বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩০৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. লনি মিয়া দেওয়ান, বীর প্রতীক প্রবল এক প্রতিরোধযোদ্ধা অধিনায়কের নির্দেশ পেয়ে মো. লনি মিয়া দেওয়ান সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিলেন। যেকোনো সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের আক্রমণ করতে পারে। সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। সময় গড়াতে থাকল। রাতে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করল।


সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে মো. লনি মিয়া দেওয়ান পাকিস্তানি আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে থাকলেন। সারা রাত যুদ্ধ চলল। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে। পাহাড়তলীতে।
পাহাড়তলী চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাহাড়তলীর যুদ্ধ এর মধ্যে অন্যতম। এ যুদ্ধের বর্ণনা আছে সুকুমার বিশ্বাসের মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী (ঢাকা ১৯৯৯, মাওলা ব্রাদার্স) বইয়ে। সে বই থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
‘...পাঁচলাইশ থানায় অবস্থানরত নায়েব সুবেদার লনি মিয়া দেওয়ান ২৫ মার্চে রাত ১১টায় ক্যাপ্টেন রফিকের (রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, পরে মেজর) নির্দেশক্রমে অবাঙালিদের বন্দী করে তাঁর প্লাটুন নিয়ে পাহাড়তলী স্টেশনে এসে পৌঁছান। ২৬ মার্চ রাতে লনি মিয়া নির্দেশ পেয়ে স্টেশন থেকে প্লাটুন উঠিয়ে পাহাড়তলী রেলওয়ে বিল্ডিংয়ে ডিফেন্স নিলেন। রাত ১০টায় এই প্লাটুনটির ওপর যুদ্ধজাহাজ এন এস জাহাঙ্গীর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ইপিআর বাহিনী যথোচিত জবাব দিতে লাগল। সারা রাত উভয় পক্ষের গোলাগুলি বিনিময় হয়। গোলাগুলিতে ইপিআর বাহিনীর অ্যামুনিশন প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছিল। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর করল। অব্যাহত আক্রমণে ইপিআর বাহিনীর পক্ষে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় ক্যাপ্টেন রফিকের নির্দেশক্রমে প্লাটুনটি সেখান থেকে কোতোয়ালী এলাকাতে ডিফেন্স নিল।’
মো. লনি মিয়া দেওয়ান চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম ইপিআর সেক্টরে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। হেডকোয়ার্টার কোম্পানির একটি প্লাটুনের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। চট্টগ্রামে প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ১ নম্বর সেক্টরে। বিভিন্ন যুদ্ধে দলনেতা হিসেবে তিনি অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. লনি মিয়া দেওয়ানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৮৬।
মো. লনি মিয়া দেওয়ান ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার (ডাক আশ্রাফগঞ্জবাজার) দেবীপুর গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি এখানেই বসবাস করতেন। তাঁর বাবার নাম বছির উদ্দিন, মা ময়না বেগম, স্ত্রী ফুল বানু। তাঁর চার ছেলে, দুই মেয়ে।
মো. লনি মিয়া দেওয়ানের ছেলে খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমার বাবার নামে এলাকায় কোনো রাস্তাঘাট বা প্রতিষ্ঠান নেই। আমরা গরিব পরিবার। কোনো ভাতা পাই না। আশা করি, সরকার এ ব্যাপারে সুনজর দেবে।’
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.