চরাচর-চিঠির কথকতা by সাইফুল ইসলাম খান

কত চিঠি লেখে লোকে_/কত সুখে, প্রেমে, আবেগে,/স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও সুখে' চিঠি নিয়ে অকালপ্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন 'রানার' কবিতা। এরপর অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছে সভ্যতা ও প্রযুক্তি। নতুন থেকে নতুনতর প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের জীবন হয়েছে আরাম-আয়েশে ভরপুর। নতুনকে আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে পুরনোকে পরিত্যাগ করাও জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম।


পরিবর্তনের এ ধারায় যোগাযোগব্যবস্থায়ও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শত শত বছর মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন। শের শাহের আমলে 'ঘোড়ার ডাক'-এর প্রচলন হলেও এর আগে মানুষ চিঠিপত্র আদান-প্রদানে কবুতর ব্যবহার করত। এরপর সুদীর্ঘ সময় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ডাক বিভাগ ঐতিহ্যময় সময় পার করেছে। স্বজন বা দূরের জন, যারা দূরে থাকে, তাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের গুরুদায়িত্ব পালন করত ডাক বিভাগ। এখনো করে বটে; তবে ডাক বিভাগের জৌলুস, গৌরব_সবই এখন অতীত। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লেখার অভ্যাস মানুষের মধ্যে নেই বললেই চলে। প্রযুক্তির কল্যাণে আগের চেয়ে দ্রুত ও অধিক যোগাযোগ মানুষ করে বটে; তবে এ যোগাযোগ ঘটে মোবাইল ফোনে বা ইন্টারনেটে। চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে ক্ষুদ্র বার্তা বা এসএমএস। ক্ষুদ্র বার্তা ক্ষুদ্রই হয়। তাতে না থাকে ভাষা, না থাকে ভাব। আবেগ তো আগেই বিদায় নিয়েছে। চিঠি লিখতে সময়ের প্রয়োজন, প্রয়োজন ধৈর্যের। আমাদের প্রয়োজন আছে, ধৈর্য নেই। সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, ভাবাবেগ_সবই আগের মতোই আছে, অভাব শুধু অভ্যাসের। তাই আর আগের মতো চিঠি লেখা হয় না। প্রিয়জনের চিঠির অপেক্ষায় রানারের পথ পানে আর কেউ চেয়ে থাকে না। মানুষ চিঠি লেখে না, তাই ডাক বিভাগের এখন দুর্দিন। আমাদের দেশে এই দুর্দিনের শুরু গত শতকের শেষের দিকে_১৯৯৩ সালে। ওই বছর মোবাইল ফোন কম্পানি মোবাইল টেলিফোন সেবা চালু করে। অবশ্য বহির্বিশ্বে ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোন বাজারে এলে ক্ষুদ্র বার্তার প্রচলন ঘটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ই-মেইল। ফলে সারা বিশ্বে ডাক বিভাগের ওপর এর প্রভাব বিস্তার লাভ করে। কিছু ব্যতিক্রম, যেমন_সরকারি অফিস-আদালতের কার্যাদেশ, প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি ছাড়া বর্তমান যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটনির্ভর। যোগাযোগের আধুনিক এই পরিষেবা শুধু যোগাযোগব্যবস্থায়ই পরিবর্তন আনেনি, পরিবর্তন এনেছে আমাদের জাতীয় কৃষ্টি-কালচারে। নতুন প্রজন্ম সম্ভবত চিঠি লেখা ভুলেই গেছে। পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে ও মানবিক মূল্যবোধ সংরক্ষণে চিঠি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আনুপাতিক হারে কমে গেছে ডাক বিভাগের কর্মপরিধি। শত শত বছর মানুষের ভাবের আদান-প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি এখন বয়োবৃদ্ধ। একসময় যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ছিল। ১৫০ বছর যোগাযোগক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে অবশেষে চলতি শতকের গোড়ায় টেলিগ্রাম বিদায় নিয়েছে। সভ্যতার আগ্রাসনের ফলস্বরূপ ২০০৬ সালে টেলিগ্রামকে আন্তর্জাতিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে দূরভবিষ্যতে ডাক বিভাগকেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে কি না কে জানে!
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.