাবদ্ধতা গ্রাস করল ঢাকা নগরীর বড় বড় সড়ক ও লোকালয়। বৃষ্টির পানি জমা হয়ে রাজধানীবাসীর জীবনযাত্রা ফেলে দিল চরম দুর্ভোগের মধ্যে। বর্ষাকালে ঢাকা নগরীতে এ দৃশ্য কিন্তু নতুন নয়। কয়েক বছর ধরে বর্ষাকালে ভারি বৃষ্টিপাত হলেই মাঝেমধ্যে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়। কারণ অপরিকল্পিত ঢাকা নগরীতে বৃষ্টির পানি বের হওয়ার উপযুক্ত কোনো পথ নেই।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং অপর্যাপ্ত ও অরক্ষিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাজধানীকে আজ জলাবদ্ধতার নগরীতে পরিণত করেছে। এ কথা সত্য যে রাজধানীর এই জলাবদ্ধতার চিত্র দেখা যায় বর্ষাকালে এবং সে সময় এ নিয়ে বেশ আলোচনা এবং অত্যন্ত অপরিকল্পিত ও ক্ষণস্থায়ী কিছু কার্যক্রমও চোখে পড়ে পানি অপসারণের জন্য। কিন্তু ঢাকা নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ সহজসাধ্য ও স্বল্পদিনের কাজ নয়। শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ড্রেনেজ সংস্কার, খাল খনন ও রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ ঠিকমতো না করলে নগরবাসীর এ দুর্ভোগ কখনোই কমবে না।
ঢাকার মালিবাগ, শান্তিনগর ও সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বাসাবো-গোড়ান এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাতের পর আর ঢোকা যায় না রাস্তার ওপর পানি জমার কারণে। কল্যাণপুর-মিরপুর বৃষ্টির পানিতে অনেক সময়ই ডুবে থাকে। ঢাকার নিকটবর্তী ডিএনডি বাঁধের ভেতর জলাবদ্ধতা আজ এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নত দেশগুলোতেও ভারি বৃষ্টিপাতে রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে সেসব দেশের শহরগুলোয় বৃষ্টিপাতের পরই পানি সরে যায়। কারণ সেখানে পানি নিষ্কাশনের উন্নত ব্যবস্থা আছে। আমাদের ঢাকায় বৃষ্টির জমাট পানি সেভাবে সরে না, সরে যাওয়ার রাস্তা পায় না। ফলে অনেক সময় অনেক এলাকায় পানি দু-তিন দিন পর্যন্ত জমে থাকে। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা যে একটি জাতীয় সমস্যা, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েক বছর ধরে এ সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। তবে এর মূল কারণ পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা এবং এটি সম্পূর্ণরূপে মানুষের সৃষ্টি। দিনে দিনে ঢাকা শহরের মানুষ আর অবকাঠামো বাড়ছে। এর বিপরীতে পানি নিষ্কাশনের পথ বৃদ্ধির পরিবর্তে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। একসময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ৪৩টি ছোটবড় খাল প্রবাহিত হতো, যা এ শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যাপকভাবে সহায়তা করত। কিন্তু ক্রমে ক্রমে আজ ১৭টি খাল সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। রামচন্দ্রপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, বাসাবো খাল, বেগুনবাড়ী খালের মতো যে ২৬টি কোনোভাবে টিকে আছে, সেগুলোও দুই পাশ থেকে দখল এবং পচা আবর্জনার চাপে নিজের জীবন বাঁচিয়ে রাখলেও নগরীর পানি পরিবহনের ক্ষমতা হারিয়েছে। একসময় ঢাকা শহরে ছিল অনেক পুকুর, জলাশয়, ডোবা, নালা ইত্যাদি। কিন্তু নগর উন্নয়নের চাপে পড়ে সেগুলোও হারিয়ে গেছে। ভরাট হয়ে তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে রাস্তাঘাট অথবা সুরম্য অট্টালিকা। কিন্তু বিকল্প হিসেবে পানি বের হওয়ার পথ তৈরি হয়নি। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধিমাফিক যেসব পরিকল্পনা হয়েছে, সেখানে লক্ষ করলে দেখা যাবে, পানি নিষ্কাশন পরিকল্পনা সঠিকভাবে হয়নি। বরং পরিকল্পনাবিহীন বিভিন্ন কার্যক্রম এসব জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। ডিএনডি বাঁধ দিয়ে শহরে পানি ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নগরীর বৃষ্টির পানি বের হওয়ার পথ তৈরি হয়নি।
ঢাকা নগরীর পানি নিষ্কাশন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণে যেটির বেশি অভাব তা হলো সমন্বয়। ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ও রাজপথের নিচের ড্রেনগুলোর দায়িত্ব ওয়াসার, রাস্তাগুলো পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ এবং মহল্লার মধ্যকার ড্রেনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের, বাঁধ ও পাম্প স্টেশনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের এবং প্রাকৃতিক খালগুলো দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় খুবই প্রয়োজন। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরনো খালগুলো উদ্ধার করা এবং এখনো যে কয়েকটি খাল স্রোতহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো সংস্কার করে পানিপ্রবাহের উপযুক্ত করা এবং আর কোনো খাল হারিয়ে যেতে না দেওয়া। উল্লেখ্য, যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত বিশ্বরোডের পাশ দিয়ে যে খালটি শীতলক্ষ্যায় যুক্ত হয়েছে, তা দিয়ে যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মাতুয়াইল বা পার্শ্ববর্তী এলাকার পানি নিষ্কাশনের খুব ভালো ব্যবস্থা করা যায়।
রাজধানীর বিভিন্ন ভবনের পানি নামার জন্য প্রায় ২৬০ কিলোমিটার প্রয়োজনের বিপরীতে ১৫০ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন রয়েছে ওয়াসার। আবার প্রবল বর্ষণের পানি নামার জন্য ওয়াসার পৃথক ২৪০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়্যারেজ লাইন বা নালা রয়েছে, যা দ্বিগুণ থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার প্রয়োজনের বিপরীতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ভূ-উপরস্থ ড্রেনেজ লাইন রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর পানি নিষ্কাশনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। কিন্তু বড় সমস্যা হলো সংস্কার ও পরিষ্কার করার অভাবে বর্জ্য পদার্থের চাপে এগুলোও পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত থাকে না। সে কারণে আমাদের প্রথম প্রয়োজন হলো ওয়াসা ও ডিসিসির মধ্যে সমন্বয় করে ড্রেনেজ লাইনগুলো পরিষ্কার করা, যাতে সেগুলো তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পানি নিঃসরণ করতে পারে। ঢাকার সেগুনবাগিচা, ফকিরাপুল, আরামবাগসহ আরো কিছু এলাকায় রাজউকের রাস্তার নিচে বঙ্ কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে পানি নিঃসরণের জন্য। কিন্তু এসব কালভার্ট পলিথিন-বর্জ্যসহ নগরীর অন্য বর্জ্য পদার্থে অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ নগরীর বর্জ্য পদার্থ ডিসিসি যতটুকু অপসারণ করতে পারে, তার বাইরে অনেক বর্জ্যই ঢুকে পড়ে নগরীর নর্দমাগুলোতে। সে কারণে আমাদের ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য পদার্থ যাতে ড্রেনেজ লাইন বা বঙ্ কালভার্টে ঢুকতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ওয়াসা ও ডিসিসির ড্রেনেজ লাইন বৃদ্ধি করা এবং বিদ্যমান লাইনগুলো পরিষ্কার করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি নগরবাসীর মধ্যে এতটুকু সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে নগরীর ড্রেনেজ লাইনগুলো বন্ধ করে নিজেদের বিপদ ডেকে না আনে।
লেখক : প্রকৌশলী, বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ের লেখক
No comments